
মিয়ানমারকে ঘিরে ভূরাজনীতিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়
পবিত্র মজুমদার
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটি নতুন ভূরাজনৈতিক খেলা শুরু হয়েছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তার করার প্রতিযোগিতা। এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক করিডোর, সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ এবং কৌশলগত ঘাঁটি সবকিছু মিলিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তির ভারসাম্য গড়ে উঠছে। বিশেষ করে চীন 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (BRI)-এর মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালী এড়িয়ে বিকল্প করিডোর তৈরি করতে চায়, যার মধ্যে অন্যতম হলো চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (China-Myanmar Economic Corridor - CMEC) এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (China-Pakistan Economic Corridor - CPEC)। এই করিডোরগুলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও এ অঞ্চলে তার প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া।
বাংলাদেশ, এই বৃহৎ খেলায় এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের ভূ-অবস্থান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে চলমান সংঘর্ষ এবং সম্ভাব্য মার্কিন মদতের বিষয়টি নতুন করে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।
যদিও বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের তুলনামূলকভাবে ভালো সম্পর্ক ছিল, তবে সময়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন পরিবর্তনের পর কিছুটা টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন আবারো উঠে আসায় বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে—যেমন মানবাধিকার, সংখ্যালঘুদের অবস্থা এবং রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে কথা বলা। তবে এসব অবস্থান গ্রহণের পেছনে যেমন নীতিগত অবস্থান রয়েছে, তেমনি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাও যুক্ত আছে।
দিন শেষে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমীকরণে। যদিও কখনো কখনো ভারতের লবির প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু প্রতীকী নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে, কিন্তু বড় ধরনের কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করবে না। বরং সামগ্রিকভাবে কখনই, যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারকে পুরোপুরি কোণঠাসা করতে চাইবে না।
এর একটি বড় কারণ হলো—মিয়ানমারে গণতন্ত্র পতনের পর সেখানকার সামরিক সরকার চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে, যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী। এ প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্র এখন বিকল্প শক্তি খুঁজছে, যারা এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। ধারণা করা হয়, আরাকান অঞ্চলে 'আরকান আর্মি'-কে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে, যাতে সেখানে চীনা প্রভাব খর্ব করা যায়। আর বাংলাদেশ সরকার যদি এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় সহযোগিতা করে, তাহলে এই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থ রক্ষার কাজটা সহজ হয়ে যাবে।
বর্তমান সময়ে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। দিন দিন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব ও আধিপত্য বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার স্বার্থ রক্ষায় এবং চীনের প্রভাব প্রতিহত করতে যেকোনো ধরনের কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে পারে তা সামরিক, কূটনৈতিক কিংবা মানবিক সহায়তার রূপে হোক।খুব সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সংলগ্ন সীমান্ত এলাকা থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উদ্দেশে একটি ‘মানবিক করিডোর’ খোলার প্রস্তাব দেন। যদিও এই উদ্যোগকে মানবিক কারণে বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো এই ধরনের পদক্ষেপের পেছনে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে।
“আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ন্যায়বিচার বা নৈতিকতার কোনো স্থান নেই—সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায় কেবল স্বার্থ।”
-- জন জে. মিয়ারশাইমার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
মিয়ানমারে সামরিক সরকারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে রাখাইন অঞ্চলে চীনা প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে। এই প্রেক্ষাপটে 'আরাকান আর্মি'-কে যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে, যার মাধ্যমে মিয়ানমারে চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব। আর এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন একটি আঞ্চলিক, ভৌগোলিকভাবে সুবিধাজনক এবং তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল মিত্র, যার অন্যতম উপযুক্ত স্থান বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই তাকে এ ভূরাজনৈতিক খেলায় গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যতে আরও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতে পারে।এই জটিল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কোনো একটি শক্তির দিকে একতরফাভাবে ঝুঁকে না পড়ে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখা। কারণ, এই অঞ্চলে চীনের মতো পরাশক্তি রাষ্ট্র তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে যেকোনো সময় বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি “কৌশলগত কার্ড” হিসেবে ব্যবহারযোগ্য, যদি দেশটি কৌশলী ও বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে। অন্যথায়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নিজেই এক অনিশ্চিত ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারে।
সমাজবিজ্ঞান
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
Comment / Reply From
You May Also Like
Latest News
Vote / Poll
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা বন্ধ করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি?
হ্যাঁ
না
মন্তব্য নেই
0%
0%
0%
Popular Posts
Archive
Please select a date!
Submit