সালাউদ্দিন অর্থ আত্মসাত করেন ভারতীয় কোম্পানির সহযোগিতায়
ক্রীড়া প্রতিবেদক
ভারতীয় কোম্পানির সহযোগিতায় টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। টুর্নামেন্টের টেলিকাস্টিং যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ ২ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার ভুয়া খরচ দেখিয়ে ভারতীয় কোম্পানির সহযোগিতায় ওই টাকা আত্মসাৎ করে বলে জানা যায়।
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ, অনিয়ম আর কমিশন বাণিজ্যে নিমজ্জিত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরনসহ গুটিকয়েক কর্মকর্তার কারণে দেশের ফুটবল সুনাম হারিয়েছে। সালাউদ্দিনের দেড় যুগের দুঃসময়ে দেশের ফুটবল হারিয়েছে তার ঐতিহ্য। এখন কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার অপেক্ষা। আর্থিক অনিয়মের কারণে বাফুফের বেতনভোগী সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে চার বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ফিফা।
সদ্য পদত্যাগ করা সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীকে প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ফিফা। জাতীয় দলের সাবেক দুই প্রখ্যাত ফুটবলার শামসুল আলম মঞ্জু ও প্রয়াত বাদল রায় বাফুফের অনিয়ম তুলে ধরে ফিফার কাছে অভিযোগ পাঠিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ ও ২ এপ্রিল শামসুল আলম মঞ্জুর স্বাক্ষর করা দুটি অভিযোগপত্র ফিফার সভাপতি এবং এএফসির সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই অভিযোগপত্রের সঙ্গে ৩৮০ পৃষ্ঠার বাফুফের অনিয়মের বিভিন্ন নথি পাঠিয়েছিলেন মঞ্জু।
ওই বছরের ৬ এপ্রিল ফিফার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মার্কুস কার্টনার মঞ্জুর অভিযোগ প্রাপ্তিস্বীকার করে লিখেছিলেন, ফিফা এ ব্যাপারে পর্যালোচনা করবে স্বাধীনভাবে। পরে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাফুফের বর্তমান সহসভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ করেছিলেন। তারই সূত্র ধরে ১৭ সেপ্টেম্বর বাফুফের প্রয়াত সহসভাপতি বাদল রায় সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে সরাসরি অনিয়মের অভিযোগ এনেছিলেন। এজন্য তাকে কম হেনস্তা হতে হয়নি। সালাউদ্দিন গংরা রাজনৈতিকভাবে এবং নিরাপত্তাকর্মীদের দিয়ে এই সাবেক তারকা ফুটবলারকে লাঞ্ছিত করেছিল।
২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক ফরিদ আহমেদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। ওই চিঠির সঙ্গে ছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন। বাফুফের ব্যাপক দুর্নীতি ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা সংবলিত গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আজ পর্যন্ত ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একসময় ফুটবল ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আজ বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ফুটবলের রুগ্ণ অবস্থার জন্য বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিন দায়ী। তার চারিত্রিক দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতায় বাংলাদেশের জরিমানা, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের প্রাইজমানি ও বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ সরাসরি সম্প্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়া করার নামে দুর্নীতি, প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নাম ভাঙিয়ে ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টের টিকিট দুর্নীতি, বাফুফে সভাপতি ও মাহফুজা আক্তার কিরনের যৌথ দুর্নীতি, সভার কার্যবিবরণী নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি, বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম, সিলেট বিকেএসপি ক্যাম্পাসে ফুটবল একাডেমির নামে দুর্নীতি, ফিফার প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত আর্থিক দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক আস্ফালন উল্লেখযোগ্য।
এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে সুযোগ না পাওয়া দলগুলো নিয়ে সলিডারিটি কাপের আয়োজন করে এএফসি। নিশ্চিত ভরাডুবি জেনে সালাউদ্দিন ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলকে না খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। তার এ অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের ফলে এএফসি বাংলাদেশকে ২০ হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করে, যা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া ওই বছর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে নেপাল, বাহরাইন ও বুরুন্ডির প্রাইজমানির টাকা প্রদানে টালবাহানা করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু কাপ আয়োজনের নামে পাঁচ কোটি টাকা বাজেট ১৫ কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিরনের মালিকানাধীন মডিউলাস কমিউনিকেশন্স হাতিয়ে নিয়েছিল মোটা অঙ্কের অর্থ। সরাসরি খেলা সম্প্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়ার নামে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের প্রচারস্বত্ব কিনেছিল চ্যানেল নাইন। চুক্তি অনুযায়ী চ্যানেল নাইনের কাছ থেকে পাওয়া টাকা সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি বিশেষ মহল আত্মসাৎ করেছে। শুধু তাই নয়, টুর্নামেন্টের টেলিকাস্টিং যন্ত্রপাতি ভাড়া বাবদ ২ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার ভুয়া খরচ দেখিয়ে ভারতীয় একটি কোম্পানির (রিয়েল ইমপেক্ট প্রাইভেট লি.) সহযোগিতায় ওই টাকা আত্মসাৎ করে বলে জানা যায়। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এক ক্রীড়া সাংবাদিকও।
বাফুফের টাকায় শেখ পরিবারের সদস্যদের ইউরো ও বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন টুর্নামেন্টের টিকিট দেওয়া হতো। ফিফা ও এএফসি থেকে কমদামি টিকিট কিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছে মোটা অঙ্কে সেটি বিক্রি করতেন সালাউদ্দিন-কিরনরা। সালাউদ্দিন ও মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরন মিলে একটি দুষ্টচক্র গড়ে তুলেছেন। তাদের দুজনের দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী আবু নাঈম সোহাগ। কাজী সালাউদ্দিনের সহযোগী হিসাবে মাহফুজা আক্তার কিরনের মতো সোহাগও বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইস্টার্ন ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকা জমা ও উত্তোলন নগদে হয়েছে। যদিও নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের লেনদেন চেকের মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি বাফুফের লেনদেনে অনিয়ম ও দুর্নীতিকে ইঙ্গিত করে। এ অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নগদ জমা ও উত্তোলনের মাধ্যমে সালাউদ্দিন গং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফুটবল একাডেমি করার জন্য সিলেটে বিকেএসপি পেয়েছিল বাফুফে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে একাডেমির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে দিয়েছিল। ফিফাও অনুদান দিয়েছিল সাত লাখ ডলার। কিন্তু সেই সাত লাখ ডলার হাপিস করে দিয়েছিল বাফুফে। বাফুফের কোনো অডিট রিপোর্টেই একাডেমি পরিচালনার জন্য ফিফার দেওয়া সাত লাখ ডলারের কথা উল্লেখ নেই। কয়েক মাস নামকাওয়াস্তে চালিয়ে একাডেমিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাফুফের ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত যে খরচ দেখানো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। ফিফা সভাপতির একদিনের খরচ দেখানো হয়েছিল ৯০ লাখ ৯২ হাজার ৭৭৪ টাকা। জানা যায়, বাংলাদেশ সফরে সভাপতির যাবতীয় খরচ ফিফা বহন করে। বাফুফের দেওয়া খরচের তথ্য সঠিক নয়। কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবল উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী কোনো চিন্তা করেননি। তিনি স্ট্যান্টবাজি করেন। ২০১১ সালে তিনি আর্জেন্টাইন ফুটবলার লিওনেল মেসিকে বাংলাদেশে আনেন এবং বাংলাদেশের ফুটবল একটি গ্লোবাল প্ল্যাটফরমে প্রবেশ করছে-এমন একটি আবহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন।
বাফুফেকে দেওয়া সরকারের ২০ কোটি টাকা গায়েব করার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। লংকা-বাংলা ফাইন্যান্সে স্থায়ী আমানত হিসাব করলেও বছর না ঘুরতে সেই স্থায়ী আমানত ভেঙে অর্থ তুলে নিয়েছে বাফুফে। সারা দেশে ফুটবল উন্নয়নে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাফুফেকে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছিল, ‘ফুটবল খেলার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে তহবিল গঠনের জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অনুকূলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিবালয়ের ক্রীড়া সংস্থার মঞ্জুরির আওতায় অন্যান্য অনুদান খাতে এককালীন সরকারি অনুদান হিসাবে ২০ কোটি টাকা দেওয়া হলো। কেবল ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাফুফে কর্তৃক কোনো সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নয়, বরং এ তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করা হলে তা থেকে অর্জিত মুনাফা ফুটবলের নানাবিধ উন্নয়নের জন্য ব্যয় করতে হবে।’
অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেওয়া ২০ কোটি টাকার পুরোটাই লোপাট করে ফেলেছে বাফুফে। এ অর্থের কোনো হদিস নেই বাফুফের অডিট রিপোর্টেও। ২০২০ সালে সরকারের দেওয়া বাজেট বরাদ্দের প্রথম কিস্তির ১০ কোটি টাকা খরচ না করেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে হিসাববিবরণী জমা দিয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। এ বিবরণীতে স্বাক্ষর করেছিলেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, সিনিয়র সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে নিষিদ্ধ সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগ। বাফুফে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ের যে হিসাববিবরণী জমা দিয়েছে, এর পুরোটাই শুভংকরের ফাঁকি। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, সরকারের রাজস্ব বিভাগে আয়কর বাবদ ৫০ লাখ টাকা জমা দেওয়ার তথ্য হিসাববিবরণীতে রয়েছে। অথচ ট্যাক্স বাবদ একটি টাকাও জমা দেয়নি বাফুফে। বিল-ভাউচার জমা না দিয়েই বাকি ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে নিতে তৎপরতা চালিয়েছিলেন বাফুফের কর্মকর্তারা। কয়েক দফা যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেন তারা। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বাজেটের বাকি ১০ কোটি টাকা বাফুফের অনুকূলে ছাড়করণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। খরচের পূর্ণাঙ্গ বিবরণী না পাওয়া পর্যন্ত পরবর্তী কিস্তির টাকা চাওয়ার কোনো নজির নেই। সরকারি অর্থ বরাদ্দের এ শর্তের কথা হয়তো বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে অর্থ মন্ত্রণালয় দ্বিতীয় কিস্তির ১০ কোটি টাকাও ছাড় করে। তখন বাফুফে ক্রীড়া পরিষদের কাছে মুচলেকা দিয়েছিল, দ্বিতীয় কিস্তির ১০ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত হিসাবে রাখা হবে। ওই স্থায়ী আমানত থেকে পাওয়া লভ্যাংশ ফুটবলের উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। কিন্তু ঘটেছে ঠিক উলটো। ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর লংকা-বাংলা ফাইন্যান্সে ১০ কোটি টাকার মধ্যে এক বছর মেয়াদি ৯ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত রাখা হয়। বাকি এক কোটি টাকা খরচ দেখায় বাফুফে। বছর ঘুরতেই (৭ সেপ্টেম্বর ২০২১) স্থায়ী আমানত ভেঙে ফেলে বাফুফে। শুধু তাই নয়, নয় কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে কয়েক দফা ঋণ নেয় বাফুফে। ফলে মেয়াদ শেষে লভ্যাংশ দূরে থাক, মূল টাকা পাওয়াই দায় হয়ে পড়েছিল বাফুফের। প্রায় দুই বছর আগে সরকারি বরাদ্দের ওই টাকা হাপিস করে ফেললেও বিষয়টি কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে থেকে যায়।
বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি সালাউদ্দিনকে চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাফুফে সভাপতি, কিরণ ও প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সেই রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি।
দুই সাবেক ডাচ কোচ ডি ক্রুইফ ও রেনে কোস্টারের পাওনা ছিল ৯০ হাজার ইউরো। কিন্তু তাদের নাম ভাঙিয়ে আড়াই কোটি টাকা হাপিস করেছেন সভাপতি। ব্রিটিশ কোচ জেমি ডের আয়কর বাবদ ২৫ লাখ টাকা ও পল স্মলির এক কোটি টাকা রাজস্ব বিভাগে জমা না দিয়ে পকেটে ভরেছেন সালাউদ্দিন-কিরন-সোহাগরা। কিরনের এইচএসবিসি ব্যাংক মতিঝিল ব্রাঞ্চে (হিসাব নং ০০১.০৬৪.৭৪০০০১) অনুসন্ধান করলে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২২ বিশ্বকাপের ভেন্যু বিডিংয়ে কাতারকে সমর্থনের বিনিময়ে প্রায় পাঁচ লাখ ডলার ঘুস নেওয়ার অভিযোগ ছিল সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের (সাফ) সভাপতি হিসাবে সালাউদ্দিনের প্রভাব রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে স্টেডিয়াম তৈরি করে দেবে স্পেন-এ ধুয়া তুলে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা করেন সালাউদ্দিন। ফুটবল উন্নয়নের নামে রাশিয়ার সঙ্গেও লোকদেখানো চুক্তি করেছিলেন সালাউদ্দিন। পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করেছিলেন সালাউদ্দিনের মেয়ে সারাজিন ও জামাতা এলেক্স। সারাজিনের ভিয়েতনামি কোম্পানি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে সফটওয়্যার সরবরাহ কাজ বাগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু সফটওয়্যার সরবরাহ না করেই প্রায় ১০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গেছে সারাজিন। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল সংলগ্ন বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণকাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে প্রায় ২৫ কোটি টাকা কমিশন নিয়েছিল সালাউদ্দিন গংরা। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন এএফসির পালটা ফুটবল জোটে যোগ দিয়ে পাঁচ লাখ ডলার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেই অর্থ বাফুফেতে জমা হয়নি। ২০২২ সালের ২৯ অক্টোবর বাফুফের এজিএমে কাউন্সিলরদের কণ্ঠরোধ করে এক মিনিটেই ৩৪ কোটি টাকার বাজেট পাশ করিয়ে নেন সালাউদ্দিন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুগান্তরে নিউজ করার পর সংবাদ সম্মেলন করে হুমকি দিয়ে সালাউদ্দিন বলেছিলেন, ‘বাফুফের বিরুদ্ধে মানেই দেশের বিরুদ্ধে নিউজ।’ যুগান্তরের সিনিয়র ক্রীড়া প্রতিবেদক মোজাম্মেল হক চঞ্চলকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় ফুটবলাঙ্গনে। শুধু তাই নয়, কয়েক ডজন মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা হয়। এখনো দুটি মামলা হাইকোর্টে চলমান।
পৃষ্ঠপোষকতা আয়ের শতকরা ১৫ ভাগ কমিশন পকেটে ভরেছেন সালাউদ্দিন-কিরনরা। বাফুফের ক্যাম্প কমান্ডার আবদুস সাদেকের পাওনা ১৮ লাখ টাকা না দিয়ে পকেটে পুরেছিল সালাউদ্দিন-কিরন গংরা। এ নিয়ে ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ২০১৯ সালে একটি মামলা করেন আবদুস সাদেক।
২০১৫ সালের মে মাসে ফিফা কংগ্রেসে যোগ দিতে গিয়েছিলেন সালাউদ্দিন, তৎকালীন সহসভাপতি ও সবেক ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়, ফিফা কর্তৃক বহিষ্কৃত সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ এবং বাফুফের মেডিকেল কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ডা. আওলাদ মো. ফারুক রেজা। তাদের সঙ্গে ডেলিগেট সমন্বয়কারী দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মো. সেলিম উদ্দিনকে। পরবর্তী সময়ে সুইজারল্যান্ডে থেকে যান সেলিম। তখনই জানা গিয়েছিল, সুইজারল্যান্ডে পাচারের জন্য সেলিমের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছিলন বাফুফের কর্মকর্তারা।
২০১১ সালে ঢাকায় আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়া প্রীতি ম্যাচে অনুশীলন স্বত্বের টিকিট বিক্রির স্বত্ব পেয়েছিল আপন কমিউনিকেশন। দেড় কোটি টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দিলে পরে সেই গ্যারান্টি তুলে নিয়ে গিয়েছিল কোম্পানিটি। অভিযোগ ছিল ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে আপসরফা হয়েছিল বাফুফে ও আপন কমিউনিকেশনের মধ্যে।