ডার্ক মোড
Saturday, 05 July 2025
ePaper   
Logo
কোটা কখনো মেধার বিরোধিতা নয় - বরং বৈষম্যহীন অংশগ্রহণের সাংবিধানিক সেতু

কোটা কখনো মেধার বিরোধিতা নয় - বরং বৈষম্যহীন অংশগ্রহণের সাংবিধানিক সেতু

মনিরুজ্জামান মনির

তারেক রহমানের বক্তব্য এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্বের অনিবার্য প্রশ্ন; বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিতর্ক, আন্দোলন ও আদালত পর্যন্ত গড়ানো প্রেক্ষাপট রয়েছে। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে বহু তরুণ রাস্তায় নেমেছে, রক্ত দিয়েছে, চোখ হারিয়েছে। এই আবেগ ও ত্যাগকে সম্মান জানানো জরুরি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে—রাষ্ট্র পরিচালনা আবেগ নয়, দায়িত্ব ও ভারসাম্যের শৈল্পিক প্রয়োগ।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন—

“কোটা কখনো মেধার বিকল্প হতে পারে না। সুতরাং, ছাত্র-তরুণদের কোটাবিরোধী আন্দোলন ন্যায্য। বিএনপি সরকার গঠন করলে তা বাস্তবায়ন করবে।”

এই বক্তব্য প্রথমত রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্তিকর, দ্বিতীয়ত সাংবিধানিকভাবে অসংগত, এবং তৃতীয়ত সামাজিক ন্যায়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সংকট প্রকাশ করে। তারেক রহমান কেবল ছাত্রদের আবেগের সুরে সুর মিলিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কোটা ব্যবস্থা: দায়বদ্ধতার নীতিগত কাঠামো-

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—

“রাষ্ট্র কোন নারী বা শিশু, প্রতিবন্ধী বা অন্য কোন অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বিশেষ অনুকূল অবস্থায় আনয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।”

এই অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে দেয়—কোটা কোনো একক গোষ্ঠীর সুবিধা নয়; বরং এটি একটি বৈষম্যহ্রাসকারী ব্যবস্থা, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের মূলস্রোতে যুক্ত করার সাংবিধানিক পথ।

বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও কোটা Affirmative Action হিসেবে স্বীকৃত। এটি মেধার প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক। প্রতিযোগিতায় যারা শুরুতেই পেছনে থাকে—তাদের সামনে আনার জন্যই এই ব্যবস্থা।

পোষ্য ও প্রতিবন্ধীদের অধিকার রাষ্ট্রের প্রতি মানবিক ঋণ:

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৭৫ বছরের পুরনো পোষ্য কোটা একরকম অঘোষিতভাবে বাতিল করা হয়েছে, কোনো বিকল্প বা মূল্যায়ন ছাড়াই। অবসরপ্রাপ্ত, প্রয়াত এবং কর্মরত রেলওয়ে কর্মচারীদের সন্তানরা যে ত্যাগ ও শ্রমে এই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতকে টিকিয়ে রেখেছে, সেই ঐতিহাসিক অবদানের বিনিময়ে তাদের জন্য একটি মানবিক ব্যবস্থা থাকা উচিত।

আমরা বলছি—

• রেলওয়ে পোষ্য কোটা সংরক্ষণ করতে হবে;

• কোটাভিত্তিক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে;

• প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য বিশেষ নিয়োগ ব্যবস্থা ও অ্যাকসেসিবিলিটি অডিট চালু করতে হবে।

এই দাবিগুলো কোনো বিশেষ সুবিধা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়।

তারেক রহমানের বক্তব্য: রাজনৈতিক কৌশল না রাষ্ট্রদর্শন?

তারেক রহমান যেভাবে কোটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তাতে প্রশ্ন উঠেছে—তিনি কী সত্যিই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন, নাকি কেবল জনতুষ্টির পথে হাঁটছেন?

তিনি যে বিষয়গুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন, তা হলো—

• প্রতিবন্ধী, নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পোষ্যদের বাস্তবতা;

• কোটা বাস্তবায়নে গঠনতান্ত্রিক ন্যায্যতা;

• নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও দলীয়করণের আসল চিত্র।

এই বক্তব্য রাজনীতি হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রনায়কোচিত নয়।

চাকরির মূল সমস্যা: কোটা নয়, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি:

বাংলাদেশে চাকরির আসল সংকট হলো— ঘুষনির্ভর নিয়োগ ব্যবস্থা, দলীয় প্রভাব ও তদবির সংস্কৃতি,অদৃশ্য ক্ষমতাধরদের ‘নির্বাচিত কোটা’।

এই বাস্তবতায় কোটা তুলে দিলে প্রান্তিকরা আরও পিছিয়ে পড়বে এবং শুধু মুষ্টিমেয় সুবিধাপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ ভোগ করবে। তাই কোটা সংস্কার নয়, কোটা বাস্তবায়নে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা দরকার।

তরুণদের সঙ্গে দ্বৈত সত্যে দাঁড়ানো জরুরি:

আজকের তরুণ চায়—

• মেধার মূল্যায়ন হোক,

• প্রতিযোগিতা হোক স্বচ্ছ,

• নিয়োগ হোক দুর্নীতিমুক্ত।

কিন্তু সে এটাও চায়—

• তার প্রতিবন্ধী ভাই কাজ পাক,

• রেলওয়ে কোয়ার্টারে বড় হওয়া মেয়েটিও সুযোগ পাক,

• মুক্তিযোদ্ধার সন্তানটি রাষ্ট্রে সম্মান পাক।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো—এই দুই চাওয়ার মাঝে সেতু গড়ে তোলা।

আমাদের অবস্থান: দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চাই- বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির পক্ষ থেকে আমরা বলছি—“কোটা নয়, অব্যবস্থাপনাই মেধার আসল শত্রু।

সংরক্ষণ নয়, দুর্নীতিই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।

আমরা চাই—,নিয়োগে স্বচ্ছতা,কোটায় সুবিন্যস্ত বাস্তবায়ন, মেধা ও সামাজিক ন্যায়ের সমন্বয়”

এটাই একটি মানবিক, ন্যায্য, আধুনিক রাষ্ট্রের ন্যূনতম শর্ত।

নেতৃত্ব মানে দায়বদ্ধতা,আবেগ নয়:

তারেক রহমান দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকলেও, দেশের তরুণরা তাদের চোখ হারিয়েছে, পা হারিয়েছে, রাস্তায় নেমেছে।

তাঁদের ত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে হলে কেবল আবেগ নয়—সংবিধান, বাস্তবতা ও অন্তর্ভুক্তির দর্শনে দৃঢ় থাকতে হয়।

কোটা বিলুপ্তি নয়, বরং তার ন্যায্য বাস্তবায়ন ও সংস্কারই সময়ের দাবি।

আজকে যদি নেতারা জনতুষ্টির মোহে পড়ে প্রান্তিকদের কণ্ঠ রুদ্ধ করেন—তবে কাল ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।

 

মনিরুজ্জামান মনির

সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন