ডার্ক মোড
Sunday, 08 September 2024
ePaper   
Logo
সোনালী ব্যাংকের দেড় হাজার কোটির অনিয়ম

সোনালী ব্যাংকের দেড় হাজার কোটির অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিনিধি

দুর্বল আর্থিক ভিত্তির প্রতিষ্ঠানে প্রিমিয়াম প্রদান করে নিয়ম লঙ্ঘন করে প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয় এবং প্লেসমেন্ট শেয়ার পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সোনালী ব্যাংকের ৪২৩ কোটি টাকা ক্ষতি করা হয়েছে। এ ছাড়া সহযোগী প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকৃত দায় থাকা সত্ত্বেও মঞ্জুরিপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে এবং পর্যাপ্ত সহায়ক জামানত না নিয়ে ঋণ বিতরণের ফলে মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত মেয়াদোত্তীর্ণ অনাদায়ি ঋণ রয়েছে ৪৫৭ কোটি টাকা। খাসজমি বন্ধক রেখেও দেওয়া হয়েছে ঋণ।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের বিরুদ্ধে এ রকম ১ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম পেয়েছে নিরীক্ষা বিভাগ। গত বুধবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ব্যাংকটির ২০২৩ সালের হিসাব সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এই অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় কর্তৃক ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত দুর্বল আর্থিক ভিত্তির প্রতিষ্ঠানে প্রিমিয়াম প্রদান করে অনিয়মিতভাবে প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয় এবং প্লেসমেন্ট শেয়ার পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করেছে ৫০০ কোটি টাকা। বিনিয়োগ নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সোনালী ব্যাংক এলসির পরিচালনা পর্ষদের ৬৬২তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের অনুকূলে প্রাইভেট প্লেসমেন্ট শেয়ারে প্রজেক্ট এসভিপির মাধ্যমে প্রতিটি শেয়ার ৫৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ৬৫ টাকা (অভিহিত মূল্য ১০ টাকা) দরে মোট ৭ কোটি ৬৯ লাখ ২৩ হাজার ১০০টি শেয়ারে ৫০০ কোটি ১ হাজার ৫০০ টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদন এবং ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর তা বিতরণ করা হয়। বেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের ২০১৯ সালের ৩০ জুনের অথরাইজ ক্যাপিটাল ১ হাজার কোটি টাকা কিন্তু পেইড আপ ক্যাপিটাল মাত্র ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা এবং বহিঃদায়ের পরিমাণ ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। ফলে প্রতিষ্ঠানের ফাইন্যান্সিয়াল লিভারেজ অত্যন্ত বেশি এবং বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ব্যাংকের আমানতকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে।

অথচ ২০১৭ সালে সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৫০৯তম সভায় প্রকল্পের মুনাফা ঋণাত্মক এবং দাখিলকৃত আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী প্রকল্পটি লাভজনক নয় বিবেচনা করে বিনিয়োগ প্রস্তাবটি অনুমোদনে অসম্মতি জানানো হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৫ কোটি ৮৬ লাখ শেয়ার এবং অবশিষ্ট ২৬ কোটি ৩৩ লাখ শেয়ার অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে বিক্রয় করা হলেও দুর্বল আর্থিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে অভিহিত মূল্যের অতিরিক্ত ৫৫ টাকা করে প্রিমিয়াম প্রদান করে প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগ করায় ব্যাংকের ৪২৩ কোটি ৭ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা বিভাগকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডস সার্কুলার অনুসরণ করে শেয়ার মূল্য ৮২ দশমিক ৯৭ টাকায় দাঁড়ায় যা কনজারভেটিভ অ্যাপ্রোস অনুসরণ করে ৬৫ টাকায় নির্ধারণ করা হয়। আবেদনকালে পূর্বের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাফেয়ার্স ৮ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন উল্লেখ থাকলেও আবেদন বিবেচনাকালীন সময়ে পেইড আপ ক্যাপিটাল ৫৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। সবশেষ ব্যালেন্স শিট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির পেইড আপ ক্যাপিটাল ৮৭০ কোটি টাকা, বহিঃদায় ১ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানের জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয় মন্তব্য করে নিরীক্ষা বিভাগ বলেছে প্লেসমেন্ট শেয়ার ক্রয়ের সময় তার পেইড আপ ক্যাপিটাল ও বহিঃদায় বিবেচ্য বিষয় ছিল, পরবর্তী সময়ে ব্যালেন্স শিটে আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন নতুন মূল্যায়নে প্রয়োজনীয়।

প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে ক্রয় করা হয়েছে। ফলে ব্যাংক কর্তৃক অতিরিক্ত দরে ক্রয় করায়, অস্বাভাবিক রিভ্যালুয়েশন রিজার্ভকে বিবেচনায় নেওয়া, পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে ব্যর্থ এবং মঞ্জুরিপত্রের শর্ত পরিপালন না করায় ব্যাংকের আমানতকে ঝুঁকির মধ্যে রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে বন্ধকী সম্পত্তির মালিকানা নিশ্চিত না হয়ে সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ক্যান্টনমেন্ট করপোরেট শাখা সিনহা মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অনুকূলে আইডিসিপি ও চলতি মূলধন ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করায় মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত ব্যাংক অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের আশুলিয়া ভূমি অফিস থেকে জানানো হয় যে, সিনহা মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বন্ধকী সম্পত্তির দাগ নং সিএস ও এসএ ৬৩২ এর আরএস ১১৯০, ১১৯১, ১১৯২ দাগের ৭ দশমিক ২৭ একর সরকারি খাসজমি আছে যার মধ্যে ১০৬ শতাংশ ভূমি বন্ধক নিয়ে ওই ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ওই দাগগুলোয় সরকারি সম্পত্তি থাকায় ঋণ বিতরণ পরবর্তী সময়ে ওই জমির খাজনা খারিজ করা যায়নি। ওই সম্পত্তির প্রকৃত মালিকানা নিশ্চিত না হয়ে ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংক পাওনা আদায়ের জন্য গ্রাহককে চূড়ান্ত নোটিস প্রদান করলেও টাকা পরিশোধের জন্য গ্রাহক এগিয়ে আসেননি।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা বিভাগকে জানানো হয়েছে, টাকা আদায়ের জন্য গ্রাহকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি অর্থঋণ আদালতে নিষ্পত্তি হয়। চেক ডিজঅনার হওয়ায় গ্রাহকের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্টে মামলা চলমান রয়েছে। অন্যদিকে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড নিউ মার্কেট শাখায় ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে মঞ্জুরির শর্ত পরিপালন না করে ঋণ বিতরণ করায় মেয়াদোত্তীর্ণ ৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিজনক অনাদায়ি ঋণ রয়ে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাহক এমএস স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড, মেসার্স এমএস অর্গানিক ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং এসআরএফ এন্টারপ্রাইজের কাছে এই টাকা অনাদায়ি থাকলেও মঞ্জুরিপত্রের শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক কর্তৃক ঋণ গ্রহীতা কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। প্লেস ও সিসি (হাইপোঃ) ঋণে কোনোরূপ নীতি পরিপালন না করে উত্তোলন সুবিধা দেওয়া হয় এবং প্লেজ গুদামের ওপর ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পূর্বে প্রদত্ত প্রকল্প ঋণের পারফরমেন্স যাচাই না করে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে শাখা ব্যবস্থাপক ও প্রধান কার্যালয়ের যোগসাজশে একই গ্রাহককে ক্রমাগত নতুন ঋণ প্রদান করায় ২০২১ সালে গ্রাহকের কাছ থেকে ৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ ক্ষতিজনক অনাদায়ি ঋণ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা বিভাগকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে-এমএস স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড, মেসার্স এমএস অর্গানিক ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং এসআরএফ এন্টারপ্রাইজের বকেয়া আদায়ে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিচালনা পর্যদ সভার সিদ্ধান্ত না মেনে স্ট্রেস টেস্টিংয়ে রেড জোন এবং দুর্বল আর্থিক পারফরমেন্স থাকা সত্ত্বেও ফান্ড প্লেসমেন্ট ও কল লোন খাতে বিনিয়োগ করায় ব্যাংকটির মেয়াদোত্তীর্ণ অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ৬০ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ ছাড়া গুদামে পাটের ঘাটতি, পাট বিক্রয় করে ব্লকড ঋণ হিসেবে জমা না রাখা এবং বন্ধকীকৃত সম্পত্তির অতিমূল্যায়নপূর্বক ঋণ বিতরণের ফলে অনাদায়ি ঋণ হয়েছে ৬৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ভূমি অতিমূল্যায়িত করে প্রকল্প ঋণ ও নতুন সহায়ক জামানত না নিয়ে চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ এবং পুনঃতফসিল মঞ্জুরি অনুযায়ী ঋণের অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকের ক্ষতিজনক অনাদায়ি ১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং অনিয়মিতভাবে পুনঃতফসিল সুবিধা প্রদান পরবর্তী সময়ে শর্তানুযায়ী অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় ব্যাংকের মেয়াদোত্তীর্ণ অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ৩৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্লেজ গুদামে পাটের ঘাটতি রেখে ব্লক ঋণ মঞ্জুর এবং যথাসময়ে কিস্তি আদায় না করায় অনাদায়ি ১৭২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, এসবিআরএসএস এবং সঞ্চয়পত্র হিসাব চালু রেখে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়মিতভাবে লভ্যাংশ প্রদানের মাধ্যমে কর্মচারী গৃহনির্মাণ ঋণের মাসিক কিস্তি পরিশোধের সুবিধা দেওয়ায় আর্থিক ক্ষতি ৪২ কোটি ৫১ লাখ টাকা।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, উন্নত দেশে অনিয়ম ধরা পড়লে কোনো রক্ষা নেই। কিন্তু আমাদের এখানে অনিয়ম ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক তেমন কোনো শাস্তি হয় না। ঋণখেলাপিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ বিদেশে ঋণখেলাপিরা পেট্রোল কিনতে পারেন না, এমনকি বিমানেও চড়তে পারেন না। আর আমাদের এখানে তার উল্টো, তারা ভিআইপি মর্যাদা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। এই সংস্কৃতি বন্ধ করতে না পারলে ব্যাংক সেক্টরের আর্থিক অনিয়ম বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পরিচালনার সঙ্গে জড়িত দায়ীদেরও ছাড় দেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে ব্যাংক পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি সব ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে। দেশে যথেষ্ট নিয়মনীতি থাকলেও তা যথাযথভাবে পরিপালন করা হয় না বলেই সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দুর্নীতি ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় অনিয়ম লাগামহীন হয়েছে। এর ফলে আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট বেড়ে চলেছে। দুর্নীতি ও ঋণখেলাপির মতো অনিয়মের কারণে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বোঝা। ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন