ডার্ক মোড
Saturday, 16 August 2025
ePaper   
Logo
ভূ-রাজনীতির ঘুঁটিতে বাংলাদেশ

ভূ-রাজনীতির ঘুঁটিতে বাংলাদেশ

 

 ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক

দাবার বোর্ড সাজানো। তবে এ বোর্ড কাঠের নয়—মহাদেশের মানচিত্রের ওপর বিছানো, ঘুঁটিগুলো মানুষের রূপ নিয়েছে। বোর্ডের চার কোণে বসে আছে চার শক্তিধর খেলোয়াড়, আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ—এক অদ্ভুত চরিত্র, যাকে কখনো রানী বলা হয়, কখনো স্রেফ প্যাদা, আবার কখনো বোর্ডের এমন একটি ঘর, যেখানে সবাই নিজের ঘুঁটি রাখতে চায়।

উত্তর কোণে চীন—চোখে বাণিজ্যের টেলিস্কোপ, হাতে সমুদ্রপথের নকশা। হাসিমুখে বলে, “আমরা বন্দর বানাব, রাস্তা বানাব, কিন্তু তালার চাবি আমাদের কাছে থাকবে।” দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্র—সুট-টাই পরে, হাতে গণতন্ত্রের চকচকে ব্যাজ, ভেতরে বাজারের তালিকা। কপট হাসিতে বলে, “তুমি স্বাধীন থাকো, তবে আমাদের ছাতার নিচে।” পূর্বে ভারত—প্রতিবেশী হলেও জানালায় সবসময় চোখ রেখে দেখে, আমরা কখন বাতি জ্বালালাম, কখন নিভালাম। ফিসফিস করে বলে, “তোমার বারান্দা দিয়ে আমার উত্তর-পূর্বে যাতায়াত করব, আর তোমার খবর রাখব।” পশ্চিমে রাশিয়া—গম্ভীর মুখে পারমাণবিক বিদ্যুতের নকশা টেনে চলেছে, যেন দাবার বোর্ডেই বিদ্যুতের লাইন বসাবে। ঠান্ডা গলায় বলে, “বিদ্যুতের আলো চাইলে আমাদের সুইচ ঘুরাতে হবে।”

বাংলাদেশ—মাঝখানে দাঁড়িয়ে, হাতে কূটনৈতিক নোটবুক, কানে একসাথে চার দিকের ফিসফিসানি। অবস্থা যেন এক বিবাহযোগ্য তরুণীর—চারদিক থেকে পাত্রপক্ষ এসে শর্ত দিচ্ছে; কেউ আংটি দেখাচ্ছে, কেউ ব্যাংক ব্যালেন্স, কেউ জমির দলিল, কেউ বিদ্যুতের সংযোগ। তরুণী ভাবছে, “কাকে রাজি বললে বাকিরা রাগ করবে না?” কিন্তু ভূ-রাজনীতির বিয়ের বাজারে একসাথে সবার মন রাখা কঠিন।

আমাদের অবস্থানই আমাদের নিয়তি—দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থল। ইতিহাসও বলছে, এই ভৌগোলিক অবস্থান কখনোই নিরপেক্ষ থাকতে দেয়নি। প্রাচীনকালে সমুদ্রপথের দখল নিয়ে আরব ব্যবসায়ী, পর্তুগিজ দস্যু, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী—সবাই এখানে হাত বাড়িয়েছে। পাকিস্তান আমলেও কর্ণফুলী বন্দর ছিল আন্তর্জাতিক হিসাবের অংশ, আর স্বাধীনতার পর থেকেই নতুন খেলোয়াড়দের আগমন ঘটেছে। এখন সেই খেলোয়াড়রা শুধু কামান বা জাহাজ নিয়ে আসে না, আসে বিনিয়োগ, ঋণ, প্রযুক্তি আর নীতিকথা নিয়ে।

চট্টগ্রাম, মংলা, পায়রা—এই তিন বন্দর কেবল পণ্য ওঠানামার স্থান নয়; এগুলো বড় শক্তিগুলোর স্বপ্নপথ। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড, ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা, রাশিয়ার জ্বালানি সংযোগ—সব পরিকল্পনাতেই বাংলাদেশের নাম মোটা অক্ষরে লেখা। যেন দাবার বোর্ডের মাঝখানে এমন একটি ঘর, যেটা দখল মানে খেলার নিয়ন্ত্রণ।

কিন্তু এই খেলা সহজ নয়। হাসি মানে সবসময় বন্ধুত্ব নয়; অনেক সময় হাসির আড়ালে থাকে ফাঁদ। চীনের বিনিয়োগের সাথে আসে ঋণের শর্ত, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার সাথে আসে রাজনৈতিক শর্ত, ভারতের নৈকট্যের সাথে আসে নিরাপত্তা চাপ, রাশিয়ার প্রযুক্তির সাথে আসে দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরশীলতা। একবিংশ শতাব্দীর কূটনীতি অনেকটা দাবার গ্যামবিট চালের মতো—প্রথমে উপহার দিয়ে প্রলুব্ধ করা, পরে আসল দাবিটা তোলা।

বাংলাদেশের কৌশল তাই অনেকটা দড়ির ওপর হাঁটা শিল্পীর মতো—এক হাতে চীনের প্রকল্প, অন্য হাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার; পিছনে ভারতের প্রতিবেশী সম্পর্ক, পাশে রাশিয়ার বিদ্যুৎ সহযোগিতা। ভারসাম্য হারালেই নিচে ভূ-রাজনীতির খাদ। ভুল এক চাল, আর আমরা হয়ে যাব স্যাক্রিফাইসড পন—যে ঘুঁটিকে খেলোয়াড়রা বিনা দ্বিধায় ছেড়ে দেয়, কেবল নিজের বড় চাল বাঁচাতে।

সাম্প্রতিক উদাহরণও আছে। রোহিঙ্গা সংকটে মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো বক্তৃতা দিলেও সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে; উল্টে এশিয়ার শক্তিগুলো সেই সংকটকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আবার বঙ্গোপসাগরের গ্যাসক্ষেত্র বা সমুদ্র অর্থনীতি নিয়েও নানা কূটনৈতিক প্রস্তাব আসছে, যার আড়ালে বাণিজ্যিক ও সামরিক স্বার্থ স্পষ্ট। এমনকি পোশাক রপ্তানির বাজার নিয়েও চাপ-প্রতিযোগিতা চলছে—এক পক্ষ বলছে শ্রমিকের মজুরি বাড়াও, অন্য পক্ষ বলছে খরচ কমাও।

তবে সবটুকুই অন্ধকার নয়। আমাদেরও চাল আছে, যদি খেলাটা বুঝে খেলি। আঞ্চলিক বাণিজ্য, ব্লু ইকোনমি, ট্রানজিট বাণিজ্য, শিল্পায়ন—এসব হতে পারে আমাদের এন্ডগেম স্ট্র্যাটেজি। সঠিক সময়ে সঠিক চাল দিলে আমরা শুধু ঘুঁটি নয়, বোর্ড সাজানোর অধিকারও পেতে পারি। তবে এজন্য দরকার সুসংহত পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য, এবং সাহসী নেতৃত্ব।

ভূ-রাজনৈতিক দাবায় জয়ী হতে যেমন প্রতিপক্ষের চাল পড়তে হয়, তেমনি নিজের চাল লুকিয়েও রাখতে হয়। বড় শক্তির হাসি, প্রতিশ্রুতি, উপহার—সবকিছুর পেছনে লুকিয়ে থাকা হিসাব বুঝতে পারলেই আমরা খেলার নিয়ম নিজেদের পক্ষে ঘুরিয়ে দিতে পারব।

কিন্তু সাবধান—এই খেলায় ভুল মানে শুধু হার নয়; ভুল মানে পুরো বোর্ডটাই অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। তখন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে—“বাংলাদেশ? ও তো একসময় কেন্দ্রের রানী ছিল, পরে কোণে পড়ে থাকা বিস্মৃত প্যাদা হয়ে গেল।”

যতদিন না আমরা নিজের বোর্ড নিজের হাতে রাখি, ততদিন এই দাবার কোর্টে আমাদের প্রতিটি চালই হবে বেঁচে থাকার লড়াই। আর লড়াইটা কেবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, নিজেদের অদূরদর্শিতার বিরুদ্ধেও।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক
ইমেইল - fokoruddincse@gmail.com

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন