ডার্ক মোড
Saturday, 21 December 2024
ePaper   
Logo
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অফ থিংসয়ের (আইওটি) মধ্যে সুসম্পর্কের ফলাফল এআইওটি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অফ থিংসয়ের (আইওটি) মধ্যে সুসম্পর্কের ফলাফল এআইওটি

মোঃ জাহিদুল ইসলাম

বর্তমানে এআই (AI) এবং আইওটি (IoT) একসাথে এমন সব সমস্যার সমাধান করছে যা সম্পন্ন করা শুধু অত্যন্ত কঠিনই নয় বরং বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষও বটে। এই প্রযুক্তিদ্বয়ের সংযোগের ফলে কিছু আশ্চর্যজনক সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। যেমন এটি অনেক সমস্যার সমাধান আগে থেকেই করে ফেলতে পারে যা হয়তো পরবর্তীতে ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এআইওটির মাধ্যমে অসংখ্য সংযুক্ত ডিভাইস থেকে প্রাপ্ত রিয়েল-টাইম ডেটা একবারেই সংগ্রহ এবং পরিচালনা করে কোনো একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ ব্যবহার করা যায়।

আইওটি যেটা করতে পারে না সেটা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা করতে পারে। অপরদিকে যেটা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা করতে পারে না সেটা আইওটি করতে পারে। আর এই দুইয়ের সংমিশ্রণ ‘এআইওটি (AIoT)’ বলতে গেলে সবকিছুই করে ফেলতে পারে।যেটা শুধু অসামান্যই নয় বরং মহাবৈপ্লবিকও বটে। এআইওটি সিস্টেমের আর্কিটেকচার হল একটি জটিল কাঠামো যা দক্ষতার সাথে কাজ করার জন্য নির্বিঘ্নে বিভিন্ন উপাদানকে একত্রিত করে।

এআইওটি, আইওটি ডিভাইসগুলি থেকে সংগৃহীত ডেটা প্রক্রিয়া এবং বিশ্লেষণ করার জন্য AI অ্যালগরিদমগুলি ব্যবহার করে।এতে সেন্সর এবং ডিভাইস রয়েছে। যা মূলত পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহের করে। এআইওটি বুদ্ধিমান, সংযুক্ত সিস্টেম তৈরি করতে আইওটি পরিকাঠামোর সাথে এআই প্রযুক্তির একীকরণকে বোঝায়। আর এটি আইওটি ডিভাইসগুলির দ্বারা সংগৃহীত ডেটার উপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, এআই সিস্টেমগুলি ডেটা থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিতে পারে, প্যাটার্ন শনাক্ত করতে পারে এবং স্বায়ত্তশাসিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এআইওটি সিস্টেমগুলি মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, ভয়েস রিকগনিশন, ইমেজ অ্যানালাইসিসের মতো বিভিন্ন ধরনের মূল প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে।এটি শুধুমাত্র রিয়েল-টাইম অ্যাকশনগুলিকে সক্ষম করে না বরং ক্রিয়াকলাপগুলিকে অপ্টিমাইজ করতে, দক্ষতা উন্নত করতে এবং উদ্ভাবন চালাতে সহায়তা করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) এতদিন যাবত বৈচিত্রময় আইটি সিস্টেমের স্বতন্ত্র ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে।

তবে তাদের মধ্যে এক অন্তর্নিহিত বন্ধন সবসময়ই ছিল। আর যতদিন যাচ্ছে এদের মধ্যে তফাত ততই কমে আসছে এবং এরা একে অন্যের প্রতিরূপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একটা সিস্টেমের ব্রেইন হিসেবে কল্পনা করা হয় তাহলে আইওটিকে সেই সিস্টেমের ডিজিটাল নার্ভাস সিস্টেম কিংবা বাকি গোটা শরীর হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যত সময় গড়াচ্ছে আইওটি ততই স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে। আইওটির ব্যবহার বাস্তবিকভাবে সবখানেই বিদ্যমান। হোম অটোমেশন সিস্টেম এবং ম্যানুফেকচারিং ন্যানোবোট থেকে শুরু করে সেলফ-ড্রাইভিং কার এবং হেভি ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারিজ পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে আইওটির প্রয়োগ নেই।

এআইয়ের বিশ্লেষণাত্মক এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার সাথে আইওটিয়ের ডেটা সংগ্রহের ক্ষমতা একত্রিত করে, এআইওটি আরও দক্ষ, স্বায়ত্তশাসিত এবং প্রাসঙ্গিকভাবে প্রাসঙ্গিক সিস্টেমগুলিকে সক্ষম করে। প্রযুক্তির এই সংমিশ্রণে রিয়েল-টাইম অন্তর্দৃষ্টি, স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া এবং সামগ্রিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে স্মার্ট শহর, স্বাস্থ্যসেবা, উৎপাদন, কৃষি এবং পরিবহন সহ বিভিন্ন শিল্পে বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে। পূর্বে আইওটি ডিভাইসগুলোকে মূলত ডাটা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে ধারণা ছিল- সংযুক্ত ডিভাইসগুলোর একটি মেশ (সবাই সবার সাথে সংযুক্ত) নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা ক্রমাগত অ্যাডমিনদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে।

যদিও এখন আইওটির ধারণা অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছে, তবে ইদানীং এআইওটি এক্ষেত্রে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে! ডাটা প্যাটার্ন বিশ্লেষণ ও বিশাল বিশাল সাইজের ডাটা প্রক্রিয়াজাত করে সুনির্দিষ্ট তথ্য এবং সিদ্ধান্ত প্রদান করার মাধ্যমে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা আইওটিকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে! এর ফলে আইওটি ডিভাইসগুলো শুধু তথ্য সংগ্রহই নয়, বরং সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, যার ফলে প্রচুর সময় এবং নেটওয়ার্কিং ও প্রসেসিংয়ের কাজ বেঁচে যায়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, স্মার্ট সেন্সর ও ইন্টিগ্রেটেড চিপের মাধ্যমে বৈচিত্রপূর্ণ ডাটা থেকে প্যাটার্ন রিকগনিশনের মাধ্যমে এই কাজগুলো করা হয়। উদাহরণস্বরূপ এআইওটি পদ্ধতিতে একটা স্বয়ংক্রিয়-মেশিন তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা, বাতাসের অবস্থা এবং এরকম আরো অনেক রকমের ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে থাকে।

এআইওটি পদ্ধতিতে অন্যান্য যেকোনো পদ্ধতির থেকে অন্তত ২০-২৫ গুণ আগে ফলাফল প্রকাশ বা নির্ণয় অর্থাৎ প্রেডিকশন করার ক্ষমতা রয়েছে।এআইওটি যেকোনো পরিপূর্ণ ও পরিণত (ম্যাচিউর) ইকো-সিস্টেম তৈরির ক্ষেত্রে নতুন একটা দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যেটার গুরুত্ব যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি।আইওটি বিশাল সংখ্যক পোর্টেবল ডিভাইস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ওয়ারেবল এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে-অন্যের সাথে সংযুক্ত করে। এই সংযুক্ত ডিভাইসগুলো তাদের পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং এদেরকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা সম্ভব হয়।

আইওটির মাধ্যমে এই বিশাল পরিমাণ ডাটা সংগ্রহ করার পরে এবার সেই ডাটাগুলোকে দিয়ে কাজ করার জন্য বিগ ডাটা প্রসেসিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবশ্যই লাগবে।এভাবে এরা একসাথে কাজ করে অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলতে পারে। আর তাই যত দিন যাবে এই প্রযুক্তিগুলো স্বতন্ত্র না থেকে একে অন্যের পরিপূরক অংশ হিসবে একটা সিস্টেমে কাজ করবে ততই প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটবে । কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অফ থিংস এর সংমিশ্রণের মাধ্যমে বর্তমানে রোগীর যত্ন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় একটি উজ্জ্বল এবং গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবাতে এখন এআইওটির প্রযুক্তির দ্বারা রোগ নির্ণয়ের উন্নতি করতে, চিকিৎসা প্রক্রিয়াগুলি ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্যসেবাতে এআইওটি-এর ব্যাপক ব্যবহার অবশ্য ডেটা নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং আইনি সম্মতির সাথে কিছু সমস্যা উপস্থাপন করে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা সেটিংসে এআইওটি সিস্টেম প্রয়োগ করার সময়, নৈতিক মান বজায় রাখা, ইন্টারঅপারেবিলিটির গ্যারান্টি দেওয়া, এবং সংবেদনশীল মেডিকেল ডেটা রক্ষা করা সহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এআইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অফ থিংসের সংমিশ্রণ। এই সংমিশ্রণটি শিল্প থেকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত অনেক সেক্টরকে রূপান্তর করার বিশাল সম্ভাবনা সরবরাহ করে।

এটি নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের তথ্যপ্রযুক্তির অন্যতম বৃহত্তম প্রযুক্তি প্রবণতা। এআইওটি সর্বাগ্রে আমাদেরকে আরও স্মার্ট, স্বায়ত্তশাসিত সিস্টেম তৈরি করার ক্ষমতা দেয় যা বাস্তব সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে পারে। আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে পরিবর্তন করার জন্য এর সম্ভাবনা প্রচুর। যেকোনো নতুন প্রযুক্তির মতোই এই প্রযুক্তিতেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এআইওটি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা এবং উদ্বেগ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। প্রকৃতপক্ষে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ গোপনীয়তার সমস্যা উত্থাপন করে। এআইওটি ডিভাইসগুলি পর্যাপ্তভাবে সুরক্ষিত না হলে সাইবার আক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং নৈতিকতা সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে নিশ্চিত করতে হবে। এআইওটি (AIoT) এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন এটি ব্যবহারকারীর মূল্যবোধ এবং মানগুলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ব্যক্তি, ব্যবসা এবং সমাজ হিসাবে আমাদের অবশ্যই প্রযুক্তির এই সুযোগটি কাজে লাগাতে প্রস্তুত থাকতে হবে। পাশাপাশি এই প্রযুক্তি থেকে আসা চ্যালেঞ্জ গুলোর মুখোমুখি হতে হবে।

লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন