প্রযুক্তি ব্যবহারে আত্মবিশ্বাস হতে হবে নিজের প্রতি: প্রযুক্তির প্রতি নয়
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সভ্যতার চাকা একই সুতোয় গাঁথা এবং চলমান। বর্তমানে জীবনকে গতিময় করে তুলতে প্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া উন্নত জীবন ও সভ্যতা যেন কল্পনাই করা যায় না। প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ফলে প্রতি মুহূর্তেই যেন জীবন বদলে যাচ্ছে। মূলত প্রযুক্তির জন্মই হয়েছে যেন জীবনকে সহজ ও সুন্দর করার জন্য। অবশ্য এর জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।
একদিকে যেমন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার হতে পারে। অপরদিকে খারাপ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হতে পারে অপব্যবহারও। বর্তমানে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারও বাড়ছে । তাই প্রযুক্তির অপব্যবহার এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। মানুষ প্রযুক্তিকে পরিচালনা করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে নাকি প্রযুক্তিই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। বর্তমানে এই জটিল প্রশ্নটি মানুষের বিবেককে ভাবিয়ে তুলেছে। আর এই জটিল প্রশ্নটির সবচেয়ে সহজ উত্তর হচ্ছে যেহেতু মানুষের জন্যই প্রযুক্তি তাই মানুষ প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণে এনে প্রযুক্তির দ্বারা সবকিছু সুন্দর ভাবে পরিচালনা করবে।
প্রযুক্তির ইতিবাচক সদ্ব্যবহার করে জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য করে গড়ে তোলার পাশাপাশি আরোও গতিময় করে তুলবে। অতএব সতর্কতার সঙ্গে প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য পথ চলা ও উন্নতি সাধনে যতটুকু প্রয়োজন এর সুফল ততটুকুই গ্রহণ করা উচিত। প্রযুক্তির বিশাল সাম্রাজ্যে নিজেকে বেহিসাবি ভাবে উজাড় করে দিয়ে প্রযুক্তির কাছে নিজেকে সঁপে দিলে বিপর্যস্ত হতে পারে জীবন। ক্রমাগত প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে থেমে যেতে পারে সব অর্জন। এমনকি প্রযুক্তির ভয়ংকর ক্ষতিকর প্রভাবে মৃত্যুঝুঁকিও তাড়া করতে পারে সব সময়। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই যুগে এর অগ্রযাত্রা থামানো সম্ভব নয় এবং এটা করা উচিতও নয়। তবে অবশ্যই অপব্যবহার রোধ করার পাশাপাশি এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ সবকিছু সহজে হাতের কাছে পেতে চায়।
ইন্টারনেট প্রযুক্তি, স্মার্টফোনের ব্যবহার যোগাযোগ ব্যবস্থাপনাকে করেছে অনেক সহজ। তাই এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। এখন ছোট-বড় সবাই প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত সারাক্ষণ হাতে মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ব্যস্ত থাকে সবাই। প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় অনেকেরই বিনিদ্র রাত কাটে। মোবাইল ফোন এখন খুবই জনপ্রিয় একটি প্রযুক্তি। প্রতিদিনই এর গ্রাহক বাড়ছে। মানব সভ্যতার বিস্ময়কর বিকাশে বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো মোবাইল ফোন।
তথ্য আদান-প্রদানে মোবাইল ফোন যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে। বর্তমানে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সমন্বিত এ মিনি সংস্করণ ছাড়া যেন এক মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। অতিদ্রুত বিশ্বের যেকোনো স্থানে যোগাযোগ ক্ষমতা ও নানা ধরনের সুবিধার কারণে সারা বিশ্বে মোবাইল ফোন ব্যাপক জনপ্রিয়। মোবাইল ফোনের অপব্যবহার যাতে কমে সেজন্য প্রয়োজন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সন্তানকে মোবাইল ফোন দেওয়া। এর পাশাপাশি মোবাইল ফোন ব্যবহারের অপব্যবহার সম্পর্কে ভালোভাবে সুশিক্ষা দেয়া। প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এসেছে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ও এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য। আদিম যুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানব সভ্যতার যে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বিজ্ঞান মানুষের অতন্দ্র সাধনার ফসল।
বিজ্ঞানের দ্বারা আবিষ্কৃত প্রযুক্তি মানুষকে দিয়েছে বেগ। আর এই প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার সভ্যতার প্রতিটি পদক্ষেপকে করেছে দ্রুততর এবং পৃথিবীকে করেছে ছোট। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে অনিঃশেষ শক্তির অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা। বিজ্ঞানীদের বিস্ময়কর আবিষ্কার প্রযুক্তি। প্রযুক্তির সংস্পর্শে পৃথিবীতে নবচেতনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবী দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে কাজ সমাধান করতে পারে। প্রযুক্তির সহায়তায় মানুষ অল্প পরিশ্রম করে অধিক কাজ করতে পারে এবং আর্থনীতিক উন্নতিও হয় দ্রুত। তাই বিশ্ব এখন প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এক দেশে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অন্য দেশে রফতানি করে আর্থিক উন্নতি করছে। তাছাড়া কোনো কোনো দেশ প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য কাঁচামাল রফতানি করে আর্থিক উন্নতি করছে।
প্রাগৈতিহাসিক মানবের অগ্নি আবিষ্কারের দিন থেকে মানবজীবনে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মানুষের অতন্দ্র সাধনা বিজ্ঞানকে করেছে সমৃদ্ধ। এদিকে এখনো বিশ্বমানের প্রযুক্তিগুলো গুটিকয়েকের হাতেই বন্দি রয়েছে। তাই প্রযুক্তির কারণে বিভক্তি ও বৈষম্য যেন না হয় সেদিকেও বিষেশ নজর রাখতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব মানুষের শুধু যে কল্যাণ করেছে তা নয়। প্রযুক্তির অপব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে অকল্যাণকেও ডেকে আনছে। যন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ ক্রমশই হয়ে উঠছে শ্রমবিমুখ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে বিশ্বে এগিয়ে চলেছে আধুনিক সভ্যতার মানুষ। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্যতাকে কল্পনা করা যায় না।
প্রযুক্তি মানব সভ্যতার এক বিশিষ্ট অবদান। আধুনিক বিশ্বে মানব কল্যাণে প্রযুক্তির অবদান যে কত ব্যাপক তা প্রতিদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করা যায়। প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করার পাশাপাশি করেছে আরোও অধিক গতিশীল। কিন্তু যদি মানুষ বিজ্ঞানের এই কল্যাণকর শক্তিকে অপব্যবহার করে তবে এর দোষ প্রযুক্তির নয়। প্রযুক্তিকে অপব্যবহারকারী প্রকৃত দোষী হচ্ছে এর ব্যবহারকারী মানুষের। মানুষ যদি প্রযুক্তির শক্তিকে অপব্যবহার না করে বিজ্ঞানের শুভবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে প্রযুক্তিকে সভ্যতার বিকাশে কাজে লাগায় তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার অভিশাপ না আশীর্বাদই হবে। আমাদের সবসময় একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব। প্রযুক্তি যেন কোনভাবেই আমাদেরকে ব্যবহার করতে না পারে।
আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা আরোও বেশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে। তাই নতুন উদ্ভাবনের ব্যাপারে আমাদেরকে চোখ–কান খোলা রাখতে হবে। নতুন নতুন প্রযুক্তি গুলোকে গ্রহণ করার মনোভাব থাকতে হবে। প্রযুক্তির সাথে বন্ধুত্ব করে আমাদেরকে প্রযুক্তিবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুনকে গ্রহণ করার পাশাপাশি নতুনত্বকে জানতে হবে। নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে যেকোনো ধরনের প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য। প্রযুক্তিকে নিজের প্রতিযোগী ভাবা যাবে না।
প্রযুক্তিকে আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করতেও দেয়া যাবে না। প্রযুক্তিকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। এই আধুনিক প্রযুক্তিই সারা বিশ্বকে জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। প্রযুক্তির অবদানে বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তি মানুষকে যেমন উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে তেমনি কঠিন কাজগুলোকে করেছে সহজ। তাছাড়া প্রযুক্তির আকাশছোঁয়া সাফল্যের বিপরীতে রয়েছে সভ্যতা ধ্বংসের হাতছানি। তবে এর কুফল মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রযুক্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একজন মানুষের জ্ঞান এবং বিবেক। তার জন্য আমাদের সব সময় সচেতন হতে হবে। কেননা মানুষ যদি প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে পারে তাহলে নিয়ন্ত্রণও করতে পারবে। সুতরাং প্রযুক্তির কুফল বর্জন করে প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে প্রয়োগ করে বিশ্বকে আরো উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।