ডার্ক মোড
Tuesday, 03 December 2024
ePaper   
Logo
তথ্য প্রযুক্তির যুগে রাডারের ভূমিকা

তথ্য প্রযুক্তির যুগে রাডারের ভূমিকা

মোঃ জাহিদুল ইসলাম

রাডার (রেডিও ডিটেকটিং অ্যান্ড রেঞ্জিং) বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি অসাধারণ যন্ত্র। রাডার কোনো একটি নির্দিষ্ট দিকে শক্তিশালী, উচ্চ কম্পাঙ্কের রেডিও ওয়েভ (বেতার তরঙ্গ) সঞ্চারিত করে। এরপর ঐ তরঙ্গগুলোর আওতায় কোনো বস্তু যেমন- জাহাজ বা বিমান আসলে এ তরঙ্গগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়, প্রতিফলনের মাধ্যমে ফিরে আসে রাডারে। এর মাধ্যমে রাডার বস্তুর উপস্থিতি নিশ্চিত করে।

শুধু উপস্থিতিই নয়, রাডার আগমনকারী বস্তুর দূরত্ব,গতিবেগ, কৌণিক দূরত্বও নির্ণয় করতে পারে। রাডার এ কাজটি করে রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে। রাডারে রেডিও তরঙ্গ তৈরি হওয়ার পর অ্যানটেনার সাহায্যে (যা ট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করে) তরঙ্গকে সামনের স্পেসের দিকে ছুঁড়ে দেয়। রাডারটি সর্বদা ঘুরতে থাকে যাতে একটি বড় এরিয়া থেকে আসা প্রতিফলনকে সে ধরতে (অর্থাৎ রিসিভ) পারে। রাডার থেকে ছড়িয়ে পড়া রেডিও তরঙ্গ আলোর গতিতে ছুটতে থাকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত সে কারো সাথে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ততক্ষণ এটি ছুটতে থাকে।

কোনো বস্তুর সাথে বাধা পাওয়ার পরে প্রতিফলন হওয়া রেডিও তরঙ্গ আলোর গতিতে আবার রাডার ফিরে আসে। এই ফিরে আসা তরঙ্গকে গ্রহন অর্থাৎ রিসিভ করে এটা বোঝা যায় যে বস্তু থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রেডিও তরঙ্গটি ফিরে এসেছে সেটা কতটা দূরে এবং কি অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ ফিরে আসার তরঙ্গ থেকে বাধা প্রাপ্ত বস্তুটির সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করা যায়। প্রতিফলিত হয়ে আসা বেতার তরঙ্গ বেশ দুর্বল হলেও একে ইচ্ছামত বিবর্ধিত করা যায়। এ কারণেই রাডার অনেক দূরের বস্তুকেও বিকিরণের মাধ্যমে চিহ্নিত করতে পারে।

এই রাডারের সাহায্যে ঘন অন্ধকার রাতেও দূরের বস্তুকে লক্ষ্য করা যায়। এজন্য রাডার উড়োজাহাজের পাইলট কিংবা সামুদ্রিক জাহাজের ক্যাপ্টেনের তৃতীয় নয়ন হিসেবেও পরিচিত। আমরা পৃথিবীতে থাকা যেকোনো বস্তুকে দেখতে পাই আলোর কারণে। এই আলো সূর্য থেকে আসে এবং বস্তু থেকে প্রতিফলন হয়ে আমাদের চোখে এসে ধরা দেয়। আলোর প্রতিফলনের সময় এবং আলোর প্রতিফলনের মাত্রা থেকে আমাদের মস্তিষ্ক সহজেই বুঝতে পারে। এর ফলশ্রুতিতে কোনো বস্তু থেকে আমরা ঠিক কতটা দূরে রয়েছি তা অনুমান করতে পারি। সেই অনুযায়ী আমরা যে কোনো বস্তু সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি।

রাডার প্রযুক্তি অনেকটা এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই কার্য সম্পাদন করে। এদিকে রাডার স্টেশন হল এক ধরনের মিনি সাইজের বেতার কিংবা টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্রের মতো। এই কেন্দ্র থেকে আকাশে বেতার তরঙ্গ নিক্ষেপ করা হয়। রাডারে যে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় তা উৎপন্ন হয় একটি যন্ত্রাংশ দ্বারা যার নাম “ম্যাগনেট্রন“। রেডিও তরঙ্গ এবং আলো একই গতিতে পথ অতিক্রম করতে পারে। রাডার যেহেতু রেডিও ওয়েভ ব্যবহার করে তাই রাতের আঁধার হোক বা প্রতিকূল আবহাওয়া হোক এতে রাডারের কোনো সমস্যা হয় না। যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও রাডারের ব্যবহার অনেক।

বিমান পাইলটরা বিমান ছাড়ার সময়, বিমানে থাকা কালীন সময় এবং বিমান ল্যান্ড করার সময় এটি ব্যবহার করে। এছাড়াও আবহাওয়ার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা, অনেক দূরের বা কাছের জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুসমূহের পৃষ্ঠতল এবং বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে জানতে, সমুদ্রে অন্য জাহাজ বা সমতল ভূমির অবস্থান বের করা ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয় এই প্রযুক্তিটি। এমন কি পৃথিবীর এবং অন্য গ্রহ-উপগ্রহের মানচিত্র পেতে, স্যাটেলাইট এর অবস্থান জানতে নাসাও রাডার ব্যবহার করে।

এদিকে স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রাডার প্রযুক্তি হলো একজন অন্যজনের পরিপূরক। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার এই প্রযুক্তিদ্বয় একে অপরের বিকল্প নয়। তাই একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির ওপর নির্ভর করে ভালো তথ্য পাওয়া যাবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যখন কোন এক স্থান হতে অধিক দূরত্বে একটি শক্তিশালী সাইক্লোন সৃষ্টি হয় আঘাত হানার জন্য। তখন অধিক দূরত্বের সেই সাইক্লোনটির সম্ভাব্য আকার, আকৃতি পরিধি এবং ভূপৃষ্ঠের এর অবস্থানের বিস্তারিত ট্রেস (সনাক্ত) করে দেবে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাডার নয়। আবার সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়টি যখন আঘাত হানার জন্য নির্দিষ্ট স্থানের কাছাকাছি স্থানে চলে আসবে তখন সেটি রাডার ট্রেস করবে, স্যাটেলাইট না।

অর্থাৎ, প্রাথমিক পর্যায় স্যাটেলাইট তথ্য দেবে। আর পরবর্তীতে রাডার সেটার বিস্তারিত তথ্য দেবে। পরিপূর্ণ তথ্য দেওয়ার জন্য প্রযুক্তিদ্বয় একটি অন্যটির হাত ধরে পাশাপাশি চলমান অবস্থায় থাকে। রাডার হতে নির্গত আলোক শক্তি বৃষ্টির পানি কিংবা জ্বলীয় বাষ্পের কণা হতে প্রতিফলিত হয়ে রাডারের রিসিভারে ফেরত আসে। মেঘের অবস্থিত পানির কণা বা ফোটা যত বড় হয় সেগুলোতে আঘাত করে তত বেশি প্রতিফলিত বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ রাডারে ফিরে আসে ও রাডারে প্রতিফলিত শক্তির পরিমাণ বেশি হয়।

এভাবে আবহাওয়া রাডার ব্যবহার করে বৃষ্টিপাতের পরিমান, কালবৈশাখি ঝড় এর কারণে শীলা বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ও ঘুর্নিঝড় প্রবাহের দিক নির্দেশ নির্নয় করা যায়। মূলত এই রাডার প্রযুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই বিকশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এই রাউটার প্রযুক্তি ব্যবস্থা খুব অল্প সময়ের মধ্যে হয়ে উঠেছিল আকাশ যুদ্ধের সবচেয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারগুলোর মধ্যে একটি। রাডারের মাধ্যমে শত্রুদলের যুদ্ধবিমানের দিক সহ নির্দিষ্ট অবস্থান চিহ্নিত করা যাওয়ার কারণে সেই অনুসারে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও নেয়া সম্ভব হয়।

রাতের আঁধারে বা প্রতিকূল আবহাওয়ায় আক্রমণের ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তুর সঠিক অবস্থানের নির্দেশনাও পাওয়া যায় রাডার থেকে। আক্রমণ বা রক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই রাডারের ভূমিকা অপরিহার্য।

লেখক, নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন