Dark Mode
Friday, 20 June 2025
ePaper   
Logo
ধর্মীয় শিক্ষা ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবে বাড়ছে কিশোর গ্যাং

ধর্মীয় শিক্ষা ও পারিবারিক মূল্যবোধের অভাবে বাড়ছে কিশোর গ্যাং

 
ওসমান গণি 
 
বর্তমান সময়ে দেশ ও জাতির জন্য এক আতঙ্কিত নাম কিশোর গ্যাং। যাদের পরিধি দিন দিন বাড়ছে। কিশোর গ্যাং-এর কার্যক্রম দেখলে মনে হয় এরা অপ্রতিরোধ্য। যেন কোনোভাবেই এদের প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিদিনের খবরে দেখা যাচ্ছে এরা প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় অহরহ অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু আবার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ধরা খাচ্ছে। আবার এরা কিশোর বিধায় ছাড়াও পাচ্ছে। যার জন্য দেশে কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম দিন দিন বাড়ছে। কিশোর গ্যাং গ্রুপের সাথে যুক্ত যারা তাদের বেশিরভাগ কিশোরের বয়স হলো ১৫-২০ বছর। এই বয়সটা প্রতিটা মানুষের জন্য একটা কঠিন বয়স। এ সময়ে তাদের ভালো-মন্দ যাচাই-বাছাই করার জ্ঞান থাকে না। কি করলে কি হবে সেই চিন্তা-চেতনা তাদের মনে নেই। যার জন্য তাদের মনে যা চায় তাই করে বসে। কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য সীমা অতিক্রম করেছে। গ্যাং কালচারের এই বিস্তার দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ হুমকি। যারা জাতির ভবিষ্যৎ বলে পরিগণিত হয়, তাদের মধ্যেই যদি প্রায় সব ধরনের অপরাধ করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তাহলে জাতির আগামী দিনগুলো যে অন্ধকারের অতলে ডুবে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, রাহাজানি চুরি, ডাকাতি, মাদক কারবার ইত্যাদি ভয়ংকর অপরাধ কিশোর গ্যাংয়ের দ্বারা অবলীলায় সংঘটিত হচ্ছে।আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দেখতে পাই, দেশের বিভিন্ন জায়গায় অহরহ কিশোরগ্যাং হাতে মানুষ বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও খুন হচ্ছে। 
 
রাজনৈতিক উদ্যোগ, প্রভাব, প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো অপরাধী চক্র গড়ে উঠতে ও টিকে থাকতে পারে না। কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষেত্রে একথা সত্য। কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীনরা জড়িত আছে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কিশোর গ্যাং আছে। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে রাজধানীর কিশোর গ্যাংয়ের এলাকাভিত্তিক একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই খবরে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স সম্পর্ক বলা হয়েছে, তারা কিশোর নয়, তাদের বয়স ১৯-২০ বছরের মধ্যে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা অগনিত। দেশে ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর রাজনৈতিক দলে নেতারা  তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে কিশোর গ্যাংয়ের লালন-পালন ও সুরক্ষা করছে। দেশে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারি দলের  ছত্রছায়াতেই কিশোর গ্যাং বহাল তবিয়েতে টিকে আছে। দেশের অন্যত্রও কিশোর গ্যাং গঠন-পালনে সরকারি দলের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। জনসভায় লোক আনা, প্রভাববলয় ঠিক রাখা,
 
এটা পুনর্বার উল্লেখের প্রয়োজন নেই যে, কিশোর গ্যাংয়ের পেছনে দণ্ডায়মান আছে ক্ষমতাসীন দল। ফলে এমন কোনো শক্তি নেই, যে কিশোর গ্যাং রুখতে পারে, গ্যাং কালচার ডেড স্টপ করতে পারে। সরকারের কঠোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পুলিশ কর্তৃপক্ষ আগেই স্বীকার করেছে, কিশোর গ্যাং দমন বা নির্মূল করা তার পক্ষ সম্ভব নয়। সরকারের অভয় ও সরকারি দলের পোষকতা থাকলে পুলিশের সাধ্য কী, একে দমন করে। সেটা পুলিশ যেমন বোঝে, অতি সাধারণ মানুষও বোঝে। কাজেই যা কিছু করার সরকারকে এবং সরকারি দলকেই করতে হবে। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মিডিয়ার খবর দেখতে পাই পুলিশ প্রশাসন দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে অনেক কিশোর গ্যাং  সদস্যকে আটক করে। এসব আটক করো পুলিশের কোন লাভ হবে না কারণ এসব কিশোর গ্যাং  সদস্যদের  বয়স থাকার কারণে বিভিন্ন আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় পশ্রয়ে এরা পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কিশোররা গ্যাং কালচারে আকৃষ্ট ও অভ্যস্থ হয়ে উঠছে কেন? এর একটা বড় কারণ অভাব, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, যাকে এক কথায় বলা যায় অর্থনৈতিক। দেখা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অধিকাংশই এসেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। অভাব নিম্নবিত্ত পরিবার তো বটেই, মধ্যবিত্ত পরিবারকেও পথে বসিয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায়, এসব পরিবারের সন্তানেরা নিরূপায় হয়ে পড়েছে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কাজের অভাবও প্রচণ্ড। সহজে জীবনধারণ ও যাপন করার মতো কাজের সংস্থান দেশে নেই। বেকারের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন একটা অবস্থা হয়েছে, কিশোর-যুবকরা অবৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার জন্য মৃত্যুর মুখে পা দিতেও পিছপা হচ্ছে না। অভাব, অনটন, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব ইত্যাদি কিশোরদের গ্যাং কালচারে প্রলুব্ধ করছে সঙ্গতকারণেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর গ্যাং কালচার গড়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া আর যে কারণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাহলো, পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষার শোচনীয় ঘাটতি। পারিবারিক-সামাজিক মূল্যবোধ পরিবার ও সমাজকে আগে যে সুরক্ষা দিতো, সেই সুরক্ষা এখন নেই। কারণ, ওই মূল্যবোধই নিঃশেষ হয়ে গেছে। আগে শিশু বয়সে মক্তবে-মাদরাসায় পবিত্র কোরআন পাঠ, নামাজ-রোজা ও আদব কায়দা শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, এখন তা নেই। পরিবারে এসব শিক্ষার যে সুযোগ ছিল তাও নেই। ফলে ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ যে কোনো অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। এ সাহায্য থেকে বঞ্চিত এখনকার কিশোররা। পরিবার হলো সব শিক্ষার ভিত্তিভূমি। শিশু-কিশোরের লালন-পালন ও শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব পালন করে মাতা-পিতা বা অভিভাবক। আজকাল অধিকাংশ মাতা-পিতা ও অভিভাবক এ দায়িত্ব পালন করে না। সন্তান-সন্ততি কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, খেয়াল করে না।
বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে মাদকাসক্তি কিশোর-যুবকদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে। জুয়াও তাদের গিলে খাচ্ছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্তিও ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যাচ্ছে। টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সামাজিক মাধ্যম তাদের এসব কাজে প্রভাবিত করছে, প্ররোচিত করছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে এ দেশের হুন্ডুরাস, কলম্বিয়া প্রভৃতি দেশের মতো হতে খুব বেশি দিন লাগবে না। বলা বাহুল্য, এর চেয়ে গুরুতর অশনিসংকেত আর কী হতে পারে! শিশু-কিশোর-যুবকদের বাঁচাতে, দেশ বাঁচাতে, জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে এখনই সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিচিন্তকদের মতে, কিশোরঅপরাধ দমনে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক পোষকতা পরিহার করতে হবে, অর্থনীতিকে সব বিত্তের মানুষের কল্যাণদায়ী করে তুলতে হবে। বেকারত্ব দূর করতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী পাঠ্য বিষয় সংযুক্ত করতে হবে। পরিবার ও সমাজকে আরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। শিশু-কিশোরদের লালন-পালন ও সুরক্ষায় সর্বোচ্চ ভূমিকা নিতে হবে। এসব ব্যবস্থা নেয়া হলে আশা করা যায়, কিশোর অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধ কমে আসবে। পরিবারে, সমাজে, দেশে শান্তি ও স্থিতি নিশ্চিত হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বসতে হবে। তাদের সুচিন্তিত অভিমত ও পরামর্শ অনুয়ায়ী একটি পথরেখা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কিশোর গ্যাং প্রতিরোধের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের পাশাপাশি অভিভাবকদের সন্তানদের ব্যাপারে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় প্রশাসনকে এলাকাভিত্তিক অভিভাবকদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করে কিশোর গ্যাং-এর অপরাধমূলক কাজ প্রতিরোধে উদ্যোগ নিতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে মাইকিং করে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
 
লেখক - সাংবাদিক ও কলামিস্ট 

Comment / Reply From

Vote / Poll

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?

View Results
হ্যাঁ
0%
না
0%
মন্তব্য নেই
0%

Archive

Please select a date!