
মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন
ওসমান গনি
মানুষের জীবনে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা মধ্যে একটি হল স্বাস্থ্য সেবা। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্যসেবার মান সংবাদপত্রের মাধ্যমে সন্তোষজনক প্রকাশ হলো বাস্তবচিত্রে স্বাস্থ্যসেবার মান আমাদের দেশে একেবারেই তলানীর অবস্থা। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সেবা মান যদি উল্লেখযোগ্য হতো তাহলে আমাদের দেশের বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়মিত চেকআপ করার জন্য তারা বিদেশ যান কেন? আমাদের দেশের স্বাস্থ্য সেবার প্রতি তাদের নিজেদের কোন আস্থা নেই ,যদি নিজেদের স্বাস্থ্য সেবার প্রতি তাদের আস্থা থাকতো এবং তারা যদি সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক হতো তাহলে তারা নিজ দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখত। দেশের প্রতিটি খাতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি রয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতা একটি দুর্নীতির বড় খাত। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে মানুষের সাথে বিভিন্ন রকম প্রতারণা করে তাদের নির্দিষ্ট সময় পার করে চলে যায় ।এ সময় সাধারণ মানুষের তেমন কোনো লাভ না হলেও শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। এসব দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালদের হাত থেকে রক্ষা হয়নি আমাদের দেশে স্বাস্থ্য সেবার খাত । স্বাস্থ্য বিভাগটা যেহেতু একটা মানুষের জীবন মরণের সাথে সম্পৃক্ত তাই এই খাতটাকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা একান্ত প্রয়োজন বলে দেশের বিজ্ঞ মহল মনে করেন। আমাদের দেশে যারা রাষ্ট্র পরিচালনায় আছেন তারা স্বাস্থ্য খাতকে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য যুগোপযোগী করে তোলার জন্য স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করলেও সেটা দেশের সাধারণ ও নিরীহ মানুষের তেমন কোনো কাজে আসে না ।কারণ যারা সরকারের সুযোগ সুবিধা সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে তারা প্রত্যেকটা লোক দুর্নীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে সেক্টরের সাথে দুর্নীতিবাজ লোক সরাসরি জড়িত সেখানে সাধারণ মানুষ কিভাবে ভালো জিনিস আশা করতে পারে, এটা কোনদিনও সম্ভব না।
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন রকম দুর্নীতির চিত্র। বাংলাদেশের প্রতিটি খাতের দুর্নীতি দেখে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য এদেশের তরুণ ছাত্রসমাজ আন্দোলন করে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, যেহেতু আমাদের দেশে তরুণ সমাজ দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন হয়তো দেশের মানুষের মাঝে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে সমাজের উঁচু থেকে নিচু- সকলেই ব্যস্ত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার। এত বছরের জঞ্জাল সরানো সময়সাপেক্ষ ও দুরূহ কাজ। তার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতটা সম্ভব ধীরে ধীরে সংস্কারের কাজ করছে। আশা করা যায় তারা তাদের কাজে সফল হবেন। প্রায় সময় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা যায় চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা। এ নিয়ে প্রায় সময় চিকিৎসক, হাসপাতাল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়ে থাকে ।একে কেন্দ্র করে চিকিৎসকরা দেশের চিকিৎসা সেবা বন্ধ দিয়ে বসে থাকে, তখন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি শেষ থাকে না।
চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলো এর দায় কে নেবে? আমাদের দেশে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। বহুবার এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ইতিপূর্বে কোনো হাসপাতাল এ কারণে দায় নেয়নি। এখন পর্যন্ত কোনো চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। কিছু দিন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনা সারা দেশের মধ্যে একটা আলোরণ সৃষ্টি হয়, তার পর সবাই ভুলে যায়। এমনকি দেখা যায় চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোও চিকিৎসকদের অপরাধের শাস্তি না চেয়ে বরং তাদের রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো দায় নেয় না। চিকিৎসকের অপরাধ অনুযায়ী কোনো শাস্তি হয় না। বরঞ্চ রোগীর ক্ষেত্রে এনআইসিইউ ও বড়দের ক্ষেত্রে আইসিইউ-এর ভাড়া বাবদ লাখ লাখ টাকা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক নেওয়া হয়। পুরো ব্যাপারটায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় রোগীর পক্ষের লোকজন। তাই কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু চলছেই। কিছু কিছু ক্লিনিক ও চিকিৎসক রোগীর অবহেলায় মৃত্যুর বিষয়টি সিরিয়াসলি নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাবোধ করে না। তাদের কাছে এ যেন ছেলেখেলা।
সরকারি অনেক হাসপাতালে খোঁজ নিলে এমন সব ঘটনা বের হবে, যা শুনলে বা দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে গেলে সিট পাওয়া যায় না। আয়া, নার্স, এটেনডেন্টরা রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দুর্বব্যবহার করেন। তাদের অনেকেই টাকা না দিলে রোগীর দিকে তাকায় না। সরকারি হাসপাতালগুলোর বাথরুমগুলো যেন জাহান্নাম। পুরুষের চেয়ে নারীরা বাথরুম ব্যবহারে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হন, কারণ পুরুষ রোগীর এটেনডেন্ট হিসেবে নারীরাই সাধারণত হাসপাতালে থাকেন। বাথরুমের খারাপ অবস্থার কারণে তারা বাথরুমে যান না, এর ফলে ইউরিন ইনফেকশনের শিকার হন তারা। এমন নয় যে, হাসপাতালে বাথরুম পরিষ্কারের জন্য কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। সবই আছে,কিন্তু কার নির্দেশে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে না সেটা দেখার বিষয়। খাবারের ক্যান্টিনও থাকে অপরিষ্কার। শোনা যায়, সরকারি হাসপাতালের দালালরা রোগী ভাগিয়ে তাদের পরিচিত ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সরকারি হাসপাতালে মানুষ যায় সস্তা-বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়ার জন্য; কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে আনতে হয়। এক্সরে, সিটিস্ক্যান, মেমোগ্রাফি করার যন্ত্রগুলো বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে। তাই রোগীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও ছুটতে হয় বাইরের দামি ক্লিনিকে।
ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয়বহুল, আমরা সকলেই জানি। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তরা ক্যানসারের মতো রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত সরকারি হাসপাতালেই যান। সেটি নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে কীভাবে বহন করা সম্ভব? তা হলে তো বলতে হয় ।ক্যানসার বা কিডনির অসুখ হলে নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগীদের মৃত্যুপানে চেয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগীদের চিকিৎসা মানেই হলো পরিবারটি আর্থিক অসচ্ছলতায় পতিত হওয়া। একমাত্র উচ্চবিত্ত ছাড়া দুরারোগ্য এসব অসুখে আমাদের দেশের সকলের অবস্থা অতি শোচনীয়।
তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর উল্লিখিত অনিয়মের দিকে নজর দেওয়া দরকার। দেশের স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনাগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আমলে না নেয়, তবে তা হয়তো আর কখনই ঠিক হবে না। এখন স্বাস্থ্য খাতে যেসব বিষয় দেখা দরকার তা হলো বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ফি কীভাবে নির্ধারণ হচ্ছে তা মনিটরিং করা দরকার।সরকারি হাসপাতালগুলোতে অর্থ বরাদ্দ থাকার পরও কেন সকল রোগী যথাযথ সেবা পায় না, সে বিষয়টি দেখার জন্য কমিটি গঠন করা দরকার।
আর কতকাল আমাদের দেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে? আর কতকাল চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যু হলেও সাধারণ জনতা কোনো প্রতিকার পাব না? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে যুক্ত আছে দেশের তরুণ সমাজ। তরুণরাই পারবে হাসপাতালগুলো তাদের নজরদারিতে রাখতে। অতিসত্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন উপরোক্ত বিষয়গুলো নজরে আনে ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। আমজনতা পদে পদে হাসপাতালে গিয়ে আর দুর্ভোগ পোহাতে চায় না।
নতুন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত হতে হবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে সাজানো। স্বাস্থ্য খাতে আর কোনো দুর্নীতি জনগণ দেখতে চায় না। বাধ্য হয়ে জনগণ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যায়। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের জন্য যদি নতুন করে আইন/বিধি/অধ্যাদেশ জারি/প্রণয়ন করা দরকার হয়, তা হলে সে পদক্ষেপও সরকারের নেওয়া দরকার।দেশে কার্যকর কোনো স্বাস্থ্যনীতি নেই। এখন আমাদের আগামী বছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতের রূপরেখা নিয়ে ভাবতে হবে। বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো বৈষম্যমুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। আমাদের জাতীয় সংবিধানেও বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একটি জটিল বিষয়। এই খাতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ে ভালো জ্ঞানের পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। দেখা গেছে, উচ্চ পদে অধিষ্ঠিতদের মধ্যে খুব কমই এই গুণের অধিকারী। সুতরাং, যাদের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন স্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এবং জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাদের এই খাতে উচ্চ পদে পদায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি হয় মূলত ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে। তাই ক্রয় প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ করা জরুরি।বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশেষ অডিট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ফলে সেই সব দেশে ক্রয় ও অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দুর্নীতি কমাতে সাফল্য এসেছে।এছাড়া তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, যখন খাতভিত্তিক বরাদ্দ (ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ব্যয়ের বিশদ পরিমাণ উল্লেখসহ) সহজে পাওয়া যায়, তখন দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
লেখক :সাংবাদিক ও কলাম লেখক
Comment / Reply From
You May Also Like
Latest News
Vote / Poll
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?
হ্যাঁ
না
মন্তব্য নেই
0%
0%
0%
Popular Posts
Archive
Please select a date!
Submit