ভাষার সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সম্পর্ক
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
ভাষা মানে শুধু কিছু শব্দ নয়। আবেগ-অনুভূতি, চিন্তাভাবনা, স্বপ্ন-কল্পনা প্রভৃতি ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা না থাকলে মানুষ কল্পনা করতে পারত না এবং সেই অর্থে মানুষ কিন্তু মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতেও পারত না। ভাষার সঙ্গে বিজ্ঞান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষই কথা বলতে পারে। ভাষা জানে এবং ব্যবহার করতে পারে। ভাষা ব্যবহার করে মনের ভাব প্রকাশ করার এই ক্ষমতা আর কোনো প্রাণীর নেই। কারণ তাদের স্বরযন্ত্র থাকলেও মস্তিষ্কের যে অংশ চিন্তাভাবনার কাজ সম্পন্ন করে তার সঙ্গে এর সংযোগ নেই।
অর্থাৎ স্বরযন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ ব্যবস্থার অভাব। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে স্বরযন্ত্রের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ রয়েছে। তাই মানুষ কথা বলতে পারে। ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। এই সংযোগ সাধন মানুষের থাকলেও কথা বলা বা ভাষা আয়ত্ত করা কিন্তু এক দিনে সম্ভব হয়নি। মানুষ আদিম যুগে পাহাড়ের গুহায় থাকত। সেখানে গুহাচিত্র এঁকে দলের অন্য সদস্যদের বুঝিয়ে দিত, শিকারের সময় কে কোথায় থাকবে, কার ভূমিকা কী হবে ইত্যাদি। তখনো মানুষ ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি। আদি যুগে মানুষ দল বেঁধে শিকারে গেলে নিঃশব্দে যেতে হতো। কারন তা না হলে শিকার পালিয়ে যেত। এ অবস্থায় তারা তাদের নেতাকে অনুসরণ করত।
দূর থেকে নেতার চোখের ইঙ্গিত বুঝে তারা সেভাবে অগ্রসর হতো। বর্তমানে আমরা এমন একসময়ে বাস করছি যেখানে সম্পদ হচ্ছে ‘তথ্য’ আর শক্তি হলো ‘প্রযুক্তি’। বর্তমান বিশ্বে যে সমাজ, যে রাষ্ট্র প্রযুক্তিতে যত বেশি এগিয়ে সেই সে রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষমতা ও প্রভাব তত বেশি। প্রযুক্তির বিপ্লব ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে একবিংশ শতকের ডিজিটাল যুগে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই ভাবের আদানপ্রদান করছি, কথা বলছি, গল্প করছি ও প্রশ্নও করছি। পাশাপাশি প্রযুক্তিও আমাদের সাথে কথা বলছে, গল্প করছে তথ্যের আদান প্রদান করছে এবং প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে। প্রযুক্তির নিজস্ব কোনো ভাষা নেই। মানুষ তাকে যা-ই শেখায় তাই সে রপ্ত বা আয়ত্ত করতে পারে। যে কোনো নতুন আবিষ্কৃত প্রযুক্তিকে বিশ্ববাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া জন্য সবার সুবিধার্থে তার ভাষা হিসেবে সাধারণত ইংরেজি ভাষাকেই নির্ধারণ করা হয়। তবে যে কোনো দেশে সত্যিকার অর্থে প্রযুক্তির বিপ্লব ঘটাতে চাইলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রযুক্তির বার্তাকে সমানভাবে পৌঁছে দিতে হবে।
আর বিশেষ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে হলে প্রযুক্তিকে অবশ্যই সেখানকার মাতৃভাষার উপযোগী করে তুলতে হবে। আধুনিক এই যুগে যে কোনো ভাষাকে যদি ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করা না হয় তবে সে ভাষার সতেজতা নষ্ট হবে। এমনকি ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হওয়ারও আশঙ্কাও তৈরি হবে। বাঙালি জাতি রক্ত ঝরিয়ে নিজের ভাষার মান অক্ষুণ্ন রেখেছে। ভাষার জন্য রক্ত ঝরাতে হয়েছে পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্ত অনন্য। বাংলা ভাষা আমাদের কাছে যতটা প্রাণের ঠিক ততটাই আবেগেরও। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৭০০০ ভাষা রয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে সবেমাত্র কয়েকটি ভাষা রয়েছে যেগুলো সর্ব দিক বিবেচনা করে উন্নত ভাষা হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করছে। আমাদের এই মাতৃভাষা বাংলা ভাষা পৃথিবীতে সপ্তম। বাংলা ভাষা অর্জনের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে ইউনেস্কো একটি দিবস ঘোষণা করেছে। দিবসটি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হয়।
উন্নত ভাষাগুলোর মতো বাংলাকে বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন করে সম্ভ্রমের সঙ্গে টিকিয়ে রাখতে হলে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার মতো আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাগুলোর প্রয়োগে ভাষার ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়াতে হবে। প্রতিটি জাতির জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ার একটি পূর্বশর্ত হলো যার যার মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করা। এক গবেষণায় জানা গেছে, মাতৃভাষায় সুন্দরভাবে পড়তে পারে এমন শিশুর সংখ্যা ১৫ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বাড়বে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি হিসাব। মাতৃভাষার সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়া ও সেই সঙ্গে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধনের নিবিড় সম্পর্কের বিষয়টি আগে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। ভাষাবিদদের গবেষণায় আজ এটা প্রতিষ্ঠিত যে মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে অন্তত তিনটি বিদেশি ভাষা সহজে শেখা যায়।
আর আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে দু-তিনটি বিদেশি ভাষায় দক্ষতা না থাকলে টিকে থাকা কঠিন। এগিয়ে যাওয়া তো আরো বহুদূরের কথা। এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা হলো শিশু জন্মের পর থেকেই মায়ের হাসি, কথা বলার ভঙ্গি, মনের ভাব প্রকাশের পদ্ধতি দেখে দেখে শেখে। কথা বলতে শেখার আগে থেকেই স্বপ্ন দেখা শেখে। তাই মায়ের ভাষা শিশুর মনোজগতের বিকাশে বিশেষ অবদান রাখে। এভাবেই মা ও শিশুর মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মায়ের এই মাতৃভাষাই মানুষের মেধাকে শাণিত করে তোলে। এদিকে বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের ভাষায় মোড়ানো পৃথিবীর সমস্ত ভাষা। বিশ্বের ইতিহাসের অনেক দুর্দান্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো বিভিন্ন ভাষায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
স্যার আইজাক নিউটন যিনি গতি এবং মাধ্যাকর্ষণ আইনগুল আবিষ্কার করেছিলেন তার মাতৃভাষা ছিল ইংরেজি। অপরদিকে মেরি কুরি যিনি তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছিলেন তার ভাষা ছিল পোলিশ এবং ফরাসী ভাষা। এদিকে আপেক্ষিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত অ্যালবার্ট আইনস্টাইন জার্মান ভাষায় কথা বলতেন। এই বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ভাষার মাধ্যমে তাদের আবিষ্কারগুলো বিশ্বের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন। বর্তমানে তাদের কাজ বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা একটি সাধারণ ভাষা ব্যবহার করেন যাতে প্রত্যেকে তাদের অনুসন্ধানগুলো সহজেই বুঝতে পারেন। এ কারনে বিভিন্ন দেশের গবেষকরা তাদের কাজ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন, ইংরেজিতে কথিত সম্মেলনে যোগদান করেন এবং ইংরেজি ব্যবহার করে প্রকল্পগুলিতে সহযোগিতা করেন।
এই ভাবে সাধারণ ভাষা একটি সেতুর মতো কাজ করে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং পটভূমি থেকে মানুষকে সংযুক্ত করে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ভাষা এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন যা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জগতকে একত্রে ধারণ করে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভাষার এই সেতুবন্ধনের মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ব্যক্তি তাদের জ্ঞানকে ভাগ করে নিতে পারেন। এর পাশাপাশি এই সেতুবন্ধন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে সহযোগিতা করতে এবং জটিল ধারণাগুলো সহজে সমাধান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে৷ বিজ্ঞান-ইতিহাস বিষয়ে অজ্ঞানতা নয়, নিজের মাতৃভাষায় অনাস্থা নয়, বরং জ্ঞান-প্রবাহকে বেগবান করবার জন্যেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে।
আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের এই মাতৃভাষাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে হবে। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে নির্বাক থেকে আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের ভাষার জন্ম হয়। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ব্যবহার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে এই বিষয় আমরা সবাই অবগত রয়েছি। আদিম মানুষের শিকারের পদ্ধতি আবিষ্কার,গুহায় ছবি আঁকার জন্য শিকারী জীবের রক্ত ও চর্বির সাথে পাথর ও নানা ফলের রস মিশিয়ে রঙ তৈরি এর সবকিছুর সাথেই জড়িত বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গি ও চেতনাশক্তি। বিভিন্ন গুহায় হাজার বছর আগে নির্মিত ভাস্কর্য ও আঁকা ছবিগুলো দেখে বোঝা যায় সেই যুগের মানুষেরও মধ্যে কিঞ্চিত পরিমান হলেও জ্যামিতিক ধারণা ছিল। যদি তা না হতো তাহলে এত নিপুণ শিল্পসৃষ্টি তাদের মাধ্যমে সম্ভব হত না।
যদিও এসবকিছু অত্যন্ত প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞান যা মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অর্জন করে থাকেন। মানুষের নিজস্ব অস্তিত্বের বাইরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মাতৃভাষা অস্তিত্বহীন। তাই মাতৃভাষা অন্তরাত্মা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে ভাষার ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনেকটাই নির্ভরশীল। ভবিষ্যৎ বিশ্বে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি যেমন এগিয়ে যেতে থাকবে ঠিক তেমনি ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার ভূমিকাও আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে নতুন আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনগুলো বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নতুন প্রযুক্তিগুলো ভবিষ্যতে আমাদের আরো ভাল যোগাযোগ করতে সহায়তা করবে। এ বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। আগামীর জন্য আমাদের এমন একটি বিশ্বের কল্পনা করতে হবে যেখানে ভাষার বাধাগুলো যেন আর কোন সমস্যার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। বিশ্বের প্রত্যেকেই যেন তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় তাদের ধারণাগুলো অবাধে এবং সহজেই ভাগ করে নিতে পারে সে বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।