
প্রযুক্তির সুফল কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে
ওসমান গনি
আমরা এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি, যাকে সহজেই ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’ বা ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন’ বা ‘ফোর আইআর’ বা ‘ইন্ডাস্ট্রি ফোর পয়েন্ট জিরো’র শুরুর লগ্ন বলা যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি খাতে, বিশেষত বাংলাদেশের কৃষিতে ফোর আইআরের প্রভাব, সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় আমাদের করণীয় কী? কৃষি খাতের আঙ্গিকে বলা যায়, এ প্রযুক্তি পরিবেশের ওপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলে, কম খরচে অধিক ফলন ও পুষ্টি নিশ্চিত করে। সে বিবেচনায় উন্নত বিশ্বের কৃষিব্যবস্থা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। ভবিষ্যতে কৃষি খাতে এর ব্যবহার কল্পনাতীতভাবে বাড়বে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর এর প্রভাব বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থায়ও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা যদি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে না পারি, তাহলে পিছিয়ে পড়ব, সন্দেহ নেই। এ কথা স্পষ্ট, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে একদিকে যেমন কৃষিসংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের ধরনের পরিবর্তন হবে, অন্যদিকে তেমনি সরকার তথা জনগণের ওপরও এর বিশাল প্রভাব পড়বে। আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশ ঠিক রেখে কম খরচে মানসম্পন্ন ও নিউট্রিশন সমৃদ্ধ কৃষিপণ্য উৎপাদনে চাপ তৈরি হবে, রোবটের ব্যাপক ব্যবহার কৃষিতে, বিশেষ করে উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ খাতে কর্মসংস্থান সংকুচিত করবে। ট্র্যাডিশনাল সেমি স্কিলড বা ননস্কিলড জনবল কাজ হারাবে। পাশাপাশি এ কথাও সত্যি, ফোর আইআরসংশ্লিষ্ট আরও অনেক নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
কৃষি খাত ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, আমদানি-রপ্তানি সব ক্ষেত্রে ব্যবসার ধরন পালটে যাবে। বরাবরই আমাদের কৃষিতে কিছু প্রচলিত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন কৃষিজমি হ্রাস, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিজমির ক্ষুদ্রায়তন, কৃষিশ্রমিক-সংকট, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি। পাশাপাশি ফোর আইআর বাস্তবায়নে বেশ কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ আবির্ভূত হয়েছে, যেমন প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, নলেজ গ্যাপ, ধীরগতির ইন্টারনেট, দেশীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের অভাব, কৃষক পর্যায়ে ট্যাব/স্মার্টফোনের অভাব, আইনগত জটিলতা, মোটিভেশনের অভাব ইত্যাদি। কৃষি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুতের কাজ হাতে নিয়েছে। এ-টু-আইয়ের সহযোগিতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন সব দপ্তর বা সংস্থা থেকে তিন ক্যাটাগরিতে প্রস্তাবিত কার্যক্রম যাচাই-বাছাইপূর্বক কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে।
বৈশ্বিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯৭০ কোটি এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে প্রায় ২২ কোটি; কাজেই এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়টি মাথায় রেখে, এসডিজিকে সামনে নিয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ফোর পয়েন্ট জিরোর কর্মপরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে। বহুমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য একটি বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্যেরও হাব হয়ে উঠতে পারে। তার জন্য দরকার স্মার্ট কৃষি ও তার সফল বাস্তবায়ন। কৃষি বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তিমূল। কৃষির ওপর ভিত্তি করেই বহু দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। আমাদের দেশেও তা-ই হয়েছে। স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার বা ক্লাইমেট স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার অনেকের কাছে বেশ পরিচিত টার্ম হলেও কৃষক পর্যায়ে এটির ধারণা এখনো বেশ অস্বচ্ছ। এটিকে পরিচিতি করানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর। কৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তথা ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেশ আগেই। এসব প্রযুক্তিগত সুফল কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে এর ব্যাপকতা আরও বাড়বে। বর্তমানে বহু অনলাইন পরিষেবা বাড়ছে। এসবের প্রভাবে কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বিপুলসংখ্যক প্রযুক্তিপ্রেমী তরুণ-যুবক কৃষি ব্যবসায় উদ্যোক্তা হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ইত্যাদির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাবের কারণে ভবিষ্যতে এর প্রভাব কৃষিতেও পড়বে। সব স্তরের কৃষক ডিজিটাল জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে একসময়। আর তখনই স্মার্ট কৃষিই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।
স্মার্ট ফার্মিং বা কৃষি’ বলতে আমরা কী বুঝি? বিদ্যমান কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে এর পার্থক্যই-বা কী? স্মার্ট কৃষির উপকারিতাই-বা কী? ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে ‘স্মার্ট কৃষি’ কতটুকু অবদান রাখবে? স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার একটি মোটামুটি নতুন শব্দ। ‘স্মার্ট’ হলো সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, অর্জনযোগ্য, প্রাসঙ্গিক এবং সময়ভিত্তিক লক্ষ্যগুলোর পাঁচটি উপাদানের সংক্ষিপ্ত রূপ। স্মার্ট ফার্মিং বিশেষজ্ঞ অ্যাঞ্জেলা শুস্টারের মতে, বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বেশি পরিমাণে খাদ্যোৎপাদনে স্মার্ট ফার্মিংয়ের গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে, স্মার্ট ফার্মিং প্রাকৃতিক সম্পদ ও ইনপুটগুলোর আরও দক্ষ ব্যবহার, জমির উত্তম ব্যবহার এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করতে সক্ষম করে তোলে। স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার শব্দটি খামারে ইন্টারনেট অব থিংস, সেন্সর, লোকেশন সিস্টেম, রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায়। চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শস্যের গুণমান এবং পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং ব্যবহৃত মানবশ্রমকে অপটিমাইজ করা।স্মার্ট কৃষিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তির উদাহরণ হলো: যথার্থ সেচ এবং সুনির্দিষ্ট উদ্ভিদ পুষ্টি; গ্রিনহাউজে জলবায়ু ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণ; সেন্সর-মাটি, জল, আলো, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনার জন্য সফটওয়্যার প্ল্যাটফরম; অবস্থান সিস্টেম-জিপিএস, স্যাটেলাইট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, মোবাইল সংযোগ; রোবট; বিশ্লেষণ এবং অপটিমাইজেশান প্ল্যাটফরম আর এসব প্রযুক্তির মধ্যে সংযোগ হলো ইন্টারনেট অব থিংস। আর এটি সেন্সর এবং মেশিনের মধ্যে সংযোগের জন্য একটি প্রক্রিয়া, যার ফলে একটি সিস্টেম, যা প্রাপ্ত ডেটার ওপর ভিত্তি করে খামার পরিচালনা করে থাকে। এসব ব্যবস্থার জন্য কৃষকরা তাদের খামারের প্রক্রিয়াগুলো নিরীক্ষণ করতে পারে এবং দূর থেকে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
স্মার্ট ফার্মিংয়ের আরও সুবিধার মধ্যে রয়েছে স্যাটেলাইট অটোগাইডেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে উন্নত নির্ভুলতা, কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, ভোগ্যপণ্য হ্রাস, ফলন বৃদ্ধি, চালকের চাপ কম, ব্যবহারের সহজতা; সহজ রেকর্ডিং এবং রিপোর্টিং; সহজ আর্থিক পূর্বাভাস; টেকসই উন্নত ব্যবস্থাপনা; গ্রিনহাউজ অটোমেশন, শস্য ব্যবস্থাপনা, গবাদি পশু পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা, যথার্থ চাষ, কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার, স্মার্ট ফার্মিংয়ের জন্য ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিশ্লেষণ, অ্যান্ড-টু-অ্যান্ড ফার্ম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি। কীভাবে স্মার্ট ফার্মিং খাদ্যের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন আনতে পারে সেটিও অনেকের প্রশ্ন। সর্বোপরি, এটি সাধারণ জনগণের কাছে খাদ্য এবং অন্যান্য কৃষিপণ্যের সরবরাহকে নিরবচ্ছিন্ন ও বেগবান করে তোলে এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনা উন্নত করে। এসব কাজের জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। দেশের কৃষক ও কৃষি বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে দেশে ধানের উৎপাদন বাড়ছে। যেখানে ১৯৭০-৭১ সালে বাংলাদেশের চাল উৎপাদন ছিল ১০ দশমিক আট মিলিয়ন টন, সেখানে ২০২০-২২ অর্থবছরে উৎপাদন প্রায় চার গুণ বেড়ে ৩৮ দশমিক সাত মিলিয়ন টনে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের মতে, এক দশমিক দুই মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে হিসাবে ধরে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য তথা চালের বর্তমান চাহিদা প্রায় ৩৫ দশমিক তিন মিলিয়ন টন। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে। এই অর্জন দেশের উন্নয়ন যাত্রায় এক মাইলফলক। আর এই মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি অনন্য ভূমিকা রাখবে বলেই আমরা আশাবাদী
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Comment / Reply From
You May Also Like
Latest News
Vote / Poll
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?
হ্যাঁ
না
মন্তব্য নেই
0%
0%
0%
Popular Posts
Archive
Please select a date!
Submit