ডার্ক মোড
Sunday, 08 September 2024
ePaper   
Logo
প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জ দূর করে উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে

প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জ দূর করে উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে

মোঃ জাহিদুল ইসলাম

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হচ্ছে ইন্টারনেট।সকলকে এই লাইব্রেরীতে প্রবেশের অধিকার দেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জ দূর করা একান্ত প্রয়োজন।কাউকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। সবাইকে ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য দূর করার জন্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। আধুনিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূণ বিষয় হল বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তির পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে।

এর ফলশ্রুতিতে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ডিজিটাল বিপ্লবের মূল ধারক হিসেবে সমগ্র পৃথিবীতে বিবেচিত হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবস্থার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য দূর করতে পারলে আমর তথ্য প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার দ্বারা উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় আহরণ করতে পারবো। প্রযুক্তি অগণিত মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। এই সত্যটা অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের। বৈষম্য আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই অনেক পরিচিত একটি শব্দ।আর্থিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য বা রাজনৈতিক বৈষম্য শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই অভ্যস্ত। কিন্তু প্রযুক্তির চরম উন্নতির এই যুগে আমরা নতুন এক বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি আর তা হলো ডিজিটাল প্রযুক্তির বৈষম্য। শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীদের সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ সৃষ্টিতে সকল ক্ষেত্র ডিজিটাল প্রযুক্তির বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে নারীদের পরিবারিক ও সমাজিক ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।

বর্তমান আধুনিক যুগে ডিজিটাল বৈষম্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের বহু দেশ এ সমস্যায় ভুক্তভোগী। বিশ্বে বহু মানুষ রয়েছেন যারা প্রতিনিয়তই প্রযুক্তির নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।বিশেষ করে করোনাকালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছিল।ব্যক্তিগত ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বহু দেশ তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করেছিলেন।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত সব ক্ষেত্রেই বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়েছিল।বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইন্টারনেট সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করার পাশাপাশি সাশ্রয়ী মূল্যে স্মার্ট ফোন এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ সকলের সাধ্যের মধ্যে থাকলে সবাই এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনেও পরিবর্তন এসেছে। এখন হয়তো মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটারে পত্র যোগাযোগের কাজ সারা হচ্ছে কিন্তু জরুরি নথি, বিভিন্ন পণ্য ও পার্সেল পরিবহনের চাহিদা বাড়ছে।

এ পরিষেবায় দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও প্রতিযোগিতা দু’টোই বেড়েছে। বিশেষ করে ই-কমার্সের রমরমা অবস্থার কারণে পার্সেল ও ডেলিভারি এখন প্রয়োজনীয় সেবা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসমতা দেশের জনগণের মধ্যকার বর্তমান অসমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই আমাদেও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সরকারি ও বেসরকারি সেবায় সবার সমান সুযোগ না পাওয়া একটি কঠিন বাস্তবতা। সরকার প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় ‘সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার’ অংশে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এখন এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা জরুরি এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে তথ্যপ্রযুক্তিকে সব জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তুলতে হবে। বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হলে এর বিকল্প নেই। ইন্টারনেট সহজলভ্য করা, প্রযুক্তি সম্পর্কিত অবকাঠামোর উন্নয়ন করা, মানুষকে প্রযুক্তি-সাক্ষর হিসেবে গড়ে তোলার মতো পদক্ষেপগুলো ডিজিটাল বৈষম্য রোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দারিদ্র্য বিমোচনের উত্তম সহায়ক। এর পাশাপাশি একই সঙ্গে তা সুশাসন, গুণগত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অন্যতম কৌশল হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিতে সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এতে করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যম সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার পথ অনেকটাই সহজ হবে।

পাশাপাশি কম খরচে বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নারীরা যাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।করোনাকালীন সময়ে বহু ছাত্রছাত্রীকে তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস, অনলাইনে অফিস পরিচালনা করা প্রভৃতি একটি বিভীষিকার নাম ছিলো। অনেক ছাত্রছাত্রীকে বাড়ি থেকে বহু দূরে গিয়ে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হয়েছিল। এখন এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইন্টারনেট প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তি বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।

এছাড়া আরেক দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে গুগল, আমাজন, আলিবাবা, ফেসবুক প্রভৃতি এসব কোম্পানি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে অনলাইনের ওপর নির্ভর করেই।আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিশ্বের অনেক স্থানে প্রযুক্তিনির্ভরতা দিন দিন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটের সঙ্গে ডিভাইসের যুক্ততা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বিশ্বে উন্নয়ন তড়িৎ গতিতে ত্বরান্বিত হয়। ব্যাংকিং, চিকিৎসা এবং অনলাইন কেনাকাটা সহ বিভিন্ন সেবা এখন পৌঁছে গেছে প্রত্যেক গ্রাহকের হাতের মুঠোয়। অফিসের সবার কাছে একটা কম্পিউটার থাকতে হবে। এটি আগে কেউ চিন্তাও করতে পারত না। এখন প্রায় সকল অফিস আদালত পুরোপুরি পাল্টে গেছে।অফিসে কাগজে কিছু লিখতে হয় না বরং এর পরিবর্তে কম্পিউটারে লিখে একজন আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কম্পিউটারগুলো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত হয়ে থাকে। চোখের পলকে যাদুর মত সব কাজকর্ম হয়ে যায়।এ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময়ে প্রযুক্তি কোনো না কোনোভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলছে।

পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর যার জীবনে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কোনো প্রভাব নেই বা পরিবর্তন আনেনি।ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আসা অর্থ প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। এসব কিছুই হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফল। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহু মানুষই এই শতকে এগিয়ে যাচ্ছে বহুদূর । তবে বহু মানুষ আছে, যারা প্রযুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এতে নিঃসন্দেহে নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বের জন্যই দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে।

যাঁরা বিদেশে যাবেন তাঁদেরকেও তথ্য প্রযুক্তির বিষয়গুলোতে দক্ষ হতে হবে। আর সে জন্যই প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য দূর করে আমাদের সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত জীবনব্যবস্থার বাস্তবায়নে আমাদেরকে অগ্রগামী হতে হবে। বর্তমান আধুনিক যুগে শিল্প বিপ্লবের কারণে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। বর্তমানে প্রযুক্তির এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দেওয়ার পাশাপাশি আবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসছে।প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিনিয়তই ধনী ও গরিব দেশের পার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কাজগুলো ভাগ হয়ে যাবে অদক্ষ-স্বল্প বেতন ও অতি দক্ষ-অধিক বেতন, এসব শ্রেণিবিভাগে দক্ষ ব্যক্তিরা কাজ পাবে, অদক্ষ ব্যক্তিরা বেকার হয়ে যেতে পারে। রোবট ও স্মার্ট যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে কাজের জনবলের ওপর নির্ভরতা অনেক কমে যাবে। অনেক কর্মজীবীরা বেকার হয়ে পড়বে। আগামী দিনগুলোতে প্রতিনিয়তই অনেক পেশার ওপর নির্ভরতা কমে আসার পাশাপাশি রোবট ও যন্ত্রের ব্যবহার তুলনামূলক ভাবে অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।

পক্ষান্তরে মেধাভিত্তিক পেশার প্রয়োজন যেমন প্রোগ্রামার, আইটি বিশেষজ্ঞ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ইত্যাদিতে দক্ষ লোকের চাহিদা বাড়বে। ফলশ্রুতিতে একটি বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে আমাদের। তাই প্রযুক্তি ব্যবহারে বৈষম্য ও চ্যালেঞ্জ দূর করে প্রযুক্তিতে পারদর্শী দক্ষ জনশক্তি বাড়ানোর বিকল্প নেই।পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে। তাই এর পথ ধরে আমাদের প্রযুক্তিবান্ধব হবে। নিজেদের দক্ষ এবং বিশ্বচ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী করে গড়ে তুলেতে হবে। এটি করতে পারলেই আমরা উন্নত প্রযুক্তির দ্বারা আগামী বিশ্ব খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হব।

লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন