
রেলওয়ের পোষ্যরা কি রাষ্ট্রের সন্তান নয়,-দুর্নীতি, নীরব ট্রেড ইউনিয়ন ও একটি লড়াইয়ের ইতিহাস
মনিরুজ্জামান মনির
একটা রাষ্ট্র তখনই তার দায়িত্বশীলতা প্রমাণ করে, যখন সে কৃতজ্ঞতা জানাতে জানে। সেই কৃতজ্ঞতা কখনো ধন্যবাদ জানিয়ে, আবার কখনো তারই সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়ে। বাংলাদেশ রেলওয়ের হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মচারী দীর্ঘ সময় ধরে এই রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সংযুক্তি ও সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আজ, তাঁদের সন্তানদের—পোষ্যদের—অধিকার যদি রাষ্ট্রই অস্বীকার করে, তবে প্রশ্ন ওঠে—রেলওয়ের পোষ্যরা কি এই রাষ্ট্রের সন্তান নয়?
সংবিধান ও পোষ্যদের অধিকার:
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮(৪) ও ২৯(৩)(ঘ) ধারা অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমানভাবে অধিকারপ্রাপ্ত। তবে কিছু গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে সমতা নিশ্চিত করাও একটি সাংবিধানিক বৈধতা। এই ভিত্তিতেই পোষ্য কোটা প্রবর্তিত হয়েছে। রাষ্ট্র তার পূর্বতন কর্মচারীদের স্বীকৃতি দিতে তাঁদের সন্তানদের জন্য কিছুটা অগ্রাধিকার বরাদ্দ করেছে—এটি একটি নীতিগত দায়িত্ব এবং মানবিক স্বীকৃতি।
নিয়োগে দুর্নীতির ভয়াবহতা: একটি উন্মুক্ত রাজনীতি
গত এক দশকে বাংলাদেশ রেলওয়েতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা নজিরবিহীন। ওয়েম্যান, গেইটকিপার, খালাসি, স্টেশন মাস্টার, সুইপার, পোর্টার, লোকো মাস্টার, গার্ড, পয়েন্টস ম্যান, অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক, বুকিং সহকারী—প্রায় প্রতিটি পদে টাকা ছাড়া নিয়োগ ছিল অসম্ভব। কেউ ৭ লাখ, কেউ ১৫, কেউবা ২০-২৫ লাখ টাকা দিয়ে এসব পদে চাকরি পেয়েছে। এটা শুধু চাকরি কেনাবেচা নয়, বরং একটি দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।
পোষ্য কোটা থাকা সত্ত্বেও, বহু পোষ্যকে মেধা ও যোগ্যতা থাকার পরও বঞ্চিত হতে হয়েছে। কারণ তারা ঘুষ দিতে পারেনি বা দুর্নীতির দালালচক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। প্রশ্ন জাগে—এই ব্যবস্থা কি রাষ্ট্রীয় ন্যায্যতা, নাকি একটা সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির চক্র?
ট্রেড ইউনিয়ন: নীরবতা নাকি অংশীদারিত্ব?
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক এখানে অনিবার্যভাবে আলোচনায় আসে—২০১৩ সাল থেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি ধারাবাহিকভাবে পোষ্যদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনে যুক্ত রয়েছে। কোটা সংরক্ষণ, দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ, পোষ্যদের জন্য আলাদা প্রতিযোগিতার সুযোগ—এসব দাবিতে এই সংগঠনের সংগ্রাম নিঃসন্দেহে দৃঢ় ও সময়োপযোগী ছিল।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে রেলওয়ের বড় বড় ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক সংগঠনগুলো এসব বিষয়ে প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থেকেছে। এই নীরবতা কেবল সন্দেহজনক নয়, বরং একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়—দুর্নীতির চক্রব্যূহে শ্রমিক নেতারাও নিজেদের স্বার্থে জড়িত ছিলেন। যখন পোষ্যরা নিজেরাই আন্দোলন করছে, তখন ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নির্লিপ্ততা প্রশ্ন তোলে—তারা আসলে কাদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত?
পোষ্য সোসাইটির একক সংগ্রামের ফলে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হলেও, তাতে নীতি পরিবর্তনের মত কোনো জোরালো রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কারণ, রেলওয়ের অভ্যন্তরে প্রভাবশালী পক্ষগুলো এসব দাবিকে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছে।
বর্তমানে মহাপরিচালক একটি ক্ষমতাহীন প্রতীকী পদ:
বাংলাদেশ রেলওয়ে-একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যার কর্মপরিধি দেশের অর্থনীতি, জনজীবন ও জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। অথচ বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই বিশাল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্মকর্তা-মহাপরিচালক বা ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) —বর্তমানে প্রায় ক্ষমতাহীন একটি প্রতীকী পদে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই পরিবর্তন শুধু একটি পদ নয়, বরং রেলওয়ের সার্বিক দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও কাঠামোগত সক্ষমতার ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
রেলওয়ের প্রশাসনিক কাঠামোর বিবর্তন ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালের পরে পাকিস্তান রেলওয়ের শীর্ষপদ ছিল জেনারেল ম্যানেজার (জিএম)। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ে বোর্ড গঠন করে এবং বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন রেলওয়ের প্রধান নির্বাহী। এরপর ১৯৮৩ সালে সামরিক সরকারের নির্বাহী আদেশে বোর্ড বিলুপ্ত করে মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি করা হয় এবং ডিজি’র হাতে রেলওয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।
এই পরিবর্তনের পেছনে যুক্তি ছিল একটি পেশাদার, দক্ষ এবং কার্যকর নেতৃত্বের মাধ্যমে রেলওয়ের নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। বাস্তবে ডিজি পদটি সচিব পদমর্যাদার একটি স্বাধীন নির্বাহী ক্ষমতা-সম্পন্ন পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রতারণা: যৌথ ব্যবস্থাপনার নামে নিয়ন্ত্রণ হারানো
সম্প্রতি চট্টগ্রাম রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি সেবা সম্প্রসারণের উদ্যোগ বলে মনে হলেও বাস্তবে এটি একটি প্রতিষ্ঠানগত স্বকীয়তা হারানোর শুরু। রেলওয়ের নিজস্ব জনবল, বাজেট ও অবকাঠামো থাকার পরেও কেন বাইরের মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে যেতে হলো?
রেলওয়ের কর্মচারীরা যেখানে নিজেদের স্বাস্থ্যসেবা রক্ষা প্রশ্নের মুখে পড়ছে, সেখানে নিয়োগে পোষ্যদের অধিকার কোথায় থাকবে?
আন্তর্জাতিক নজির: যেখানে পিছু হটেছে দুর্নীতি
বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি নিয়োগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভারত, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকার পরিবর্তন, মন্ত্রী অপসারণ এবং নতুন কমিশন গঠন পর্যন্ত হয়েছে।
ভারতের ২০১৩ সালের “রেলওয়ে নিয়োগ কেলেঙ্কারি” বিষয়ে সিবিআই তদন্ত করে একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণে অনিয়ম ধরা পড়লে পরপর দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করেন।
বাংলাদেশে এখনও এমন কিছু দেখা যায়নি—এটা যেমন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, তেমনি জনগণের সংগঠিত প্রতিরোধের অভাবেরও চিত্র।
পোষ্যদের নীরবতা: আত্মঘাতী অসচেতনতা
এখানে আত্মসমালোচনা জরুরি। রেলওয়ের বহু পোষ্য তাদের অধিকার হারাচ্ছে জেনেও রাজনৈতিক দলে ব্যস্ত, বা দূর্নীতিবাজদের সঙ্গে আঁতাত করে চাকরি নিচ্ছে। তারা ভাবে, “সব কিছু এমনিতেই হবে।” কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে—এই নীরবতা, এই আত্মতুষ্টি একদিন নাগরিক অধিকার হারানোর গ্লানিতে পরিণত হয়।
আপনি যদি নিজেই নিজের অধিকার নিয়ে মাথা না ঘামান, তাহলে রাষ্ট্র আপনাকে গুরুত্ব দেবে কেন?
নতুন রাজনীতি ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের প্রত্যাশা:
বর্তমান সরকার অতীতের অন্যায় এবং দুর্নীতির শুদ্ধি ঘটাবে, এমন প্রত্যাশা জনগণের। রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন নেতৃত্ব যদি সত্যিই রেলওয়েকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চায়, তাহলে তাদের উচিত—
* পোষ্য কোটার স্বচ্ছ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা
* বিগত দিনের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত করে প্রকাশ করা
* দুর্নীতিতে যুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা
* রেলওয়ে পোষ্যদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ স্থাপন
* ট্রেড ইউনিয়নের হিসাব ও ভূমিকা পুনর্মূল্যায়ন
সময় গড়িয়ে গেলে ইতিহাস ক্ষমা করে না:
রেলওয়ে পোষ্যরা রাষ্ট্রেরই সন্তান। তাঁদের প্রতি দায়িত্ব রাষ্ট্রের নৈতিক, সাংবিধানিক ও মানবিক দায়বদ্ধতা। যারা শুধুমাত্র টাকা দিয়ে চাকরি নেয়, তারা যেমন অপরাধী, তেমনি যারা নীরব থেকে এসব দেখে, তারাও কম দায়ী নয়। আর যারা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারা একদিন ইতিহাসে জায়গা করে নেবেই।
সুতরাং এখনই সময়—পোষ্যদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এবং রেলওয়ের ভবিষ্যত রক্ষা করার। নাহলে একদিন হয়তো রেলওয়ে থাকবে, কিন্তু তার প্রাক্তন কর্মচারীদের সম্মান আর সন্তানদের স্বপ্ন থাকবে না।
লেখক:
সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবংসভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন