ডার্ক মোড
Sunday, 19 May 2024
ePaper   
Logo
কক্সবাজারে লবণের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি

কক্সবাজারে লবণের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি

স.ম ইকবাল বাহার চৌধুরী, কক্সবাজার

স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরে লবণ উৎপাদনে রেকর্ড ছাড়িয়েছে এ বছর। ২৬ লক্ষ মেঃটন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যের বিপরিত বাম্পার ফলনের পরও এ পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ মেঃটন লবণ। ইতিপূর্বে উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২২ লাখ মেঃটন। তবে বিসিক কর্মকর্তারা আশা করছেন এ মাস যদি লবণ উৎপাদনের মত আবহাওয়া থাকে তাহলে লক্ষমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে চলমান মৌসুমে। যা হবে দেশের জন্য বড় একটি সুসংবাদ। তবে ভিন্ন চিত্র প্রান্তিক চাষীদের মুখে। কথা ছিলো বাম্পার লবণ উৎপাদনে চাষিদের মুখে হাসি ফোঁটার , কিন্তু তা না হয়ে উল্টো দালালের মুখে বেড়েছে হাসি! কক্সবাজার জেলায় উৎপাদিত লবণ দেশের অনেকটা চাহিদা মেটাচ্ছে। রেকর্ড ভাঙ্গা ফলনে গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত উৎপাদিত লবণ ২৩ লক্ষ ১০ হাজার ৯১৮ মেঃ টন। কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রামের বাশখালী সহ মোট ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে।

বিসিক অফিস গড়বাজার দর মণ প্রতি ৩১০ টাকা উল্লেখ করলেও মাঠ পর্যায়ে ২৬০-৭০ টাকা। আর প্রান্তিক চাষীদের হাতে যায় ২৫০ টাকা মাত্র। তীব্র তাপদাহে যেখানে মানুষ বাড়ীতে অসহ্য গরমে অস্থির, সেখানে উত্তপ্ত ঘামের ফোঁটায় উৎপাদিত লবণ বালতি/ বাটখারা নিয়ে লুটে নিচ্ছে ফড়িয়া/দালাল নামের কসাইরা। ৪০ সেরে মন পরিমাপের বিপরীতে দালালরা লুটে নিচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ সেরে মন। প্রতি বছরই এ বিষয়ে প্রান্তিক চাষীরা চোখের জলে হাঁ হুঁতাশ করলেও তাদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি প্রতিবাদে। এতে করে দরিদ্র প্রান্তিক চাষীরা নিরবে চোকের জল ফেলে যাচ্ছে বছরের পর বছর। যার দরুণ বাম্পার লবণ উৎপাদনে হাসি নেই চাষিদের মুখে,যদিও ফেসবুক জুড়ে লবণ উৎপাদনে চাষিদের মুখে হাসির কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবে চাষিদের নয় উল্টো দালালের মুখে বহুরুপী হাসি বেড়েছে।

চাষীদের প্রশ্ন - কেউ কি নাই মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দালাল নামক কসাইদের হাত থেকে বাঁচাতে? প্রান্তিক নিরযাতিত চাষীরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এমন হাসির রহস্যের সন্ধানে শুরু হয় সরজমিন চাষিদের দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই, কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে। বিভিন্নভাবে পর্যালোচনা করা হয় তথ্যের। অনেকেই জানান,পলিথিন কেনা থেকে শুরু করে কঠিন শর্তে জমি বর্গা নেওয়া, মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ও সস্তায় লবণ বিক্রিতে বাধ্য চাষিরা। এছাড়াও দালালদের কারণে জমির মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি বর্গা নিতে পারে না চাষিরা, আগাম টাকা দিয়ে লবণমাঠ নিয়ে নেয় দালাল সিন্ডিকেট। এরপর চড়া দামে লাগিয়ত করা হয়। তাদের মনগড়া দামেই জমি নিতে হয় চাষিদের। এছাড়াও ওজনের ক্ষেত্রে ঠকানো সেটা যেন অলিখিত আইনে পরিনত। ৪০ কেজিতে মণের হিসাব টাই দিনের পরদিন বেড়ে এখন প্রায় ৫৭-৬০ কেজিতে মণ। লবণের দরপতন হলেও দালালির কমিশনের তেমন কোন হেরফের হয় না। মণ প্রতি শতাধিক টাকা কমিশন খাচ্ছেন দালাল সিন্ডিকেট।

কোন জবাবদিহিতা নেই, চাষিদের স্বার্থে বিসিক এর ভুমিকা মাঠপর্যায়ে নেই বললেই চলে। লবণ চাষির দক্ষতা বৃদ্ধিতে মাঠপর্যায়ের বিসিক এর কার্যক্রম থাকলেও অনেক চাষি তা জানেই না। শুধু উৎপাদন হিসাব করে মাঠপর্যায়ের পরিবর্তে কাগজে কলমে দায় সেরে বসে আছেন বিসিক। চাষিদের বহুমুখী শোষণে কোনকালেই দালালের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট অফিস' উপরোক্ত তথ্য উঠে এসেছে চাষিদের মুখে।

যার ফলে প্রভাবশালী দালাল সিন্ডিকেট এর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে লবণের দাম নির্ধারণ। এভাবেই বহুমুখী শোষণের ফলে ফসলের মাঠে কৃষকের সেই হাসি এখন আর নেই। বহুকাল থেকে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল সিন্ডিকেট এর খপ্পরে পড়ে ঠকছে লবণ চাষিরা, এর যেন কোন প্রতিকার নেই। প্রতিবাদ করলেই একঘরে করে রাখে চাষিদের। গত ১০ মার্চ ২৪ ইং তারিখে কালারমারছড়া উত্তর নলবিলা এলাকার চাষি মিজানুর রহমান দালালের কয়ালির সাথে একমণে ৬৩ কেজি নেওয়ার প্রতিবাদে লবণ ওজনের বালতি জব্দ করেন।

ওই বালতি ডিজিটাল স্কেলে ওজন করে দেখা যায় ১৭ কেজি ২০০ গ্রাম। বালতির ওজন বাদ দেওয়ার পরও একমণে ৬৩ কেজি লবণ হয়। একমণে দেড়মণ লবণ নেওয়ার বিষয়ে চাষি ও কয়ালির সাথে বাকবিতন্ডা চলে। একপর্যায়ে শোষণের শিকার মিজান রাগে ক্ষোভে বালতি কেটে ফেলেন। কিছু মানুষ জুলুমের বিরুদ্ধে চাষি মিজানের কয়েকদিন প্রসংশা করলেও দালালের বহুমুখী হয়রানির ভয়ে নিরব হয়ে যায় নিমিষে।

কারণ শোষণের টাকায় সমাজে মাকড়সার জালের মতো করে আছে তাদের ব্যবসার ফাঁদ। শ্রমজীবীরা কোন না কোন ভাবে জিম্মি দালালদের হাতে, সমাজের সর্দার বা নীতিনির্ধারকও তারা। বর্তমানে বালতি নিয়ে লবণের ওজন নির্ধারন পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা। এই মৌসুমের শুরু থেকে অধিকাংশ সময় আবহাওয়া লবণ উৎপাদনে তেমন সহায়ক না হলেও শেষ পর্যায়ে লবণ উৎপাদনে কপাল খুলছে চাষির। তবে দাম ও ওজনে লুটপাটের কারণে ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় লবণ চাষি পরিবারে চলছে বোবাকান্না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দালাল জানান, প্রথমতঃ মোকামে অর্থাৎ মিল মালিকরাও এক মণে ৪৭/৪৮ কেজি লবণ নিয়ে নেয়। একারণেই দালাল সিন্ডিকেট অনেকটা নিরুপায় হয়ে মাঠপর্যায়ে চাষিদের কাছ থেকে এক মণে ৫০-৫৫ কেজি লবণ নেয় এমন যুক্তি দেখালেও বাস্তবতা ভিন্ন। এ ছাড়াও ২,০০০ মণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কার্গো লবণের বোটে ১৫/১৬শ মণে বোঝাই করে দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এক্ষেত্রে বোট মালিক দালাল ও কয়ালির গোপন চুক্তি হয়, এভাবেই কয়েক দফা যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মৌসুম শেষে শূন্য পকেটে বাড়ি ফিরে প্রান্তিক চাষি। তবুও পরিবার-পরিজনের দুমুঠো ভাতের ক্ষুধা নিবারনে দালাল সিন্ডেকেটের কাছে বর্ষা মৌসুমে আবার ধর্না দেয় জমি ও দাদন টাকার জন্য। দালাল সিন্ডিকেটের ফাঁদা শোষণকূপের ভিতরেই যেন চাষিদের বসবাস, এর বাইরে কল্পনাটা-ই নাকি অকল্পনীয়। মিল মালিক থেকে দালাল সর্ত্রই সিন্ডিকেট, গত বছর রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হওয়া সত্বেও আমদানি করে ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত করেছেন'এমন অভিযোগ চাষিদের। বলতে গেলে সর্বাঙ্গে ব্যাথা ঔষধ দিবো কোথা? এ অবস্থায় চলছে মাঠপর্যায়ে চাষিদের শোষণ।

সচেতন মহল মনে করেন, সরকারিভাবে কোন তদারকি না থাকায় মাত্রাতিরিক্ত জুলুমের শিকার চাষিরা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। শোষণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলে বিপদে পড়তেও নারাজ' এমনই জানান ভুক্তভোগীরা। এ সুযোগে নতুন শর্তের বেড়াজালে বন্দী করে চাষিদের ঋণগ্রস্ত করে যাচ্ছেন মহাজনী ব্যবসায়ী দালালরা। দাদনের টাকা পরিশোধ ও জীবিকার তাগিদে এভাবে প্রতিবছর দালালদের চুরাবালিতে আটকা পড়ে যাচ্ছে চাষিদের স্বপ্ন।

অথচ দালাল'রা প্রতিবছরই কোন না কোন সম্পদের মালিক হচ্ছেন। এভাবেই গরীবের স্বপ্ন রোধেপুড়ে ছাই হয় পক্ষান্তরে দালাল সিন্ডিকেটের হাতে যেন 'আলাদীনের চেরাগ'। 'ঘষা' দিলেই বাড়তে থাকে সম্পদ"এমন আক্ষেপ চাষিদের। অথচ সহায় সম্পদহীন অনেক-ই যে-কোন ভাবে দালালিতে যুক্ত হয়ে রাতারাতি টাকার কুমির হয়ে গেছে। এর সত্যতাও মিলে সরজমিন পাওয়া অনেকের পারিবারিক অবস্থার স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যে। দালালি পেশায় কোন নজরদারি না থাকায় অনেক দালাল বিপুল পরিমাণ আয়কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগও উঠেছে।

বিষয়টি খতিয়ে দেখলে প্রান্তিক চাষিদের শোষণ করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়া দালাল সিন্ডিকেট সনাক্ত করা সহজ হবে বলে জানান সচেতন মহল। প্রান্তিক চাষীদের শোষণ ও প্রচলিত মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে জানতে বিসিক কক্সবাজার অফিসের উপ মহপরিচালক জাফর ইকবাল বলেন, -চাষিদের কে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে উৎপাদন মৌসুমে একসাথে অধিকাংশ লবণ বিক্রি না করে ধাপে ধাপে বিক্রি করার জন্য। এভাবে করলে লবণের ন্যায্য মূল্য পাওয়া যাবে।

ডিজিটাল স্কেলে লবণ ওজনের বিষয়টি নিয়ে বিসিক(প্রধান কার্যালয়ে) জানানো হয়েছে। ওজনের ক্ষেত্রে বালতি /বাটখারা পদ্ধতি বন্ধে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা লবণ কমিটিতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। তবে দীর্ঘদিন চাষিদের ওপর দালালদের শোষণ চলতে থাকায় সচেতন মহলে প্রশ্নবিদ্ধ বিসিক এর কার্যক্রম। ন্যায্য মূল্য ও ওজনে লুটপাট বন্ধ না হলে বাম্পার লবণ উৎপাদনেও চাষিদের মুখে হাসি থাকবে না। লবণ শিল্পের উন্নয়ন ও চাষিদের বাঁচাতে ন্যায্য মূল্য ও ওজনের বালতি /বাটখারা পদ্ধতি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেন অসহায় লবণ চাষি।

এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) বিভিষন কান্তি দাস বলেন, লবণ বিষয়ে মুলতঃ বিসিক দেখে। এ বিষয়ে তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন ভুক্তভোগীরা। তবে জেলা প্রশাসক বরাবরেও যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন