ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের উপর বজ্রাঘাতের ক্ষতিকর প্রভাব
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
মেঘের ভিতর যখন প্রচুর পরিমাণে চার্জ জমা হয় তখন মেঘের ভিতর বড় স্পার্ক হয়। এটি সাধারণত বিজলী চমকানো নামে পরিচিত। মাঝে মাঝে সেই চার্জ এত বেশি জমা হয় যে সেগুলো পৃথিবীর দিকে বিপরীত চার্জের আবে তৈরি করে বাতাসকে আয়নিত করে লক্ষ লক্ষ মাইল পাড়ি দিয়ে প্রচন্ড বেগে মাটিতে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে।
এটিই হচ্ছে বজ্রপাত। এই সময় সরু, আয়নিত ও বিদ্যুৎ পরিবাহী চ্যানেল তৈরীর সময় বায়ুর তাপমাত্রা প্রায় ২৭০০০° c এবং চাপ প্রায় ১০-১০০ গুন পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই পুরো ঘটনাটি ঘটে এক সেকেন্ডের কয়েক হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ে। এই পরিবর্তন আশপাশের বাতাসকে প্রচন্ড গতিতে বিস্ফোরণের মতো সম্প্রসারিত করে।
এর ফলে বজ্রপাতের সময় প্রবল শব্দ উৎপন্ন হয়। বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যা দুটি বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত অঞ্চলের মধ্যে বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক নিঃসরণ দ্বারা গঠিত হয়। বজ্রপাতের ফলে এক বিশাল পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। মেঘ থেকে ভূমিতে হওয়া একটি সাধারণ বজ্রপাতে প্রায় ১ বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন হয়। একটি সাধারণ বজ্রপাতের ফ্ল্যাশ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ভোল্ট এবং প্রায় ৩০,০০০ এম্পিয়ার এর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। সাধারণ বাসাবাড়িতে যেখানে ২২০ ভোল্ট এর বিদ্যুৎ ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। বজ্রপাত মূলত নির্ভর করে কোন একটি দেশের বা অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানের উপর। বজ্রপাতের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।
তবে ঝড়-বৃষ্টির সময় এর সম্ভাবনা থাকে শতভাগ। নানা কারণে বজ্রপাত বেড়ে গিয়েছে। বজ্রপাতের হওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্লাইমেট চেঞ্জ হওয়া, ওজন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। আবার বৃক্ষ, পাহাড় ও পরিবেশ বিভিন্ন কারণে বিনষ্ট হওয়ার কারণেও হতে বজ্রপাত। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সম্প্রতি বজ্রপাত বেশি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাতে দেখার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে যদি বজ্রপাতের শব্দ শুনা যায় তাহলে বুঝতে হবে সেটা আমাদের কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে এবং সেটার দ্বারা আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
আর যদি বিদ্যুৎ চমকানোর ৩০ সেকেন্ড পর শব্দটা আমরা শুনতে পাই তাহলে বুঝতে হবে সেটা আমাদের থেকে দূরে রয়েছে এবং এটার দ্বারা আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে সময় যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ অবস্থানে চলে যাওয়াই উত্তম। বজ্রাঘাতে মানুষে এবং পশু-পাখির প্রাণহানির পাশাপাশি নষ্ট হয় অনেক ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির। সচেতন না হওয়ায় বজ্রাঘাতের ফলে এই ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বজ্রপাতের সময় বাড়ির ভেতর অথবা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করলে বজ্রাঘাতে জীবন যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
তবে বজ্রপাত যদি সরাসরি মানুষের শরীরে পতিত হয় সেক্ষেত্রে মানুষের শরীরে অতিমাত্রায় তড়িৎ প্রবাহ হয় বলেই মানুষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। বজ্রাঘাতে মৃতদের দেহ চুম্বকত্বে আবিষ্ট (মূল্যবান ম্যাগনেটে রুপান্তরিত) হয় এটা আমাদের সমাজের প্রচলিত একটি ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার। অপরদিকে বজ্রপাতের ফলে বজ্রাঘাতে প্রতিনিয়তই বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিকল হচ্ছে।
বজ্রপাত হলেই যে ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের ক্ষতি হবে বিষয়টি সে রকম নয়। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত বৈদ্যুতিক পরিষেবা ড্রপ লাইনে সরাসরি বজ্রপাত হলে বজ্রাঘাতের ফলে ব্যবহৃত সব ধরনের ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ধ্বংস হয়ে যাবে। বজ্রপাতের সময় এসব যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বজ্রপাতের সময় যে পরিমাণ ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস নষ্ট হয় তা অন্য সময় হয় না। এই সময় প্রায়ই লোকজনের ফ্রিজ জ্বলে যায়, টিভি জ্বলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। বিদ্যুৎ-সংযোগে বজ্রপাত ঘটলে আমাদের ডিভাইসগুলো অতিরিক্ত চার্জ গ্রহণ করে অকেজো হয়ে যায়। এ জন্যই ইউপিএস বা স্ট্যাবিলাইজারের মতো যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে আমরা যন্ত্রগুলো সুরক্ষিত রাখতে পারি। বজ্রপাতের সময় যাতে ডিভাইসটি বিদ্যুৎ-সংযোগ করা অবস্থায় না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এ কারণে বজ্রপাতের সময় রাউটার বন্ধ রাখাই ভালো।
শুধু রাউটার কেন, বাকি সব বৈদ্যুতিক যন্ত্র প্লাগ থেকে খুলে রাখা নিরাপদ। একইভাবে বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোনে চার্জ না দেওয়াই ভালো। ল্যাপটপ চালাতে হলে প্লাগ থেকে খুলে নিয়ে ব্যাটারিতে চালানো নিরাপদ। যদি সম্ভব হয় টিভির ডিশ সংযোগও খুলে রাখা দরকার। ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার দিয়ে ফ্রিজ চালানো গেলে ভালো। বজ্রপাতের সময় ঘরের ভেতরে থাকলে স্মার্টফোন ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এই সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখাই ভালো। তবে যদি মারাত্মক আকারে বজ্রপাত হয় সেক্ষেত্রে স্মার্টফোনটি পুরোপুরি বন্ধ রাখাই ভাল। তা না হলে স্মার্টফোনটির তো বটেই যিনি সেটি ব্যবহার করছেন তারও বিপদ হতে পারে। বজ্রপাতের সময় টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল, ল্যাপটপ, ওয়াইফাই’র বৈদ্যুতিক সংযোগ খুলে রাখলেই এগুলোকে নিরাপদ রাখা সম্ভব।
বজ্রপাতের সময় যেকোনও ইলেকট্রনিক ডিভাইস সুরক্ষিত রাখতে বাসা বা অফিসের কাট-আউট নিরাপদ রাখা দরকার। নিয়মিত ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে সংযোগ পরীক্ষা করে নেয়া উত্তম। বজ্রপাতের কারণে যাতে মানুষের এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য কিছু জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বজ্রপাতের আভাস পেলেই কম্পিউটার, রাউটার, টেলিভিশন, ফ্রিজসহ বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির সুইচ অফ রাখা উচিত। বাসার বাইরে থাকার সময়ও বজ্রপাত হতে পারে। তবে সেরকম পরিস্থিতি দেখলে সেক্ষেত্রে বাইরে যাওয়ার আগেই কম্পিউটার, রাউটারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্যের সুইচ অফ করে দিলে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।
বজ্রপাতের কারণে বেশি নষ্ট হয় টেলিভিশন। এর মূল কারণ হলো টেলিভিশনের সঙ্গে ডিশের লাইনের সংযুক্ত থাকে। ফলে কোনো এলাকায় বজ্রপাত হলে ডিশের লাইনের মাধ্যমে সহজেই টিভির ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেকেই কম্পিউটারে টিভি কার্ড ব্যবহার করেন। ফলে বজ্রপাতের সময় ডিশ লাইন সংযোগ থাকায় কম্পিউটারেরও ক্ষতি হওয়াটাও স্বাভাবিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে বজ্রপাতের সময় ডিশের সংযোগটি খুলে রাখা উত্তম। এতে প্রযুক্তিপণ্য গুলো সুরক্ষিত এবং নিরাপদ থাকবে। বজ্রপাতের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাউটার এবং নেটওয়ার্কিংয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলোর। বজ্রপাতের সময় সাধারণত রাউটার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এবং করোনাকালীন সময়ে সংক্রমণের কারণে অনলাইনে ক্লাস করা থেকে শুরু করে পড়াশোনার পাশাপাশি বিনোদনের সবাই চলে ব্রডব্যান্ড লাইন এবং ওয়াইফাই ইন্টারনেটর কানেকশন দিয়ে। এরফলে বেড়েছে ওয়াইফাইয়ের ব্যবহারও। ওয়াইফাই এক ধরনের তারহীন ইন্টারনেট সংযোগ।
এটি কাজ করে রাউটারের সাহায্যে। এই রাউটারে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ-সংযোগে। বজ্রপাতের আভাস পেলে শুধু রাউটারের লাইন বন্ধ করলেই যে রাউটার এবং ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসগুলো সুরক্ষিত থাকবে বিষয়টি আসলে তা নয়। রাউটার থেকে ইন্টারনেট সংযোগের ল্যান কেবলটিও খুলে রাখতে পারলে সেগুলো আরো বেশি নিরাপদে থাকবে । তবে যদি ইন্টারনেট সংযোগে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল ব্যবহার করা হয় তাহলে বজ্রপাতের ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে। কারণ অপটিক্যাল ফাইবার কেবলে ধাতব তারের ব্যবহার হয় না। যতই দিন যাচ্ছে মানুষের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা ততই বাড়ছে। আগে উচ্চবিত্তদের ঘরে নানা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি দেখা গেলেও আজকাল উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও সময়ের প্রয়োজনে বহু বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, যেমন- এসি, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, ডিপ ফ্রিজ ব্যবহার করছেন।
একটি বজ্রপাত ফলে সৃষ্ট বজ্রাঘাত গৃহস্থালি তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎশক্তির ঢেউ পাঠাতে পারে। এর ফলে বৈদ্যুতিক ডিভাইস এবং সার্কিট ধ্বংস হওয়া অসম্ভব নয়। কিছু যন্ত্রপাতি, যেমন টোস্টার, রেফ্রিজারেটর, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এবং মিউজিক সিস্টেমে আইসিসহ সার্কিট বোর্ড থাকে। তাই বজ্রপাত থেকে বাসাবাড়ি এবং অফিসের যন্ত্রাংশ রক্ষা করতে এসব ডিভাইসের মধ্যে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সহ আর্থিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেওয়ার সময় একটা মেইন লাইন থাকে এবং অন্যটি থাকে নিউট্রাল লাইন। এই নিউট্রাল লাইনটা রড বা তার দিয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় যাকে বলে আর্থিং। এটি বজ্রপাতের পর বিদ্যুৎকে নিরাপদে মাটিতে নিয়ে যেতে ব্যবহৃত হয়। বজ্রপাতের কারণে অতিরিক্ত ভোল্টেজ বা কারেন্ট প্রবাহিত হলে আর্থিংয়ের মাধ্যমে তা নিরাপদ পথে মাটিতে নেমে আসে। ফলে বহু মূল্যবান যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।
ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস গুলোর জন্য ভালোমানের মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করো অত্যন্ত অত্যাবশ্যকীয়। যে মাল্টিপ্লাগগুলো সেলফ কন্ট্রোল অটোমেটিক সিস্টেমে বিদ্যুৎ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো ব্যবহার করাই ভালো। ফলে হাই ভোল্টেজ বা বজ্রপাতের সময়ও মাল্টিপ্লাগের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ডিভাইসে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। রাডার বা স্যাটেলাইট থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রেডিও, টেলিভিশন বা ওয়েবসাইটে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়। তবে বর্তমানে নতুন ডিটেকটিভ সেন্সরের মাধ্যমে বজ্রপাতের সুনির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া সম্ভব।
ডিটেকটিভ সেন্সরগুলোতে ধারণ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ১০-১৫ মিনিট আগেই বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানোর মাত্রা জানানো সম্ভব। এছাড়া কোন এলাকায়, কতক্ষণ ধরে বজ্রপাত হয়েছে সে সংক্রান্ত সুষ্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় এই ডিটেকটিভ সেন্সরের মাধ্যমে। বজ্রপাতের সতর্কতামূলক তথ্য পাওয়ার পর তা তাৎক্ষণিকভাবে আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইটের রিয়েল টাইমে প্রচার করার পরে সাথে সাথে এ তথ্য মোবাইল ফোনে এসএমএসের অ্যালার্টের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে একদিকে যেমন মানুষের জীবন বাঁচবে তেমনি বাঁচবে ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস সমূহ।
লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।