ডার্ক মোড
Sunday, 28 April 2024
ePaper   
Logo
দোহারে সিন্ডিকেটে ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়

দোহারে সিন্ডিকেটে ফসলি জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়

দোহার (ঢাকা) প্রতিনিধি

ঢাকার দোহার উপজেলায় যত্রতত্র গড়ে উঠা ইটের ভাটার কাচাঁমাল হিসেবে ফসলি জমির মাটি টপ সয়েল কেটে নেওয়া হচ্ছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।অপরদিকে হুমকির মুখে পড়েছে জনজীবন। ফসলি জমির প্রাণ টপ সয়েল পোড়ানো হচ্ছে ইটভাটায়।সেই সাথে পুড়ছে কৃষকের স্বপ্ন! ফসল উৎপাদনে রয়েছে ধস নামার আশঙ্কা। সংবাদ প্রকাশের পরও নজরদারী নেই প্রশাসনের।

প্রশাসন নীরব ভূমিকায়,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদপত্রে সংবাদের শিরোনাম দেখেও যেন না দেখার ভান করছেন। অবলম্বন করা হচ্ছে কৌশল,সরকারি আইনকে দেখানো হচ্ছে বৃদ্ধাঙ্গুলি আর উপজেলায় ইটভাটায় আইন লঙ্ঘন করে ফসলি জমির মাটি দিয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। সাধারণ কৃষককে নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে সংগ্রহ করছে আবাদি জমির উপরি ভাগের (টপ সয়েল) মাটি।

দালালদের খপ্পরে পরে কতিপয় জমির মালিক লোভে পড়ে ইটভাটায় মাটি বিক্রি করছেন। এদিকে আইন থাকলেও প্রশাসন তা প্রয়োগ করছে না অজ্ঞাত কারণে। তাই অবাধে চলছে জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি মাহেন্দ্র ও বেকু মেশিনের মাধ্যমে দোহারে সর্বত্র।

মাটি কেনাবেচায় কৃষকরা আপাতত লাভবান হলেও ক্ষতির মুখে পড়ছে জমির উর্বরতা শক্তি। এছাড়া মাটি কেটে নেওয়ার ফলে জমি নিচু হয়ে পড়ায় চাষাবাদে বিঘœ ঘটনার ঘটনাও ঘটছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফসলি জমি কেটে পুকুর করার প্রতিযোগিতা। ফলে প্রতি বছরই সেচ প্রকল্পের ভেতরে ইরি-বোরো ধান আবাদ করা জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে।

এ চিত্র দেখা যায়, দোহার উপজেলার জালালপুর-শিমুলিয়া-গোবিন্দপুর ফসলি মাঠে,কুসুমহাটি ইউনিয়নের বাস্তার চক এলাকায়,মাহমুদটপুর ইউনিয়নের হরিচন্ডি এলাকায় ও নয়াবাড়ি ইউনিয়নের চক এলাকায়,পৌরসভা এলাকার রসুলপুর ও নিকড়া-ইসলামপুর চক এলাকায় ফসলি জমির মাঠ থেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব এলাকার কৃষক ও জমির মালিকরা জানান,এ ঘটনায় দোহার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: মোবাশ্বের আলম,উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভুমি) কর্মকর্তা এস এম মুস্তাফিজুর রহমান ও দোহার থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.মোস্তফা কামাল এর নিকট একাধিক লিখিত অভিযোগপত্র জমা দেন এলাকাবাসী। পরে এ ঘটনায় লোক দেখানো অভিযান চালান উপজেলা প্রশাসন। মাহমুদপুর ইউনিয়নের হরিচন্ডি এলাকায় সরকারি খাস জমিতে অবৈধ ভাবে মাটি কাটার অভিযোগে একটি ভেকু আটক করা হয় কিন্ত অভিযুক্তদের আটক করতে পারে নি।

এ বিষয়ে পৌরসভা রসুলপুর এলাকার বাসিন্দা সাবেক আওয়ামীলীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম জানান,আমার এলাকায় কৃষকদের ফসলি জমির মাটি জোর করে কেটে নিয়ে যাচ্ছেন একশ্রেনীর ফড়িয়া মাটি ব্যবসায়ীরা।এদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন এলাকার কিছু বখাটে ছেলেরা।তাই কৃষক ও জমির মালিকদের সাথে নিয়ে উপজেলা প্রশাসন ও থানা প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ জানাই।

পৌর এলাকার রসুলপুর গ্রামের ওয়াজউদ্দিনের ছেলে আমজাদ হোসেন ও শাহেদ আলী বেপারী ছেলে হজরত আলী অভিযোগে জানান, পৌরসভার রসুলপুর ও ইসলামপুর চক থেকে ফসলি জমির মাটি কেঁটে মাহেন্দ্র গাড়ির মাধ্যমে পরিবহনকালে আমাদের জমি উপর দিয়ে তা পরিবহন করা হচ্ছে। ফলে আমাদের ফসলি জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনায় আমরা এর প্রতিবাদ করলে এবং মাহেন্দ্র গাড়ি আটক করলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের মারতে আসে। এ সময়ে আমাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিবে এবং মেরে ফেলার হুমকি দেন তারা।

ইট প্রস্তত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ইট প্রস্তুতি করার জন্য কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে সংরক্ষন রেখে তা ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা নিষেধ থাকলেও অজ্ঞাত কারণে এই আইনের প্রয়োগ না থাকায় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ইট তৈরির জন্য কৃষিজমির মাটি স্তুপ করে সাজিয়ে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। আর ধীরে ধীরে ইটভাটার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ফসলি জমির প্রাণ।

কমে যাচ্ছে জমি উর্বরা শক্তি। প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে এক শ্রেণীর দালাল দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসা করে আসছে। এতে এক দিকে যেমন জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, অন্য দিকে ট্রাক্টও ও মাহেন্দ্র দিয়ে ইটভাটায় মাটি নেয়ায় নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক। গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। নীতিমালা না মানার জন্য মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্টে। এলাকার সাধারণ মানুষ ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে নানা ভোগান্তিতে। এসকল ইটভাটার কালো ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে মিশে পরিবেশের উপাদান বায়ুকে করছে দূষিত।

এছাড়াও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ডিসির অনুমতিসহ লাইসেন্স প্রাপ্তিতে যেসকল এলাকায় ইটভাটা হইতে পারে। 'আবাসিক এলাকা” অর্থ এমন কোন এলাকা যেখানে কমপক্ষে ৫০ (পঞ্চাশ) টি পরিবার বসবাস করে, “জলাভূমি” অর্থ কোন ভূমি যাহা বৎসরের ৬ (ছয়) মাস বা তদূর্ধ্ব সময় পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে এবং “বাগান” অর্থ এমন কোন স্থান যেখানে হেক্টর প্রতি কমপক্ষে ১০০ (একশত) টি ফলদ বা বনজ বা উভয় প্রকারের বৃক্ষ থাকে এমন এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। তবুও কি ভাবে দোহারে এমন স্থানগুলোতে ইটভাটা চলে? এমনটাই প্রশ্ন জনমনে।

ইটভাটার বিকট আওয়াজ, ধুলাবালিতে বায়ুদূষণ, আশপাশের ফসলি জমির মাটিদূষণ, কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে অনাবাদি করা,গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ গাছের ফলন কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

উপজেলার মুকসুদপুরের মধুর খোলা, নারিশা ইউনিয়নের উত্তর শিমুলিয়া (জালালপুর) আবাসিক এলাকায় চলছে (এসবিআই) ইটের ভাটা, সুতারপাড়ার উত্তর ডায়ারকুম-ডায়াগজারিয়ায় পদ্মা ব্রিকস ফিল্ডস ও ঢাকা ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজসহ পাঁচটি ইটভাটা, রাইপাড়ার ইসলামপুরে রয়েছে পাঁচটি ইটভাটা এবং মাহমুদপুরে রয়েছে একটি ইটভাটা। এছাড়াও নামে বেনানে এই উপজেলায় প্রায় ১৫ থেকে ২০ টি ইটভাটা রয়েছে।

এসব ইটভাটার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে ফসলি জমির টপ সয়েল। এতে কৃষকরা হারাচ্ছেন ফসলি জমি এবং কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। এছাড়া ইটভাটায় চলছে শিশুশ্রম ও শ্রমিক নির্যাতনের মতো নির্মম ঘটনা। ইটভাটার মালামাল পরিবহন করতে ব্যবহার করা হয় মাহেন্দ্র ও ট্রাকটর। এই মাহেন্দ্রোর চাকায় অচিরেই নষ্ট হচ্ছে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত রাস্তা। স্থানীয় এলাকাবাসী অতিষ্ঠ ধুলায়।

দোহার উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো.মুস্তাফিজুর রহমান জানান, উপজেলার বিভিন্ন স্থানের ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাতহ রয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তদন্ত চলছে। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইন অমান্য করে ইটভাটা পরিচালনা করেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তফা কামাল জানান,অভিযোগ পেয়েছি।বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন দেখবেন।আমরা শুধূ অভিযানে পুলিশ বাহিনী প্রেরন করবো।বাকিটা উপজেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করবেন।

এ বিষয়ে দোহার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: মোবাশ্বের আলম জানান, জমির মালিক ও কৃষকদের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি।তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিটি ইউনিয়নে কৃষি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন