
রক্তের দাগ না শুকাতেই জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে সংসয়
ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার :
রক্তের দাগ না শুকাতেই জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। নানা সংশয়। ক্ষোভ শহীদ পরিবারের সদস্যরা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে আইন উপদেষ্টার নেয়া একেরপর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড নিয়ে। ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হলেও গত ৮ মাসে জুলাই গণহত্যার বিচারের দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। তবে আছে সংশয় ও নানা প্রশ্ন। দেখা দিয়েছে নানা বিতর্ক। গুরুত্বপূর্ণ
তথ্য ফাঁসের ঘটনাও আছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণে অনেক আসামি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেত্রীকে আন্তর্জাতিক অপরাধপালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্বয়ং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ট্রাইব্যুনালের (বাংলাদেশ) প্রসিকিউটর নিয়োগের মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রবল সমালোচনার মুখে যদিও সে নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে আসামীদের সাথে সমঝোতার অভিযোগ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে বিক্ষোভ করেছেন জুলাই—
আগস্ট বিপ্লবে শহীদ পরিবারের সদস্যরা। গোপনীয় তথ্য আসামী পক্ষের কাছে ফাঁসের অভিযোগ করেছেন প্রসিকিউটররা। বাংলাদেশের
ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে যা ৩৬ জুলাই নামে পরিচিত। জাতিসংঘের হিসাব
অনুযায়ী ১৪০০ এর বেশি নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছে শিশু। আহত হয়েছেন ৩০
হাজারের বেশি ও চোখ হারায় ৫০০ শতাধিক। জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে চলছে ছলচাতুরি। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ওরফে
আসিফ নজরুল বা সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষ ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেনে যা পরোক্ষভাবে গণহত্যাকারীদের পক্ষেই গেছে। এরমধ্যে
রয়েছে তড়িঘড়ি করে আইন সংশোধন যাতে হত্যাকারীরা সহযোগতিা পায়। যার নাম দেয়া হয়েছে আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
(সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ । এখন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে সুপ্রিম
কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা যাবে। এতে করে বিচার কাজ ধীর আগে কখনো ছিল না। নতুন বিধানের ফলে আসামীদের আপিলের
সুযোগ করে দেয়া হয়েছে অন্তর্বতী আদেশের বিরুদ্ধে। আইনের অনুচ্ছেদ ১১ (৮) অনুযায়ী বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ করা
যাবে। এই বিধান আগে ছিল না। নতুন নিয়মের ফলে গণহত্যাকারীরা লুটপাটের টাকায় বিদেশের নামকরা আইনজীবীদের নিয়োগ দিতে
পারবে। নামে আন্তর্জাতিক হলেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (বাংলাদেশ) নিয়োগকৃত বিচারকদের অভিজ্ঞতা নিয়ে রয়েছে নানা
প্রশ্ন। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর ছাড়া বাকি সব পোস্টে জুনিয়র আইনজীবীদের প্রসিকিউটর হিসবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এতে তারা ডিফেন্স টিমের সামনে আইনী লড়াই চালাতে ব্যর্থ হবে। শুধু জুনিয়র বিষয়টি এমনও নয়, ২/৩ জন বাদে বাকি প্রসিকিউটরদের মামলা ট্রায়াল করার তেমন কোন অভিজ্ঞতাও নেই। অথচ এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মামলা ট্রায়াল করার অভিজ্ঞতা থাকা। এমনকি ২০২১ সালে জজকোর্টে এনরোলমেন্ট হয়েছে এমন আইনজীবীকেও প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন আন্তজার্তিক
অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এমন জুনিয়র আইনজীবী এরআগে নিয়োগ দেয়া হয়নি। সেটা হোক সিয়েরালিয়নের বিশেষ কোর্ট বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা। বিগত স্বৈারাচারী আমলে পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপি—জামায়াতের নেতাদরে ফাঁসি দেয়া হলেও দেশসেরা আইনজীবী ও বিচারকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল ট্রাইব্যুনালে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেত্রী আফরোজ পারভীন সিলভিয়াকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয় ২৭ মার্চ অর্থাৎ ঈদের ছুটির আগে আগে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে স্বৈরাচারকে রক্ষা ও প্রয়োজনীয় তথ্য তাদের কাছে পাচার করা। সমালোচনার মুখে পড়ে যদিও সে নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। নিয়োগ বাতিল করা হরেও এ নিয়োগের পেছনে কারা ছিল সে তথ্য জাতির সামনে প্রকাশ করা জরুরি। জুলাই গণহত্যার স্পষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও এবং ট্রাইব্যুনাল ক্ষোভ প্রকাশ করলেও আসামীদর গ্রেপ্তার না করে পরোক্ষভাবে তাদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। জুলাই গণহত্যার অন্যতম কুশীলব ও স্বৈারাচার শেখ হাসিনার বিভিন্ন অপকর্মের সহযোগী অধ্যাপক জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও তিনি আজ পর্যন্ত বহাল তবিয়তে রয়েছেন। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের চাচা শ^শুর অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতো অন্যতম কুশীলবকে গ্রেপ্তারের আওতায় না আনায় স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই জুলাই—আগস্ট বিপ্লবে শহীদ পরিবারের সদস্যরা নানা
অভিযোগ করে ২৪ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আসামিদের সাথে
সমঝোতা করার মতো অভিযোগ করেছেনে তারা। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন ১৯৯২ সালের গণ আদালত প্রতিষ্ঠার অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ রমনার প্রতীকী আদালতে অধ্যাপক আসিফ নজরুল জামায়াতের প্রয়াত আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের আইনজীবীর ভূমিকা পালন করেন। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক মরহুম হুমায়ূন আহমেদের কন্যা শিলা আহমেদের বর্তমান স্বামী অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। অধ্যাপক আসিফ নজরুলের নামের মতোই তার জীবন ও কর্ম নানা রহস্যে ভরপুর। জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসনিা পলায়ন করলে অধ্যাপক আসিফ নজরুলের ভাগ্য খুলে যায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা হন অধ্যাপক আসিল নজরুল। দায়িত্ব নেয়ার পর
থেকেই তার একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা বিতর্ক। আসিফ নজরুল কোন এজেন্ডা নিয়ে এসব করছেন তা বলা মুশকিল।
সময়ই প্রকাশ করবে একদা বিচিত্রার সাংবাদিক অধ্যাপক আসিফ নজরুলের প্রকৃত মুখোশ। শেষ কথা হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে
সবচেয়ে বড় গণহত্যার বিচার নিয়ে এতো প্রশ্ন ও সংশয় কেন তার জবাব জাতির সামনে প্রকাশ করা জরুরি। জুলাই গণহত্যার বিচার
নিয়ে যে সংশয় ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তার পেছনে রয়েছে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও ভূমিকা।
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন রমনার গণ আদালত প্রতিষ্ঠার অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। বিতর্ক এড়াতে ও বিচার নিশ্চিত করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের উচিত হবে জুলাই গণহত্যার বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলা করা। একই পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের বিশেষ উপদেষ্টা ব্রিটিশ আইনজীবী ব্যারিস্টার টবি ক্যাডমান। এখন দেখার বিষয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি সিদ্ধান্ত নেন। লেখক পরিচিতি : সোলায়মান তুষার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী