
আগামী ৪ ও ৫ এপ্রিল সনাতন ধর্মালম্বীদের মহাতীর্থ স্নান উৎসব নাঃগঞ্জে লাঙলবন্দে স্নানোৎসবের প্রস্তুতী
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, নারায়ণগঞ্জ
চলতি বছর (২০২৫ সাল) আগামী ৪ ও ৫ এপ্রিল সনাতন ধর্মালম্বীদের মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। স্নানোৎসব পালন নিয়ে সকল প্রস্তুতী শুরু হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার লাঙলবন্দ এলাকায়।
২০২৪ সালে ১৫ এপ্রিল বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জলনের মধ্য দিয়ে স্নান উৎসবের উদ্বোধন করে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলার হিন্দু নেতারা। এ স্নানোৎসব চলেছিল পরদিন ১৬ এপ্রিল বিকেল ৪টা ৫৬ মিনিট পর্যন্ত।
২০২৩ সালে ১৯টি ঘাটে স্নান অনুষ্ঠিত হলেও ২০২৪ সালে আরও একটি ঘাট বাড়িয়ে মোট ২০টি ঘাটে স্নান অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড় সোনারগাঁ থানা এলাকাতেও পুণ্যার্থীদের স্নান করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
তবে মূল অনুষ্ঠান ও রাজঘাটসহ ঐতিহাসিক মহাত্মা গান্ধী ঘাট, প্রেমতলা ঘাট, কালীঘাটসহ প্রধান প্রধান ঘাটগুলো নদের পশ্চিম পাড়ে হওয়ায় এখানে পুণ্যার্থীদের ভিড় ছিল বেশি। লাখ লাখ পুণ্যার্থী স্নান সম্পন্ন করেছে। তবে অতিরিক্ত গরমের কারণে গত বছর স্নান শেষে অনেক পুণ্যার্থীকে দ্রুত লাঙ্গলবন্দ এলাকা ছাড়তে দেখা গেছে।
এ বছর লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব পরিচালনায় ফ্রন্ট কমিটি আত্মপ্রকাশ করেছে। আগামী ৪ ও ৫ এপ্রিল সনাতন ধর্মালম্বীদের মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব। স্নান উৎসবকে সামনে রেখে আগত পূণ্যার্থীদের সুরক্ষাসহ সনাতনী স্বার্থ সংরক্ষণের কথা চিন্তা করে ফ্রন্টের নতুন কমিটি।
শনিবার (১৫ মার্চ) শহরের নিতাইগঞ্জ শ্রী শ্রী বলদেব জিউর আখড়া ও শিব মন্দির প্রাঙ্গণে নবীন প্রবীনের মিলন ঘটিয়ে নারায়ণগঞ্জ সনাতনী সমাজের জনমত নিয়ে মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব উদযাপন ফ্রন্টের কমিটির আত্মপ্রকাশ হয়েছে।
সভার শুরুতেই পবিত্র গীতাপাঠ গত ২০১৫ সালে পদদলিত হয়ে মৃত ১০ পূন্যার্থীর আত্মার শান্তি কামনায় ১ মিনিট নিরবতা পালন হয়। ননী গোপাল সাহার সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন ফ্রন্ট এ-র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অপর্ণা রায় দাস। কমিটির আত্মপ্রকাশ সভায় আমন্ত্রিত অতিথিরা বক্তব্য রাখেন প্রধান অতিথি অপর্ণা রায় দাস কে লাঙ্গলবন্দ পরিচালনার দায়িত্বে রাখার।
উপস্থিত সকলের বক্তব্য শুনে জনসমর্থন নিয়ে সভায় ননী গোপাল সাহা ঘোষণা দেন মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব উদযাপন ফ্রন্ট কমিটির সভাপতি পদের দায়িত্বে দেওয়া হয় অপর্ণা রায় দাস-কে। কমিটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জের সকল হিন্দু সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও লাঙ্গলবন্দের সেবাক্যাম্প প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি হয়।
পরে নতুন প্রজন্মের দাবি ও সমর্থন নিয়ে সাধারণ সম্পাদক পদে জয় কে রায় চৌধুরী বাপ্পি এবং কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ননী গোপাল সাহার নাম ঘোষণা দেন লাঙ্গলবন্দ স্নান উৎসব উদযাপন ফ্রন্ট কমিটির নব সভাপতি অপর্ণা রায় দাস।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অপর্ণা রায় দাস বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ পাশাপাশি। আমি আমার পরিবার সম্প্রীতির নারায়ণগঞ্জবাসীর সাথে একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে দুষ্কৃতিকারীদের কাজই হচ্ছে সবকিছুতেই বাঁধা সৃষ্টি করা। মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ আন্তর্জাতিক মানের একটি তীর্থস্থান। এই তীর্থস্থানের আগত পূণ্যার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত কল্পে যা যা দরকার তারই ধারাবাহিকতায় কাজ করে যাবো। যদি আপনারা নারায়ণগঞ্জবাসী নতুন প্রজন্মসহ সবাই পাশে থাকেন।
সভায় সম্মানিত অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব এডভোকেট আবু আল ইউসুফ খান টিপু, স্বপন কুমার দাস সহকারী সচিব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ট্রাস্টি পরিতোষ কান্তি সাহা, নাসিক ১৫নং ওয়ার্ড সাবেক কাউন্সিলর অসিত বরণ বিশ্বাস ও ২৩নং ওয়ার্ড সাবেক কাউন্সিলর আবুল কাউসার আশা, কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন ফ্রন্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সুবাস চন্দ্র দাস, কেন্দ্রীয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের যুগ্ম সম্পাদক ও পূজা ফ্রন্টের সহ-সভাপতি সমীর সরকার, পূজা উদযাপন ফ্রন্টের সহ সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ঋষিকেশ মন্ডল মিঠু, নারায়ণগঞ্জ জেলা ফ্রন্টের আহ্বায়ক এডভোকেট রাজীব মন্ডল, সদস্য সচিব খোকন সাহা, ২২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি শিবু চন্দ্র দাস, নিতাইগঞ্জ পাইকারি ও খুচরা ব্যাবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শংকর সাহা, সমাজসেবক সুজন সাহা, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের ভবানী শংকর, লাঙ্গলবন্দ অষ্টমী স্নান জনকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক রিপন দাস, আড়াইহাজার উপজেলা ফ্রন্টের নেতা অরবিন্দ সরকার বিশ্বাস, যুগ্ম সম্পাদক জয় কৃষ্ণ দাস, নিমাই চন্দ্র দে সাধারণ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ মহানগর ঐক্য পরিষদ, বলদেব মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রভাস সাহা, এডভোকেট রণজিৎ দে, গৌতম কুমার বনিক সহ-সভাপতি পূজা ও ঐক্য পরিষদ সোনারগাঁও উপজেলা, ঈমন বণিক, দীপক বনিক, শরৎ দাস, স্বপন দাস, মহানগর যুব মহাজোটের সভাপতি কার্ত্তিক ঘোষ জাগো হিন্দু পরিষদ জেলার সাধারণ সম্পাদক সুজন দাস, মহানগরের সম্পাদক জনি ভৌমিক, সঞ্জিত কুমার, সুদীপ্ত দাস প্রমুখ।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক শিপন সরকার শিখন বলেন, প্রতিবছর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাপমোচন পুণ্যস্নানার্থে এক অনন্য তীর্থ ভূমি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁ ও বন্দর উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের লাঙ্গলবন্দে ধর্মীয় মহাতীর্থ অষ্টমী স্নানোৎসব পালিত হয়। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের কোল ঘেষে লাঙ্গলবন্দ তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আদি ব্রহ্মপুত্র নদে যুগ যুগ ধরে এ স্নানোৎসব চলে আসছে। আগত পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তা জোরদারে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন লাঙ্গলবন্দ তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে থাকে।বন্দর উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ব্রহ্মপুত্র নদের কচুরিপানা পরিষ্কার লাঙ্গলবন্দ এলাকায় ২০টি ঘাটলায় কাপড় পাল্টানো, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবারহ, স্নানঘাটে বৈদ্যুতিক বাতি ও পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়।
তবে ব্রহ্মপুত্র নদের আশেপাশের এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানা ও ডাইংয়ের রাসায়নিক বস্তুমিশ্রিত বর্জ্য দূষণ পানি নদীতে পড়ছে। এ বিষয়ে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিযোগ।
ব্রহ্মপুত্রের জলের মাধ্যমে পাপমুক্ত হয়েছিলেন বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম মুনিকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন মনে করেন, মহাভারতের বর্ণনামতে পরশুরামমুনি পাপমুক্তির জন্য ব্রহ্মপুত্র নদে যে স্থানের জলে স্নান করে ছিলেন, তা লাঙ্গলবন্দে অবস্থিত। সেই থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এ সময়ে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান খুবই পূণ্যের।
এ স্নানের ফলে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে পাপমোচন হয়। এ বিশ্বাস নিয়ে সুদীর্ঘ কাল ধরে এ স্নানে অংশ নেয়ার জন্য উপমহাদেশের এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য মানুষ আসেন লাঙ্গলবন্দে। পাপস্খলনের এ উৎসবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ এসে এখানে সমাবেত হয়। পরশুরামের পাপ থেকে মুক্তি হওয়ার কথা স্মরণ করে শত শত বছর ধরে লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমী স্নান অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
শ্রী শ্রী ললিত সাধুর আশ্রমের পূজারি ঝর্ণা রানী জানান, টোটালফ্যাশন গার্মেন্ট অ্যান্ড ডাইং কারখানার রংমিশ্রিত রাসায়নিক বর্জ্য পানি পাইপ দিয়ে নদে পড়ছে।
এতে এ জলে স্নান করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। দূষিত জলে স্নান করলে শরীরে চুলকানিসহ নানা সমস্য সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে স্থানীয় হিন্দু পরিবারের লোকজন ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করা বন্ধ করে দেয়।
লাঙ্গলবন্দ স্নান উদযাপন কমিটি নেতারা জানান, মালিবাগ এলাকায় অবস্থিত বাশার পেপার মিলের বর্জ্য এবং জামালউদ্দিন টেক্সটাইল ও ডাইংমিলের বর্জ্য খাল দিয়ে ব্রহ্মপূত্রে পড়ছে। নদেও জল লাল, নীল, কালো রং ধারণ করেছে। নদের জল থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। কলকারখানার বর্জ্যে পরিবেশ এখন চরম হুমকির মূখে পড়েছে। এ ব্যাপারে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার দরকার।
বন্দর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানাগেছে, স্নান নির্বিঘ্ন করতে জেলা প্রশাসক সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে থাকে। স্নান ঘাটগুলোতে কাপড় পাল্টানোর পর্যপ্ত ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক বাতি, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, পূণ্যার্থীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে ১০ শয্যাবিশিষ্ট অস্থায়ী হাসপাতালসহ পাঁচটি মেডিকেল টিম সর্বক্ষণ থাকে। এছাড়া পুণ্যার্থীদের উন্নত সেবা প্রদানে ১০টি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু থাকে।