ডার্ক মোড
Wednesday, 25 December 2024
ePaper   
Logo
আওয়ামী ব্যবসায়ী নূরুল লুট করেন রূপালী ব্যাংকের ৩০৮ কোটি

আওয়ামী ব্যবসায়ী নূরুল লুট করেন রূপালী ব্যাংকের ৩০৮ কোটি

বিশেষ প্রতিনিধি

২০২২ সালের মূল্য তালিকার তথ্য অনুযায়ী গাজীপুর, শ্রীপুর মৌজায় সম্পত্তিটির মূল্য ছিল ১০ কোটি টাকা। এ সম্পত্তি জামানত রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক ঋণের নামে তুলে নেয়া হয়েছে ৩০৮ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন করে দেয়া হয় এ ঋণ। জমির ওপর শেড তুলে সেখানে রাখা হয় নিজেদেরই অন্য ফ্যাক্টরি থেকে আনা অকেজো, পুরোনো কিছু মেশিন। ব্যাংক থেকে পরিদর্শনে গেলে দেখানো হয় এসব মেশিনপত্র। স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রয়যোগ্য পুরোনো মেশিনারিজের মূল্যও ধরা হয় কয়েকশ’ কোটি টাকা।

ঋণ প্রস্তাবের পর অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে মঞ্জুরি হয় প্রত্যাশিত অঙ্কের ঋণ। বন্ধকী সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন করে কথিত ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ হোসাইন। যিনি কুখ্যাত ব্যাংক লুটেরা মো. নূরুল ইসলামের মেয়ের ঘরের নাতি। তাকে ‘নোমান স্পিনিং মিলস লি:’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ বানিয়ে তুলে নেয়া হয় এই অর্থ। ঋণের নামে দফায় দফায় অর্থ লুট হয় রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক থেকে। লোপাটের ঘটনা যখন ঘটে তখন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী ছিলেন শেখ হাসিনার মাফিয়া সরকারের লুটপাটের অংশীদার আতাউর রহমান প্রধান। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ‘ব্যবসায়ী’ পরিচয়দানকারী লুটেরাদের সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেন রূপালী ব্যাংকের তৎকালীন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। সংবাদদাতার নিজস্ব অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে কথিত ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ হোসাইন রূপালী ব্যাংক থেকে ৩০৮ কোটি টাকা ঋণ নেন। আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ হোসাইন ‘নোমান স্পিনিং মিলস লি:’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ হোসাইনকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেখিয়ে নূরুল ইসলাম যখন ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেন তখন ১৯৯৬ সালে জন্ম নেয়া সাদের বয়স তখন ১৬ বছর। অর্থাৎ ব্যাংক লোপাটে মো. নূরুল ইসলাম একজন শিশুকে পর্যন্ত ব্যবহার করেন। সাদ তখন মালয়েশিয়ায় মাত্র পড়াশোনা করে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ঋণটি যখন ক্ল্যাসিফায়েড হওয়ার উপক্রম হয় তখন সেটি পরিশোধে আব্দুল্লাহ সাদ শরণাপন্ন হন রূপালী ব্যাংকের। ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণপ্রত্যাশীর ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সমুদয় ঋণ অধিগ্রহণ করে। সেই সঙ্গে অধিগ্রহণকৃত ঋণের দ্বিগুণের বেশি অর্থ প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ঋণ মঞ্জুর করে। বিপরীতে বন্ধক রাখে গাজীপুরের শ্রীপুরে টেপিরবাড়ি মৌজায় কেনা ৬৬১ শতাংশ সম্পত্তি। শ্রীপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই বন্ধকী সম্পত্তির দলিল (নং-৯৭৪৩/১৮) পুরোনো মেশিনারিজকে ‘প্রাইমারি সিকিউরিটি গণ্য করা হয়।

অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে ২০১২ সালে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ নেন। তখন সাদ একজন শিশু। শিশুর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে পুনঃঅর্থায়নের বিপরীতে রূপালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির ঋণ লাভের উপযুক্তকতাও যাচাই করে দেখেনি। এ ছাড়া জামানত রাখে নামমাত্র মূল্যের একটি সম্পত্তি (দলিল নং-১২৬৭৭/১২)। সম্পত্তিটির অতিমূল্যায়নও এত অস্বাভাবিক যে, বন্ধকী সম্পত্তিটি কয়েকবার বিক্রি করলেও ওই সময়কার বাজারদর অনুযায়ী ১৫০ কোটি টাকা মূল্য নিলামে উঠে আসবে না। নিম্নতর মূল্যের এ সম্পত্তির বিপরীতেই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে রূপালী ব্যাংক থেকে নেয় আরো ৩০৮ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটি ‘এক্সপোজার লিমিট’ও অতিক্রম করে।

অনুসন্ধান বলছে, ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে রূপালী ব্যাংক থেকে ঋণটি পাইয়ে দেন আবুল কাসেম চৌধুরী ওরফে ‘কমিশন কাসেম’ নামক ব্যক্তি। তিনি ১০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্যাংকটির লোকাল অফিসের জেনারেল ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে তিনি ‘ম্যানেজ’ করেন। ঋণ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে কাসেম হাতিয়ে নেন মোটা অংকের কমিশন। ওই সময় বিভিন্ন ডেস্কে থাকা ব্যাংক কর্মকর্তাদের পকেটেও ঢোকে কয়েক কোটি টাকা। নামমাত্র দামের জমি বন্ধক রেখে কিভাবে শত শত কোটি টাকা ঋণ দেয়া হলো? ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান এবং বন্ধকী সম্পত্তির আদৌ ইন্সপেকশন হয়ে কিনা, জানতে চাওয়া হয় রূপালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধানের সঙ্গে। জবাবে তিনি জানান, আমি এখন দেশের বাইরে রয়েছি। ওই ঋণটির কোনো তথ্য আমার স্মরণে নেই। তবে যটতা মনে পড়ে, লোনটি অন্য একটি ব্যাংক থেকে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লিয়ারেন্স নেয়া হয়েছিল। ঋণ দেয়ার পর এটি নিয়মিত ঋণ হিসেবেই প্রতিষ্ঠানটি লেনদেন করছিল। সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ব্যাংকটির বর্তমান সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানান আতাউর রহমান প্রধান।

ঋণটির বিষয়ে কথা বলেছেন ব্যাংকটির তৎকালীন এজিএম খান মোহাম্মদ ইকবাল (বর্তমানে কৃষি ব্যাংকে কর্মরত)। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে তখন ‘ভালো ক্লায়েন্ট’ মনে হয়েছিল। তাছাড়া এদের ‘করপোরেট গ্যারান্টি’ ছিল। পরবর্তীতে কি হয়েছে আমার জানা নেই।

অনুসন্ধান মতে, ঋণ গ্রহণকালে নোমান স্পিনিং মিলসের ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ দেখানো হয়েছে আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ হোসাইনকে। বাস্তবে এটির মালিকানায় সাদ ছাড়াও রয়েছেন আটজন। তারা হলেনÑ মো. নূরুল ইসলাম, তার পুত্র আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তালহা, মেয়ে নূর-ই-ইয়াসমিন ফাতিমা, মো. আব্দুল কুদ্দুস, এস এম রফিকুল ইসলাম, মো. আব্দুল্লাহ জাবের এবং মো. আব্দুল্লাহ জুবায়ের। সবার ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে, বাড়ি-১৯, রোড-৪৪, ব্লক সিডব্লিউএন (বি), গুলশান-২, ঢাকা। এর মধ্যে আব্দুল কুদ্দুস প্রতিষ্ঠানটির একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী বলে জানা গেছে। তিনি টাঙ্গাইল, গোপালপুরের নাটুরচর গ্রামের মো. শের আলীর পুত্র। যদিও তার পেশা উল্লেখ করা হয়েছে ‘ব্যবসা’। প্রতিষ্ঠানটিতে সর্বোচ্চ শেয়ার (২৫শ’) দেয়া হয়েছে আব্দুল কুদ্দুস এবং আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ হোসাইনকে। কুদ্দুস ব্যতীত সবাই একই পরিবারের সদস্য। ছয়জনের এক হাজার করে শেয়ার রয়েছে। কোম্পানির ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ নামে কোনো পদ রাখা হয়নি।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, কথিত ব্যবসায়ী নূরুল ইসলাম ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য যেকোনো কিছুই করতে পারেন। রূপালী ব্যাংকের অর্থ লোপাটের ক্ষেত্রে নিজের শিশু নাতিকে যেমন প্রতিষ্ঠানের ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ বানিয়েছেন, তেমনকি কর্মচারী কুদ্দুসকে বানিয়েছেন শেয়ার হোল্ডার। যখন যেখানে খুশি যে কারো নাম ব্যবহার করে তিনি ঋণ নেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকালে হয়তো একজনক ‘পরিচালক’ করা হলো, কিন্তু ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে তাকে হাজির করা হয় ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালক’ হিসেবে। ধূর্ত নূরুল ইসলামের অর্থ লোপাটে যেকোনো ধরনের তরিকা অবলম্বন করতে পারেন। আ.লীগ সরকারে থাকার সময় তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা যেমন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ধরে ব্যাংক লুট করেছেন, এখন তেমনি নিজেদের একনিষ্ঠ ‘বিএনপি-জামায়াত’ হিসেবে জাহির করে কৃত অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে বর্তমান সরকারের আনুকূল্য লাভে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যদিও মো. নূরুল ইসলাম, তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আওয়ামী-ঘনিষ্ঠতা এবং নিজেরা আওয়ামী করেন, মর্মে স্বীকারোক্তিসহ ভূরিভূরি প্রমাণ প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।

মূলত নোমান গ্রুপ নূরুল ইসলাম এবং তার পরিবার একটি ব্যাংক লুটেরা এবং আপাদমস্তক একটি অপরাধপ্রবণ পরিবার। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসার আড়ালে বন্ডের মালামাল চোরাই বাজারে বিক্রি, নামমাত্র সম্পত্তি, বিরোধপূর্ণ সম্পত্তি এমনকি সরকারি সম্পত্তি বন্ধক রেখে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, আন্ডার-ইনভয়েস-ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি বিদেশে পাচার, জাল-জালিয়াতি, অর্থের বিনিময়ে ‘জাতীয় রফতানি ট্রফি’ ক্রয়, প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নে ডিবি হারুনসহ পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার, ভুয়া মামলা দায়ের, রিমান্ডের এনে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় একতরফা বিচার করে কারাদণ্ড নিশ্চিত করাসহ বহুমাত্রিক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নূরুল ইসলামের পরিবার। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘দানবীর’, ‘শিক্ষানুরাগী’ হিসেবেও পরিচিত। এটি তার বাহ্যিক অবয়ব। কিন্তু তার ভেতরের চেহারা কুৎসিত। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পাশাপাশি নূরুল ইসলামও ভোল পাল্টানোর চেষ্টা করছেন। তবে বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে। নূরুল ইসলামের ব্যাংক লুটের মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচার অনুসন্ধান সম্পকে জানাতে চাওয়া হলে (বুধবার) দুদক মহাপরিচালক মো. আকতার হোসেন বলেন, আজই আমরা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান কামাল এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের বিরুদ্ধে পৃথক পাঁচটি মামলা দায়ের করেছি। এর মধ্যে পৌনে ৪০০ টাকা বিদেশে পাচারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অনেক রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, ব্যবসায়ী অনেক ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়েই কাজ করছি। এখনই নাম উল্লেখ করতে চাই না। শীগগিরই ফলাফল দেখতে পাবেন আশা করছি।

উল্লেখ্য, নামমাত্র মূল্যের জমি বন্ধক রেখে, কখনো জালিয়াতির মাধ্যমে একই সম্পত্তির একাধিক দলিল সৃষ্টি করে নূরুল ইসলাম সেগুলো ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেন অর্থ। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। সেখানে গড়ে তুলেছেন সেকেন্ড হোম। বিনিয়োগ করেছেন বিভিন্ন সেক্টরে। গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অনেক ব্যবসায়ী-শিল্পপতি নামের ব্যাংক লুটেরা দেশত্যাগ করেছেন। তাদের পথ অনুসরণ করে আওয়ামী ব্যবসায়ী মো. নূরুল ইসলামও সপরিবারে দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন