পরিবেশ রক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারের গুরুত্ব
মোঃ জাহিদুল ইসলাম
প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দ্রুতগতির সাথে এগিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতা। এর ফলে সহজ হচ্ছে বিশ্বের মানুষের দৈনন্দিক জীবন। পরিবেশ দূষণ পৃথিবীর সব দেশেরই একটি অভিন্ন সমস্যা। এই দূষণ রোধে বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের সম্মেলন, সেমিনার, চুক্তি করছে। বিজ্ঞানীরা সব সময় পরিবেশ বান্ধব বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকেও তাগিদ দিচ্ছেন। এদিকে পরিবেশ দূষণের ফলে দিন দিন আমাদের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
এই অনিশ্চয়তার জন্য বিশেষ করে বিশ্বের ধনী দেশগুলো বেশি দায়ী। তবে এই পরিবেশ দূষণের নেতিবাচক প্রভাব থেকে কোনো দেশেরই মুক্ত নয়। সুতরাং পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকতে হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাটা জরুরি। আর তা না পারলে পৃথিবী থেকে আমাদের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। আমাদের সবারই পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী ভূমিকা রাখা খুবই প্রয়োজন। প্রতিদিন আমরা বিভিন্নভাবে পরিবেশ ধ্বংস করছি। প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের মাটি এবং বিশাল জলরাশিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রাণিকুল এবং মানব প্রজাতিও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জন করি তার খুব কম পরিমাণই পুনর্ব্যবহার করা হয় অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়। বেশিরভাগ প্লাস্টিকই মাটিতে জমা হয়। ক্ষতিকর এই প্লাস্টিকই যা ক্ষয় হতে ১০০০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ও নির্মল পরিবেশ প্রত্যাশা করি সেক্ষেত্রে এখনই পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প ব্যবহার করতে হবে। ভূমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। সবুজ বৃক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উৎস ।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের এই সবুজ প্রকৃতি মানুষের দ্বারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যত্রতত্র কাটা হচ্ছে গাছ। কিন্তু সে তুলনায় যা লাগানো হচ্ছে তা প্রয়োজন এবং পরিবেশের চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। তাই আমাদের সবার উচিত বাসার বারান্দায়, ছাদে যতটুকু সম্ভব, যাবতীয় দেশি গাছ লাগিয়ে চারপাশের প্রকৃতিকে সবুজে সবুজময় করে তোলা। পরিবেশ রক্ষায় গাছের বিকল্প নেই। প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে এবং তা করতে হবে এখনই। মানুষের বেঁচে থাকার উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু।
মানুষের বেঁচে থাকার উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু। মানবসৃষ্ট বহুবিধ কারণে বাতাস তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমছে। ভয়াবহ এই দূষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন ও কাজের সময় ঢেকে রাখা, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইটভাটি বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা, প্রচুর গাছ লাগানো, ছাদ বাগান তৈরি করা, সবুজ প্রযুক্তিতে উৎসাহিত করা, জলাধার সংরক্ষণ ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরী। এদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশে বায়ুর গুণগত মান সঠিক রাখার জন্য প্রযুক্তিবিদরাও কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত।
এগুলো সবুজ প্রযুক্তি বা গ্রিনটেক, এনভায়রনমেন্টাল বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি নামে পরিচিত। এসব জৈবপ্রযুক্তি দূষিত পরিবেশের (বায়ু, পানি, ভূমি) প্রতিকারে অসম্ভব ভূমিকা রাখছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের তৈরি নিজস্ব সফটওয়্যার দিয়ে এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং করে থাকে। গুগল ম্যাপে সারাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গার এয়ার কোয়ালিটি দেখার সুযোগ আছে সবার জন্য। যার মাধ্যমে বাতাস, পানি ও মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, দূষণের মাত্রা ইত্যাদি তাৎক্ষণিক বোঝা যায়। এসব ডিভাইস ব্যাপক হারে উৎপাদন করতে পারলে কৃষক সমাজের উপকার হবে অবশ্যই। প্রতিনিয়ত বাড়ছে প্রযুক্তি সামগ্রীর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা। এতে ব্যাপক শক্তি ক্ষয়ের পাশাপাশি পরিবেশ নানা ধরনের বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে। ই-বর্জ্য ও অতিমাত্রায় প্রযুক্তির ব্যবহারে ঝুঁকিতে পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে এসব প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারও হয়ে উঠবে পরিবেশবান্ধব। পুরোনো ডিভাইস প্রযুক্তির মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে প্রযুক্তিপণ্য সমূহকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে রূপান্তর করতে হবে। ই-বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্কাশন করাতে হবে। ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে মূলত পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম কিংবা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি বোঝায়। যেমন পরিত্যক্ত কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, পুরোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ, হেয়ার ড্রায়ার, আয়রন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ইত্যাদি। নিষ্কাশনের আগে ই-বর্জ্য অন্যান্য বর্জ্য থেকে আলাদা করে নিতে হবে। কারণ এতে অনেক বিষাক্ত পদার্থ ও ধাতু থাকে।
এই বিষাক্ত উপাদানগুলো মানবদেহ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। যেমন পরিত্যক্ত কম্পিউটারের সিপিইউর মতো কিছু কিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি ক্ষতিকর পদার্থ থাকতে পারে। এই পদার্থ মানুষের শরীর ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই এগুলো বিশেষভাবে নিষ্কাশন করা জরুরি। এদিকে পানি দূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা। উন্নত বিশ্বে পানি এবং বর্জ্য পানি শোধনে স্বয়ংক্রিয়করণ ব্যবস্থা একটি সাধারণ বিষয়। বর্জ্য জল শোধন হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া যা বর্জ্য বা নর্দমার ময়লা জল থেকে দূষণকারী উপাদানগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপসারণ করে এবং পানিকে বিশুদ্ধ রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
এছাড়াও বায়োটেকনোলজি বা জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব সহজে ও অল্প খরচেই পানি পরিশোধন করা যায়। মূলত পানি শোধন হচ্ছে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট ব্যবহার শেষে পানিকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এর গুণগত মান আরো উন্নত করা। অপরদিকে ২০ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা হলে আমরা সেটি শুনতে পাই এবং এর কম মাত্রা হলে শুনতে পাই না। আমরা ২০ থেকে ২০ হাজার হার্জ পর্যন্ত শব্দ শুনতে সক্ষম। কিন্তু শব্দের মাত্রা এর চেয়ে বেশি হলে আমাদের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ যে শব্দ শ্রবণশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সেটিই শব্দদূষণ। শব্দদূষণের কারণে দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ শ্রবণশক্তির সমস্যায় ভুগছে।
সব জায়গাতেই শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যায়। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্পকারখানা এবং পাইলিংয়ের কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিক্সার যন্ত্র, ড্রিল মেশিন ইত্যাদির যথেচ্ছ ব্যবহার প্রতিনিয়ত শব্দদূষণের মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। শব্দদূষণের বর্তমান পর্যায়কে ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ নামে অভিহিত করা হয়। দিন দিন বেড়েই চলেছে শব্দদূষণ। তবে এই শব্দ দূষণ হতে মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বের প্রযুক্তিবিদরা বসে নেই। শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যাপারে তারা বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
বাইরের অবাঞ্ছিত শব্দগুলো ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুনির্দিষ্ট শব্দতরঙ্গ আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য তৈরি করে অবাঞ্ছিত শব্দকে ভবনের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া থেকে বিরত রাখার প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হচ্ছে। রাস্তার কোলাহল, যানবাহনের তীব্র আওয়াজ মাইক্রোফোনে রেকর্ড করে তার সঙ্গে সংগীতের মূর্ছনা মিশিয়ে শ্রুতি মধুর শব্দ তৈরি করে শব্দ দূষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে।
প্রযুক্তি বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে মানুষের জীবনকে নিরাপদ, উন্নত ও আরামদায়ক করেছে। প্রযুক্তি আবার নানারকম সমস্যাও সৃষ্টি করছে। আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে ভয়াবহ প্রয়োগ হলো যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি ও এর ব্যবহার। এছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কয়লা পুড়িয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করি কিন্তু এর ফলে বায়ুও দূষিত হয়। বায়ু দূষণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও এসিড বৃষ্টির মতো পরিবেশের উপর বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করছে। রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক অধিক খাদ্য উৎপাদনে সাহায্য করে। এগুলো ব্যবহারের ফলে আবার মাটি এবং পানি দূষিত হয় যা জীবের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে মানবসভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু একইসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি আশঙ্কাজনক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে পরিবেশ দূষণ, বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে পৃথিবী। এই সমস্যার সমাধানেও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।
লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।