ভুয়া বিল-ভাউচারে সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন আশরাফুন্নেছা
নিউজ ডেস্ক
ডেইলি খবর ডেস্ক: ভুয়া বিল-ভাউচারে সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। চক্রের সদস্যরা দশ টাকা দামের বলপেন ৮০ টাকা, লেখার ২০ টাকার প্যাড ৭০ টাকা, ৩৭০ টাকার ব্যাগ এক হাজার ৫০ টাকা। অবিশ্বাস্য এই কেনাকাটা হয়েছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সচেতনতামূলক কর্মশালার নামে। অধিদপ্তরের পরিচালক (আইইএম)আশরাফুন্নেছা কেনাকাটার এই ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন সাত কোটি টাকা। সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলোর সাথে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, ইনফরমেশন এডুকেশন অ্যান্ড মোটিভেশন (আইইএম) ইউনিট থেকে সারাদেশে ৪৮৬টি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উপজেলা পর্যায়ে এই কর্মশালা বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে শুধু কাগজে-কলমে। অফিসে বসেই তৈরি করা হয়েছে কর্মশালার নথিপত্র। ‘স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য,পুষ্টি ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে অবহিতকরণ’ এসব কর্মশালায় অস্তিত্বহীন দোকান, হোটেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করা হয়েছে। এভাবে প্রকল্পের সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন আশরাফুন্নেছা। গত ৩১ ডিসেম্বর ছিল আশরাফুন্নেছার শেষ কর্মদিবস। সেদিন তিনি বলেন, ‘দুদকে আমি আমার সব ধরনের কাগজপত্র জমা দিয়েছি। বক্তব্যও দিয়েছি। অভিযোগ যথার্থ নয়। বরং আইইএম ইউনিটে দুর্নীতির যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল,সেটি আমি ভেঙেছি। তারাই আমার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
জানা গেছে,বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ তদন্ত করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে ভুয়া কর্মশালা,প্রশিক্ষণ কর্মসূচির নামে জাল বিল-ভাউচারে অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। দুদক উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো:সালাহউদ্দিন ইতোমধ্যে আশরাফুন্নেছাকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন।
আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে বিএফআইইউ এরই মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠিয়েছে। দুদক প্রতিবেদনটি খতিয়ে দেখছে। তার ব্যাংক হিসাব চেয়ে দেশি-বিদেশি সব তফসিলি ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়,মৌলভীবাজারে একটি ওয়ার্কশপের নামে খাবারের বিল দেখানো হয়েছে ‘শামপান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ক্যাটারিং’ থেকে। স্টেশনারি জিনিসপত্র ক্রয় বিল দেখানো হয়েছে ‘আঁচল পেপার স্টেশনারি অ্যান্ড লাইব্রেরি’ থেকে। পরে অধিদপ্তরের একটি টিম বিলগুলো যাচাই করতে গিয়ে ওই রেস্টুরেন্ট ও স্টেশনারির অস্তিত্ব পায়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুই বছর আগে আইইএম ইউনিট থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভয়েস ক্লিপ প্রস্তুত করে সেটি এক কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহককে পাঠানোর কাজ ‘কবির এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছিল। কাজ বাবদ প্রতিষ্ঠানটিকে বিল পরিশোধ করা হলেও ভয়েস ক্লিপটি এখন পর্যন্ত প্রস্তুত করা হয়নি। এ ছাড়া আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঠিকাদারকে ভুয়া কাজের কোটেশন দিয়ে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ওই সব অনিয়ম, দুর্নীতিতে আশরাফুন্নেছার মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা আছে কিনা, তা তদন্ত করেছে বিএফআইইউ।
আশরাফুন্নেছার ব্যাংক লেনদেন: ব্র্যাক ব্যাংকের একটি সঞ্চয়ী হিসাবে ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা জমা হয়েছে। উত্তোলন করা হয়েছে ২৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা। ২০১১ সালের ২৫ আগস্ট জনতা ব্যাংকে খোলা একটি সঞ্চয়ী হিসাবে প্রতি মাসে এক থেকে তিন লাখ টাকা জমা ও উত্তোলন করা হয়। একটি মাসিক সঞ্চয়ী স্কিমে চার লাখ ৭৩ হাজার টাকার স্থিতি পাওয়া গেছে। একটি ফিক্সড ডিপোজিট হিসাবে পাঁচ লাখ ২৭ হাজার টাকার স্থিতি পাওয়া গেছে। তিন লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে। ওয়ান ব্যাংকে এফডিআর-সংক্রান্ত পাঁচটি হিসাবে এক লাখ ৩০ হাজার, সাড়ে সাত লাখ, সাড়ে তিন লাখ, পাঁচ লাখ ও তিন লাখ টাকার হিসাব পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে তিনটি সঞ্চয়ী হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে উল্লেখযোগ্য লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়নি।
স্বামী সিরাজুল হকের ব্যাংক লেনদেন: আশরাফুন্নেছার স্বামী সিরাজুল হকের নামে ব্র্যাক ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব ও দুটি এফডিআর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি হিসাবে ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট থেকে সদ্য সমাপ্ত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮৮ টাকা জমা হয়েছে। উত্তোলন করা হয়েছে ৬১ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮৮ টাকা। গত বছরের ২২ মার্চ এই হিসাব থেকে ‘এম কে ফুটওয়্যার লিমিটেডের’ হিসাবে ২৫ লাখ টাকা ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে জমা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই দম্পতির সম্পর্ক কী, তা জানা যায়নি। ফলে এই লেনদেনের উদ্দেশ্যও জানা যায়নি। সিরাজুল হকের একটি এফডিআরে ২৫ লাখ এবং অন্যটিতে ১০ লাখ টাকার লেনদেন পাওয়া গেছে। এফডিআর দুটি বর্তমানে বন্ধ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে স্বামীর ব্যাংক একাউন্টে ওই অস্বাভাবিক লেনদেনের টাকার উৎস্যর মুখ কোথায়?