ডার্ক মোড
Thursday, 15 May 2025
ePaper   
Logo
লাভজনক হওয়ায় চাটমোহরে বৃদ্ধি পাচ্ছে লতিরাজ কচুর চাষ

লাভজনক হওয়ায় চাটমোহরে বৃদ্ধি পাচ্ছে লতিরাজ কচুর চাষ

মামুন হোসেন, পাবনা
 
ভালো ফলন, বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি ও রোগ-বালাইয়ের ঝুঁকি কম থাকায় বাণিজ্যিকভাবে লতিরাজ বারি-১ কচু চাষ করছেন চাটমোহরের কৃষকরা। এছাড়া বাড়তি ফসল হিসেবে কচু লতি বিক্রি করেও বেশ লাভবান হচ্ছেন তারা।
 
সাধারণত অন্যান্য জাতের কচু গাছ ও পাতা ছোট,  চিকন, সরু ও লম্বা হয়। কিন্তু লতিরাজ কচুর লতি সবুজ, সামান্য চ্যাপ্টা ও ৯০ থেকে প্রায় ১০০ সেমি. পর্যন্ত লম্বা হয়। এবং এই গাছের সংযোগস্থল ও বোঁটার রং বেগুনি হয়। সাধারণত এ কচুর জীবনকাল ১৮০ থেকে ২১০ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
 
উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, এ বছর  উপজেলায় প্রায় ৫৫ হেক্টর জমিতে লতিরাজ কচু চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয়েছে ছাইকোলা, মূলগ্রাম, মথুরাপুর, বিল চলন, হরিপুর ও হান্ডিয়ালে। কৃষি বিভাগ জানায়, লতিরাজ জাতের কচু অনেকের কাছে বেশ জনপ্রিয় সবজি। এছাড়া কচু রোপণের ৭৫ দিন পর থেকে প্রায় ৭ মাস পর্যন্ত লতি সংগ্রহ করা যায়। তাই কচু চাষ প্রকল্পের আওতায় অনাবাদি পতিত ও স্যাঁতসেঁতে ছায়াযুক্ত জমিতে এ কচু চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে, কৃষকদের মাঝে উদ্বুদ্ধকরণ সহ ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে মাঠ প্রদর্শন, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন ধরণের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
 
স্থানীয় কৃষকরা জানান, দেশে সবজি হিসেবে কচুর বহুমুখী ব্যবহার করা হয়। প্রথমত শাক হিসেবে খান কচুর পাতা, এরপরে কচুর শক্ত শরীর ও কচুর লতি। পরে পুষ্টিকর তরকারি হিসেবে খাওয়া হয় কচু গাছের মূল। সঠিক পরিচর্যা করা গেলে সব খরচ বাদ দিয়ে বিঘা প্রতি প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব বলে জানান তারা। তারা জানান, ছায়াযুক্ত জমি সহ প্রায় সব মাটিতেই কচু লতি চাষ করা যায়। তবে পলি দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটিতে কচুর লতি চাষ ভালো হয়। দেশে প্রায় কয়েক প্রকারের কচুর জাত রয়েছে। এ সকল জাতের মধ্যে বারি-১ ও বারি-২ এর জাত দুইটি লতি উৎপাদনের জন্য উত্তম বলে জানান তারা।
 
কথা হয় ইউটিউব সহ বিভিন্ন মাধ্যমে লতিরাজ বারি-১ চাষ পদ্ধতি দেখে উদ্বুদ্ধ হওয়া রাহাবুল রহমান রোকন নামের এক কৃষি উদ্যোক্তার সঙ্গে।  তিনি পাবনা বিআইএমটি থেকে ডিপ্লোমা ফামের্সী শেষ করে। নিজ এলাকা হান্ডিয়ালে পল্লী চিকিৎসার পাশাপাশি এবছর ছায়াযুক্ত অনাবাদি দেড় বিঘা পতিত জমিতে লতিরাজ কচুর চাষ করেছেন তিনি। তিনি জানান, ইউটিউব সহ বিভিন্ন মাধ্যমে লতিরাজ চাষ সম্পর্কে জানতে পেরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চারা এনে ডিসেম্বর মাসে রোপণ করেন তিনি। রোপণের কয়েক মাস পর থেকেই গাছে লতি আসতে শুরু করে। শুরুতে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও, বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে স্থানীয় বাজার সহ আড়ৎয়ে বিক্রি করছেন তিনি। তিনি জানান, শুরুতে দেড় বিঘা জমিতে রোপণ করতে তার খরচ হয়েছিল প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত দেড় বিঘা জমিতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত উৎপাদন ভালো হলে সব খরচ বাদ দিয়ে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত লাভ হবে বলে মনে করেন তিনি।
 
হান্ডিয়াল পাকপাড়া গ্রামের আরেক লতি কচু চাষী ছাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সারাবছরই কোননা কোন শাকসবজি চাষাবাদ করেন তিনি। তাই অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি এবছরও ১বিঘা জমিতে লতিকচু চাষ করেছেন তিনি। তিনি জানান, জমি প্রস্তুত, চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার ও সেচ সবকিছু একাই করেন তিনি। তিনি বলেন, ভালো ফলন এবং রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমন না হলে বিঘা প্রতি প্রায় ৬০ মণ করে কচুর লতি উৎপাদন হয়। তিনি জানান,স্বল্প সময়ে ভালো ফলন ও লাভজনক হওয়ায় তিন বছর যাবত কচু চাষ করছেন তিনি। তিনি আরও জানান, তার ক্ষেতের উৎপাদিত লতি চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর ও স্থানীয় বাজারে পাইকারি মণ প্রতি ২ হাজার ৫০০ হতে, ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন তিনি।
 
ক্ষেতে কাজ করা দিনমজুর মুকুল হোসেন জানান, নিজের আবাদ করা জমিতে কাজ করার পাশাপাশি কচু ক্ষেতে ৬০০ টাকা দিন মুজুরি হিসেবে ক্ষেত পরিচর্চা, লতি উঠানো সহ বিভিন্ন কাজ করেন তিনি। নিজ জমির পাশাপাশি এখানে কাজ করে অনেকটাই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছেন বলে জানান এই কৃষক।
 
স্থানীয় কৃষক আব্দুল রাহিম জানান, আমাদের অঞ্চলের কৃষকেরা ধান, সরিষা, ভুট্টা সহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে। তবে কয়েকবছর হলো তাদের এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে লতি কচুর আবাদ করা দেখছেন তিনি। তিনি জানান, কম ঝামেলা ও কম খরচে কচু লতি চাষ করা যায়। এ আবাদে বেশি কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। এছাড়া কচু ক্ষেতে গরু, ছাগলও লাগে না। এবং দেখাশোনার জন্য বাড়তি কোনও লোকেরও প্রয়োজন হয় না। তাই সামনের মৌসুমে তিনিও কচু লতির আবাদ করবেন বলে আশা করছেন তিনি।
 
হান্ডিয়াল মুনিয়াদিঘী কৃষি কলেজের পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম রনি বলেন, আমাদের দেশে লতিরাজ কচু অনেক জনপ্রিয় সবজি। বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ সবজি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কচু লতি মূলত পানি কচু। লতিরাজ কচুতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি রয়েছে। উৎপাদনের দিক দিয়ে মুখীকচুর পরই কচু লতির স্থান। তাই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লতিরাজ কচু উৎপাদন করলে বেকার সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি, ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
 
এবিষয়ে চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, প্রতিবছরই কচু ও কচুর লতি বিক্রি করে কৃষকেরা বেশ লাভবান হন। তবে এ আবাদে পরিশ্রম একটু বেশি হওয়ায় অনেক কৃষকই করতে চান না। তিনি বলেন, তবে যারা একটু পরিশ্রমী তারা প্রতি বছরই এ কচুর আবাদ করে থাকেন। তিনি বলেন, এ আবাদের সুবিধা হলো স্যাঁতসেতে ছায়াযুক্ত জমিতেও এ কচু চাষ করা যায়। তিনি বলেন, শুধু কচু নয় বসত বাড়ির পাশে আদা ও হলুদ চাষেরও বিভিন্ন পরার্মশ দিয়ে আসছে কৃষি অফিস। বিভিন্ন প্রকল্প আসলে, সেই প্রকল্পের মাধ্যমে নানাভাবে কৃষকদের সহযোগিতা করা হয় বলে জানান এই কর্মকর্তা।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন