ডার্ক মোড
Sunday, 08 September 2024
ePaper   
Logo
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদারের একই অঙ্গে দুই রূপ

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদারের একই অঙ্গে দুই রূপ

মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার

ফণীভূষণ মজুমদার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভার খাদ্য-মন্ত্রী ছিলেন। তখন(মন্ত্রীত্বকালীন সময়ে) তিনি একবার চুয়াডাঙ্গা সফরে যান। যাওয়ার আগে সেখানকার নেতা ডা. আসাবুল হক জোয়ার্দারকে জানান, ‘চুয়াডাঙ্গা আসছি, আমি বাইরে খাব না। আমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা কি করা যাবে?’

ডা. জোয়ার্দার তাকে বলেন, ‘আপনি চলে আসেন, খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

মন্ত্রী মজুমদার তাকে অনুরোধ করেন, ‘আমার জন্য যেন বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা না হয়। আমি ডাল-ভাত খাব। ডাল-ভাত বলতে যা বোঝায়, সে ব্যবস্থাই যেন হয়।’

তখন ডাক্তার জোয়ার্দার তাঁর পরিবার নিয়ে ডাকবাংলার দুটি ঘরের একটি বাসায় থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী তাঁর দোতলা বাড়িটি রসুন বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই তিনি বহু কষ্টে দু’কামরার সে বাসায় থাকতেন। নির্ধারিত দিনে মন্ত্রী আসেন এবং তাকে খাবার পরিবেশন করা হয়। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ্-উল-হক নিজ হাতে তাকে খাবার পরিবেশন ক’রেছিলেন। তার (ফণীভূষণ মজুমদার) জন্য বিশেষ কোন আয়োজন ছিল না, শুধু ডাল-ভাত আর একটি মাছের তরকারি ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

মন্ত্রীকে যখন ভাত দেওয়া হয়, তখন তিনি ডাক্তার জোয়ার্দারকে বলেন, "আমি ভাত খাব না। আমি বাংলাদেশের খাদ্য-মন্ত্রী। দেশের জনগণকে ভাত দিতে পারছি না, অতএব আমার ভাত খাবার কোন অধিকার নেই। আমাকে রুটি দেন, আমি রুটি খাব।" তিনি সেদিন ভাত খাননি, রুটি খেয়েছিলেন।

সেই সময় দেশে চালের অভাব ছিল। আমি তখন ছোট ছিলাম, কিন্তু পরিষ্কার মনে আছে বেশ কিছুদিন ধরে শুধু রুটি খেয়ে থাকতে হচ্ছিল। আমি খাওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলা করতাম, ভাত না হলে খাব না। আব্বার মুখটা তখন মলিন দেখেছিলাম। চালের সমস্যা সরকার ধীরে ধীরে সামলে নিয়েছিলেন। তারপর একদিন এক বস্তা চাল এলো বাড়িতে। সেই সাথে ইলিশ মাছও। বাড়ির ছোটদের আনন্দ দেখে কে। সেদিন আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম ভাত পেয়ে।

সেই সময় বঙ্গবন্ধুও ভাত খাননি। বিচিত্রা ১৬ই আগস্ট ১৯৯৬ এক নিবন্ধে লেখা হয়েছিল, “জাতির জনক মহান নেতা শেখ মুজিব কতোটা সাধারণ জীবন যাপন করতেন তা কেউ না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না। তাঁর বড় ছেলে শেখ কামালের বিয়েতে একটা বড় মাছ এসেছিল কন্যা পক্ষ থেকে। কিন্তু তিনি খেয়েও দেখলেন না। বঙ্গমাতা বেগম মুজিব অনেক অনুরোধ করেছিলেন, মহিলা নেত্রীরাও তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি মরিচ পোড়া দিয়ে পাঙ্গাস মাছ খেতে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি খেলেন না। বেগম মুজিব যখন বঙ্গবন্ধুকে বার বার অন্তত একবেলা মাছ খেতে অনুরোধ করছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন, “রেনু, তুমি আমাকে ভাত খেতে বলো না।

মহিলা নেত্রীরা তখন বললেন যে মুজিব ভাই, তাহলে কিন্তু আমরাও খাবো না। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “না, তোরা এরকম কথা বলিস না। তোরাই তো বলেছিস আমাকে যে ২০ টাকা মন চাল দিবি, আর এখন দেখ মানুষ না খেয়ে থাকছে।” তিনি ভাত খেলেনই না।”

‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ২৬৪ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “যেখানে থাকি সেখানকার আবহাওয়াও খুব ভয়াবহ বলে মনে হয়। মিলিটারি কাস্টডি কাকে বলা হয় তা তো পূর্বে জানতাম না। আমার থাকবার বন্দোবস্ত ভালই করা হয়েছে, কিন্তু যে খাবার দেয় তা খেতে আমার কষ্ট হয়। আমাশা রোগে অনেকদিন থেকে ভুগছি। রোজ রোজ গোস্ত ও রুটি খাই কেমন করে? পেটের ব্যথা শুরু হল। ডাক্তার সাহেবরা আসেন ঔষধ দেন, কিছু দিন ভাল থাকি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন বললাম, রুটি আমি খেতে পারব না। আমাকে ভাত দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন। দু' একদিন পরেই ভাতের বন্দোবস্ত হল। তবে গোস্ত চলল। অফিসার মেসে আমার খাবার বন্দোবস্ত, সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী—মাছ খেতে পারে না। এইভাবেই দিন চললো।”

বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ জামাতা ড. এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু কথা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ১৯১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “হেলিকপ্টারে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়। এতদসত্ত্বেও, সরকারের হিসাব মতেই দেশে দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকাসমূহে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার লোকের অনাহারে ও অনাহারজনিত বিভিন্ন রোগে প্রানহানী ঘটে। এই সময় বঙ্গবন্ধু সারাক্ষণ থাকতেন বিমর্ষ ও মর্মাহত। তিনি সারা দুর্ভিক্ষকাল ভাতের পরিবর্তে কেবল রুটি খেয়ে কাটালেন এই বলে, “দেশের জনগণ ভাত পাচ্ছে না, আমি ভাত খাবো কোন অধিকারে।” যদিও তিনি একাধারে রুটি সহ্য করতে পারতেন না। তারপরও জাতির জনক সেই সময় রুটি খেয়ে কাটিয়েছেন।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দীর্ঘ দু’বছর দুপুরে রুটি খেয়ে কাটিয়েছেন। যতদিন না তিনি বিডিআরের জওয়ানদের জন্য দু’বেলা ভাতের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। দৈনিক এই আমার দেশ ৪ঠা আগস্ট ২০২১ লিখেছিল, “১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ওই সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার গ্রহণের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সুবিধা- অসুবিধা জানতে প্রথম দরবার হলে গিয়ে জানতে পেরেছেন তারা দুপুরে রুটির বদলে ভাত খেতে চান। ওই সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দুপুরে শুধু রুটি খেতেন। কথাটা শোনার পর খুবই মর্মাহত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

তখনই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন দেশকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ না করে সেনাবাহিনীর জন্য দুপুরে ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা না হওয়া অবধি তিনিও দুপুরে ভাত খাবেন না।” দুই বছর পর তিনি তাদের জন্য ভাতের ব্যবস্থা করেই দুপুরে ভাত খেয়েছেন তার আগে নয়।

ছোটবেলায় আব্বা আমাকে বিভিন্ন মহানুভব নেতাদের মহানুভবতার কথা শোনাতেন। একদিন মহান নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের গল্প শোনালেন। জানালেন, “লেনিন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন একদিন দুপুরে খাবারের সময় একজন দর্শনার্থী আসেন তার সাথে দেখা ক’রতে। তিনি সেই ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানান তার সাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। সেই ব্যক্তি প্রথমে আপত্তি জানালেও মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধে তাঁর সাথে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। তিনি দেখেন রাষ্ট্রপতি একটি পোড়া রুটি খাচ্ছেন। তখন সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি লেনিনকে প্রশ্ন করেন, "আপনি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে পোড়া রুটি খাচ্ছেন?" তখন মহান নেতা লেনিন তাকে উত্তর দেন, "যেদিন আমার দেশের সকল মানুষ ভাল রুটি খাবে, সেদিন আমিও খাবো, তার আগে নয়।"

ফণীভূষণ মজুমদার যতদিন মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে ছিলেন, ততদিন অন্তত তিনি নীতিবোধ ধরে রেখেছিলেন। তখন তিনি জনগণের কষ্টের সমব্যথী ছিলেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তিনি হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে যেয়ে অবৈধ শাসক খুনি শয়তান মোস্তাকের মন্ত্রীসভায় স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। যখন তিনি কাজটি করেন তখনও বঙ্গবন্ধুর শবদেহের দাফন হয়নি। এখানে প্রবাদটি আরেকবার সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।”

লেখক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, অল ইউরোপিয়ান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানী

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন