ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মাতৃভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার প্রসঙ্গে
এনামুল হক খন্দকার
মানুষের মনের আবেগ, অনুভূতি,সুখ দুঃখ,হাসি আনন্দ,ব্যাথা বেদনা ও ভাব কল্পনা প্রকাশের বাহন হলো ভাষা। অর্থপূর্ণ ও বোধগম্য ধ্বনি হলো ভাষা। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর ভাষা নেই। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সৃষ্টির সেরা মানুষের জন্য ভাষাই হচ্ছে এক শ্রেষ্ঠ নিয়ামত বিশেষ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, " পরম করুনাময় সৃষ্টি করেছেন মানুষকে এবং তাকে শিক্ষা দিয়েছেন অভিব্যাক্তি ও ভাব প্রকাশের ক্ষমতা তথা ভাষা।"
মানব শিশু মায়ের মূখ থেকে যে ধ্বনি শুনে এবং উচ্চারণ করতে শিখে তাই মাতৃভাষা। মা যে ভাষায় কথা বলে এবং সন্তানের সাথে যে ভাষায় ভাব বিনিময় করে উহাই তার মাতৃভাষা।
এ পৃথিবীতে আল্লাহ অসংখ্য ভাষা ও বিচিত্র জাতি গোষ্ঠীতে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং সকল ভাষা ও জাতি গোষ্ঠীকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইসলামে কোন বিশেষ ভাষা ও বিশেষ বংশ, জাতি-গোষ্ঠিকে অন্য সকল ভাষা ও জাতি গোষ্ঠির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি। কুরআনে বলা হয়েছে " আমি মানবজাতিকে একজন পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং অসংখ্য সম্প্রদায়, বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তারা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পারে। তবে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত সে যে অধিক পূণ্যবান।" ইসলামে বংশগত, জাতিগত ও ভাষাগত আভিজাত্য মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি নয়। চারিত্রিক ও নৈতিক শুদ্ধতা হলো মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি। মহানবি সঃ বিদায় হজ্বের ভাষনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন," সাবধান, অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আবার আরবের উপরও অনারবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর উপর সাদার কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই,সাদার উপরও কালোর কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত সে,যে অধিক পূণ্যবান।"
মানুষের জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য হলো আল্লাহর কুদরত অর্থাৎ শক্তি ও ক্ষমতার নিদর্শন এবং তাঁরই সৃষ্টিকুশলতার প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে," আল্লাহর এক অপূর্ব নিদর্শন হলো আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য, এর মধ্যে জ্ঞানী চিন্তাশীল লোকদের জন্য শিক্ষনীয় নিদর্শন রয়েছে " (রুম-২২)।
মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ যুগে যুগে যত নবি রাসুল এবং ঐশী গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককে স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন যেন তাঁরা আল্লাহর বাণী ও পয়গাম তদানীন্তন মানুষের কাছে সুন্দর সাবলীল ও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে পারেন আর মানুষ যেন মহান আল্লাহর প্রেরিত বাণী ও শিক্ষা নবি রাসুলদের কাছ থেকে এর যথাযথ উপলব্ধি ও অনুধাবন করে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। কুরআনে বলা হয়েছে, " আমি যত রাসুল প্রেরণ করেছি, তাঁদের প্রত্যেককে স্ব স্ব জাতির ভাষা তথা মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছি, যাতে তাঁরা ( আল্লাহর বিধান) সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করতে পারে।"
পবিত্র কুরআন ও হাদীসের মর্মানুযায়ী ইসলাম পৃথিবীর সকল ভাষা ও ভাষাভাষী জনমন্ডলিকে সম্মান করতে শিখায়। ইসলাম পৃথিবীর কোনো ভাষা ও ভাষাভাষী জনমন্ডলিকে হেয়প্রতিপন্ন কিংবা তুচ্ছ জ্ঞান করতে ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের শিক্ষা দেয়না। অনুরূপ ইসলাম পৃথিবীর কোন ভাষাকে অনইসলামি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে একে বর্জন করতে বলেনা। কারণ সকল ভাষা মহান আল্লাহরই সৃষ্টি। তাই ইসলামে সকল ভাষা ও ভাষাভাষী মানুষের গুরুত্ব ও মর্যাদা এক ও অভিন্ন। কেউ কারও উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারেনা। আগেই বলেছি, মানুষের ভাব প্রকাশের নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ বাহন হলো ভাষা। ভাষার মাধ্যমে মানুষের আবেগ অনুভূতি, চিন্তা চেতনা, জীবন দর্শন তথা আদর্শ সংস্কৃতি পরিস্ফুটিত হয়। একটি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যেরুপ চিন্তা চেতনা ও আদর্শ সংস্কৃৃতি লালন করে,সে ভাষা অনুরূপ পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য ধারন করবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবি ভাষা ছিল আবু জেহেল, আবু লাহাব,উতবা শায়বার মতো পৌত্তলিক আরবদের ভাষা। প্রাক ইসলামি যুগে আরবি ভাষায় পৌত্তলিকতার আদর্শভিত্তিক মদ,জুয়া ও উগ্র যৌনতাকেন্দ্রিক ঈন্দ্রীয় সম্ভোগধর্মী অশ্লীল ভোগবাদি কবিতা, সাহিত্য রচিত হয়েছে। আবার এ ভাষাতেই আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল মুহাম্মদ সঃ এর আবির্ভাব এবং ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন নাযিল হয়েছে। এ ভাষার মাধ্যমে পরবরর্তীতে ইসলামের মর্মবাণী সারা বিশ্বে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। কালক্রমে এ ভাষাই ইসলাম ও পবিত্র কুরআনের ধারক বাহকে পরিণত হয়েছে। সুতরাং মানুষ ভাষাকে যে রুপে ও আঙ্গিকে ব্যবহার করে, ভাষা সেই রুপ ও সে বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এক্ষেত্রে ভাষার কোন নিজস্ব চালিকা শক্তি নেই।
ঊনিশশ' সাতচল্লিশ সালে এ উপমহাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঐ রাষ্ট্রের পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকচক্র নিখিল পাকিস্তানের সমগ্র জনসংখ্যর ছাপ্পান্ন শতাংশের মাতৃভাষা বাংলাকে অনইসলামি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করে মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ নাগরিকের ভাষা উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রুপে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। আর এ অপকর্মটি করে তারা ইসলামের নামে। প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো নিখিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষার মর্যাদা অস্বীকার করে তাদের পদানত করে রাখা এবং পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলা। সঙ্গত কারণেই তদানীন্তন পূর্ব বাংলার ছাত্রজনতা ও বুদ্ধিজীবী সমাজ এ অন্যায় অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে উঠে।
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে গড়ে উঠা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম এবং শাসকচক্র কর্তৃক উক্ত আন্দোলন সংগ্রাম দমনে পুলিশি তৎপরতার অনিবার্য পরিণতি স্বরুপ ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে সংগঠিত হয় নবসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে এক নির্মম ট্রাজেডি। যা হাজার মাইলের ভৌগলিক দূরত্বে অবস্থিত পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ড পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে তৈরি করে বিভাজনের দেয়াল। বাঙালি মানসে ধীরে ধীরে বিকশিত হতে শুরু করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদী চেতনা। আর উক্ত জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানি উপনিবেশবাদী শাসকচক্রের শাসন ও শোষণের নাগপাশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে রুপান্তরিত হতে প্রলুদ্ধ করে।
অবশেষে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামের পথ পেরিয়ে ১৯৭১এ এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের পেট চিরে জন্ম লাভ করে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭এ নবসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ভাঙ্গন সংগঠিত হয় এর জন্মের মাত্র তেইশ বছরের মধ্যেই। এর ভাঙ্গনের পেছনে একমাত্র কারণ ও দায়ী হলো,পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর অপরিণামদর্শী অগণতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকান্ড। একটি নবীন রাষ্ট্রের জাতিগত ঐক্য ও সংহতির বন্ধন সুদৃঢ় ও সুসংহত করার জন্য যেখানে প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর স্ব স্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সংরক্ষণপূর্বক এর লালন ও বিকাশ সাধনে রাষ্ট্র কর্তৃক ইতিবাচক ব্যবস্হা গ্রহণ করা।
অথচ সেখানে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় অবাঙালি শাসকচক্র রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঐতিহ্যবাহী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করনে মেতে উঠে। ফলে রাষ্ট্রের অপর অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে গড়ে উঠে স্হায়ী অনাস্থা, অবিশ্বাস ও বিভেদর দেয়াল। মাথা মোটা পাকিস্তানি শাসকরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে, একটি রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জাতিগত,কৃষ্টিগত ও সাংস্কৃতিক সাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করে যুক্তির বদলে পেশীশক্তিকে ব্যবহার করে দমন নিপীড়ন চালিয়ে বহুজাতিক রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি কখনও রক্ষা করা যায়না। মূলত "বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য" unity in diversity এ তত্বকে মেনে নিয়েই যে কোন রাষ্ট্র ও সমাজে জাতিগত,কৃষ্টি ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যকে লালন করার মধ্য দিয়েই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য সংহতি জোরদার করা সহজতর হয়।
মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভৃমি সকল মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের বস্তু। প্রত্যেক মানবশিশু মায়ের আদর স্নেহে মায়ের কোলে লালিত পালিত হয়। জীবনে বড় হয়, বিকশিত হয়। মায়ের কোলে থেকে মায়ের কাছ থেকে আধো আধো বুলি শুনে ও শিখে পরিপূর্ণভাবে কথা বলতে শিখে। মনের ভাব অভিব্যাক্তি সুন্দর ও সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে শিখে। তাইতো, মায়ের ভাষা মাতৃভাষা প্রত্যেক মানুষের প্রাণের ভাষা, আবেগের ভাষা। মাতৃভাষায় যত সহজে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়,ভাব বিনিময় করা যায়, হাসি আনন্দ, দুঃখ,ব্যাথা, বেদনা, মনের আকুতি প্রকাশ করা যায়। তা অন্য কোন বিদেশী ভাষায় কখনও সম্ভব নয়। বিদেশি ভাষার সাহায্যে কেবল ভিনদেশীদের সাথে প্রয়োজনের তাগিদে ভাব বিনিময় করা যায়। গীতিকার প্রতুল মুখোপাধ্যায় লিখেছেন," আমি বাংলায় গান গাই/ আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন/আমি বাংলায় বাঁধি সুর/আমি বাংলায় ভাসি,বাংলায় হাসি বাংলায় জেগে রই/বাংলায় মাতি উল্লাসে/ করি বাংলায় হাহাকার আর আমি দেখে শুনে খেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার।" মাতৃভাষাই একটা জাতিসত্তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জীবন্ত প্রতীক।
মায়ের ভাষা মাতৃভাষাই মানব শিশুর মেধা ও মননের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মানবসত্বায় রুপান্তরিত হতে সহায়তা করে। তাই প্রত্যেক শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা দান মাতৃভাষায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এমনকি শিক্ষার নিছক প্রাথমিক স্তর নয়, একটি উন্নত সুদক্ষ আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চ স্তর পর্যন্ত সমগ্র শিক্ষা দান ব্যবস্হা মাতৃভাষায় হওয়া অপরিহার্য। কারণ পড়াশোনা সত্যিকারভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে মাতৃভাষায় পড়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন বিদেশি ভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন অতি সহজ ও সাবলীল ভাবে সম্পন্ন হতে পারেনা। এতে যেকোন স্তরের শিক্ষার্থীদের মেধা ও সময়ের অপচয় হয়। বিদেশি ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞানের জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলো সহজে আয়ত্ত করা ও মস্তিষ্কে ধারন করা সম্ভব হয়না। এজন্যই বিদেশি ভাষায় জ্ঞানের গভীরতা অর্জিত হয়না এবং সামগ্রিক শিক্ষার মান উন্নত হয়না।জাতি সংঘের বিশেষায়িত সংস্হা ইউনেস্কো শিক্ষা দানের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার শিক্ষার গুণগত মানের জন্য অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ কামরুল হাসান মামুন, তিনি তাঁর এক নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, " পৃথিবীর এমন একটি দেশ খুঁজে পাওয়া যাবেনা যে দেশের ছাত্র ছাত্রীরা ভিনদেশের ভাষায় লিখাপড়া করে জ্ঞান বিজ্ঞান ও অর্থ বিত্তে উন্নত হয়েছে।" এই বিষয়ে তিনি তাঁর আলোচনায় শিক্ষা ও অর্থ বিত্তে দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপানের বিষ্ময়কর উন্নতি, অগ্রগতির উদাহরণ টানতে গিয়ে বলেছেন, " ১৮৬৮-১৮৯২ এ জাপানের মেইজি শাসকরা পাশ্চাত্যের সাথে জ্ঞান আদান প্রদানের গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একশ'র বেশি ইউরোপীয় পন্ডিত তাঁরা নিমন্ত্রণ করে দেশে নিয়ে আসেন। আবার দফায় দফায় বহুসংখ্যক ছাত্র, শিক্ষক, পন্ডিত তাঁরা ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশে পাঠান।
এ আদান প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান তাঁরা জাপানি ভাষায় লিখে ফেলেন। অনুবাদ করে প্রচুর বই এবং তা শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের ব্যবস্হা করেন। বিজ্ঞানের পরিভাষা মাতৃভাষায় অনুবাদ করা যায়না-এরকম চিন্তা জাপান ভুল প্রমাণ করে। কারণ, ধার করা বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও এর পরিভাষা নিজ ভাষায় অনুবাদ করে ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষিত করে। এক্ষেত্রে মূলভাষাভাষীদেরও ছড়িয়ে গেছে তাঁরা। একটি ছোট দেশ হয়েও দীর্ঘ দিন তাঁরা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ছিল এ প্রযুক্তিগত জ্ঞানের শক্তিতেই।" তিনি আরও উল্লেখ করেন, " অনুরুপ বর্তমানে চীনও ইউরোপ ও জাপানের উন্নতিকে গবেষণা করে জ্ঞান বিজ্ঞান ও অর্থ বিত্তে অতি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁরাও পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানকে নিজস্ব ভাষায় ধারন করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেছে।" তাই তিনি মত প্রকাশ করে বলেছেন, "শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে অবশ্যই মাতৃভাষা।" তাঁর মতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নয় শুধু, উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় শিক্ষা দান আরও বেশি জরুরি। কারণ উচ্চ শিক্ষার বিষয় এবং এর ব্যাপ্তি আরও কঠিন। সেখানে বিদেশি ভাষা কঠিনকে আরও কঠিন করে তোলে। তখন শিক্ষার্থীরা বিষয় শিখবে না ভাষা শিখবে, এনিয়ে তাদের ত্রিশন্কু অবস্হা হয়। ঠিকমতো কোনটাই শিখা হয়না।" এভাবে তিনি বিভিন্ন যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করে শিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষা দানের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহারের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেন।
আমরা বাঙালি,বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষার সাথে আমাদের আবেগ, অনুভূতি পৃথিবীর যে কোন জাতি অপেক্ষা সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা। কেননা এ ভাষার জন্য ১৯৫২ এর ২১ শেষ ফেব্রুয়ারিতে আমরা আমাদের জীবন দিয়ে এ ভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছি। মায়ের ভাষার জন্য জীবন দিয়ে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলনে সফলতা অর্জনে পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছি। যার জন্য আমাদের ভাষা আন্দোলনে আমাদের আত্মদানের স্বীকৃতির স্বারক হিসেবে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিব বলে ঘোষণা দিয়েছে।এর ফলে আমাদের বাংলা ভাষা ও আমরা বাঙালি জাতি দেশ কালের নিজস্ব গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও এক বৈশ্বিক রুপ লাভ করেছি। এছাড়াও ঊনিশ শ'বায়ান্ন এর ভাষা আন্দোলনে সফলতার সুত্র ধরে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে সতন্ত্র জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবোধের উম্মেষ ঘটেছিল, উক্ত জাতীয়তাবোধের চেতনাই পশ্চিম পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে স্বাধীকার লাভের ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল। অবশেষে ১৯৭১ এর এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে আমরা এক স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশে সক্ষম হই। স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও দুর্ভাগ্য হলো স্বাধীনতা লাভের বায়ান্ন বছর পরেও শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আন্তরিক প্রয়াস ও উদ্যোগ গৃহীত হয়নি।
বিদেশি ভাষায় রচিত পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের মৌলিক গ্রন্হাদি এখনও বাংলা ভাষায় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার উপযোগী করে অনুদিত না হওয়ায় বাংলা ভাষা এখনও উচ্চ শিক্ষার স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের উপযোগীতা অর্জন করেনি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির জন্য যা খুবই বেদনাদায়ক। পাকিস্তানি সামরিক একনায়ক আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার পাশাপাশি ছাত্রসমাজের একুশ দফা কর্মসূচীর এর প্রথম দফায় সন্নিবেশিত হয়েছিল শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলায় শিক্ষা দানের ব্যবস্হা গ্রহণের জোর দাবি। স্বাধীনতার এত বছর পরও অদ্যাবধি আমাদের নিজস্ব ভাষায় পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান তথা পৃথিবীর জ্ঞানের তাবৎ বিষয়াবলী ধারন করতে না পারার ব্যর্থতা আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি ও দূর্বলতাকেই ফুটিয়ে তুলছে। উল্লিখিত ত্রুটি ও দূর্বলতা দেশে একটি কাঙ্খিত গুণগত মান সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করণে প্রধান প্রতিবন্ধক বলা যায়। একারণেই হয়তো শিক্ষার আন্তর্জাতিক গুণগত মান সূচকে আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয় আজ পর্যন্ত কোন সম্মানজনক অবস্থান লাভ করতে পারেনি।যা জাতি হিসেবে সত্যি আমাদের জন্য গৌরবের নয়, বরং লজ্জার।
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনের উদ্যোগ দূরে থাক, বর্তমানে যেভাবে কোমলমতি শিশু কিশোরদের মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার যে প্রবনতা ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করছে, এতে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের সঠিক ও পরিপূর্ণ বিকাশ তো হচ্ছেই না এতে বরং মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক বৈকল্য তৈরি হচ্ছে। একটা কোমলমতি শিশুর জীবনের শুরুতে একটি অপরিচিত বিদেশি ভাষায় পড়াশোনার সকল বিষয় আত্বস্হ করার কঠিন বোঝা চাপিয়ে দিলে তার মস্তিষ্কের উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে আর তা শিশুর মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক স্বাভাবিক বিকাশ সাধনের পথ ব্যহত করবে। কোন বিদেশি ভাষায় শিশুর প্রকৃতিতে সুপ্ত সৃজনশীল শক্তি ও বুদ্ধিভিত্তিক ক্ষমতার কখনও স্বাভাবিক স্ফুরন ঘটতেপারেনা। যা নিছক মায়ের ভাষা মাতৃভাষায় সম্ভব। বর্তমানে আমাদের দেশের একশ্রেণীর উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের অতিরিক্ত টাকা পয়সা ব্যয়ে সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম পড়াশোনা করানোর প্রবনতা নিঃসন্দেহে একপ্রকার আভিজাত্য প্রদর্শন ছাড়া আর কী হতে পারে? কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে এর ভূমিকাই বা কী? তবে বর্তমান বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি শেখার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা আমি মোটেই অস্বীকার করছিনা। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি অবশ্যই শিখতে হবে। তবে তা কোনক্রমেই মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে নয়।
প্রতিবছর অমর একুশে শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, ভাষা সংস্কৃতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেই কেবল মাতৃভাষা বাংলার মান ও গৌরব বৃদ্ধি পাবেনা। দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার এবং শিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার প্রচলন একটি স্বাধীন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে স্বগৌরবে ও স্বমহিমায় টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। এর অন্য কোন বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি।
লেখক অধ্যক্ষ, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী