
নিউটনের আপেল: পতনের ভেতরে জাগরণের গল্প
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
ক্যাম নদীর জল বয়ে চলেছে শান্তভাবে, বিকেলের নরম আলোয় ঝলমল করছে নদীর বুক। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে—শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্ঞান যে স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে, সেই স্রোতের সঙ্গে আমার হাত মেলানো হয়ে গেল। চোখে শুধু ইট-পাথরের দেয়াল নয়, বরং গথিক খিলান, প্রাচীন টাওয়ার আর গ্রন্থাগারের জানালা। প্রতিটি দেয়াল যেন ফিসফিস করে বলছে—“আমরা জ্ঞানের সাক্ষী, যুগ থেকে যুগে আলো বয়ে এনেছি।”
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল বিদ্যাপীঠ নয়, এটি এক চলমান জ্ঞানের যাদুঘর। ১২০৯ সালে কয়েকজন বিদ্রোহী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড ত্যাগ করে যাত্রা শুরু করেন। ১২৩১ সালে রাজা হেনরি তৃতীয় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন, ১২৯০ সালে পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। তারপর থেকে একটানা আলোর স্রোত বইছে। আজ এখানে ৩১টি কলেজ রয়েছে, যেন ৩১টি বাতিঘর, যেখানে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হচ্ছে জ্ঞানের আলো।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বজুড়ে অজস্র মনীষী ও শিক্ষার্থীর জন্মদাতা। আমি সেই প্রাচীন আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ইতিহাসের বাতাস ফিসফিস করে। চারপাশে দেয়াল, টাওয়ার আর গ্রন্থাগারের জানালা—সবই যেন গোপন গল্প বলে।
সেই আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো—আমি কি সত্যিই সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে নিউটন আকাশের রহস্য মাপতেন? যেখানে ডারউইন লিখেছিলেন Origin of Species? যেখানে অ্যালান টুরিং আধুনিক কম্পিউটারের বীজ বুনেছিলেন? যেখানে স্টিফেন হকিং ব্ল্যাক হোল ও কোসমোলজির জটিল রহস্য উন্মোচন করেছেন। এখানে জন্ম হয়েছে বার্ট্রান্ড রাসেল—যৌক্তিকতার আলো ছড়ানো দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ; এখানে হেঁটেছেন অমর্ত্য সেন, কল্যাণ অর্থনীতির পথিকৃৎ এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ; মুহম্মদ আবদুস সালামের পদক্ষেপ রেখেছে পদার্থবিজ্ঞানের অমর ছাপ; ট্যাংগ সিউয়েন লিউ কেমিস্ট্রির রহস্য উন্মোচনের স্বপ্ন দেখেছেন; ফ্রিডা নাসের সমাজে নতুন উদ্ভাবন গড়েছেন, আর ডেভিড আয়ানগারের হাত ছুঁয়েছে আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির আকাশ।
আমি তাদের ছায়ার মধ্য দিয়ে হাঁটছি, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে জ্ঞান ও অন্বেষার নলেজে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ভাবছি, কীভাবে এক আপেলের মতো সাধারণ প্রশ্নও জন্ম দিতে পারে মহাকাশ কাঁপানো উত্তর। হ্যাঁ, আমি ঠিক সেই ইতিহাসের উঠোনে দাঁড়িয়েছি। এখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম—জ্ঞান কেবল বইয়ের পাতায় নয়, বরং প্রশ্নের স্রোত, অনুসন্ধানী মন এবং সাহসী কল্পনার মধ্যে জন্ম নেয়।
প্রায় ১৪০টিরও বেশি দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। বাংলাদেশ থেকেও বহু তরুণ-তরুণী এখানে অধ্যয়ন করছেন। ক্যামব্রিজে অধ্যয়ন করেছেন তাওফিক হাসান, ন্যানোইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে গ্রাফিন সেন্টারের অধ্যাপক; জোবেদা আলী, ইতিহাসে স্নাতকোত্তর অর্জন করে সমাজকর্মী ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা; অর্থনীতিবিদ মাহদী আমিন, লন্ডনের SOAS বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক; আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ নিহাদ কবীর; চিকিৎসাবিজ্ঞানে পিএইচডি সম্পন্ন মুসতাক হোসেন খানও ক্যামব্রিজের গর্ব।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। ভারতের ইতিহাসবিদ জয় চ্যাটার্জি, পার্থ দাসগুপ্ত, শ্রীলঙ্কার সুজিত শিবসূন্দরাম, মানালি দেশাই ও সৌম্যা বলসারি ক্যামব্রিজের আঙিনায় নিজেদের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
ক্যামব্রিজের ছাত্ররা শুধু একাডেমিক মেধা দিয়ে নয়, খেলাধুলা, সেলিব্রিটি ও মানবিক কর্মকাণ্ডেও বিশ্বে গৌরব অর্জন করেছেন। প্রিন্স উইলিয়াম রাজকীয় ও মানবিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়; বিশ্বখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় সির রজার ফেডারার ক্রীড়া ও মানবিক কাজে অনন্য অবদান রেখেছেন।
ট্রিনিটি কলেজের আঙিনায় দাঁড়িয়ে আমার দৃষ্টি আটকালো এক আপেল গাছের দিকে। কথিত আছে, এক শরতের বিকেলে তরুণ নিউটন উঠে বসেছিলেন। হঠাৎ একটি আপেল মাটিতে পড়ল। অন্য কেউ হয়তো কেবল ফলটা কুড়িয়ে নিত, কিন্তু নিউটনের কৌতূহল জাগল—“কেন সোজা নিচে পড়ল? কেন আকাশের দিকে উড়ল না?” সেই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নিল মহাকর্ষ সূত্র। একটি আপেল, একটি সাধারণ প্রশ্ন—কিন্তু তার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল পৃথিবী কাঁপানো উত্তর।
ক্যামব্রিজে শিক্ষা মানে কেবল পাঠ্যসূচি শেষ করা নয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রাণবন্ত আলাপ, যুক্তি-তর্ক, খণ্ডন আর নতুন ভাবনার জন্ম দেওয়াই মূল চর্চা। “সুপারভিশন সিস্টেম” নামে পরিচিত শিক্ষাপদ্ধতিতে প্রতিটি ছাত্রকে চ্যালেঞ্জ করা হয় ভাবতে, প্রশ্ন তুলতে, এমনকি শিক্ষককেও খণ্ডন করতে। এটি শিক্ষার্থীদের শুধু তথ্য নয়, চিন্তার স্বাধীনতা দেয়, যা সৃষ্টিশীলতার মূল চাবিকাঠি।
জীববিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ন্যানোটেকনোলজি, জলবায়ু পরিবর্তন—প্রতিটি অগ্রযাত্রার পেছনে আছে ক্যামব্রিজের গবেষকদের হাতছানি। গ্রন্থাগারগুলো কেবল বইয়ের ভাণ্ডার নয়, বরং স্বপ্নের কারখানা, যেখানে ইতিহাস ও আধুনিকতার মিলনে জ্ঞান জন্ম নেয়।
ক্যামব্রিজের শৃঙ্খলা ও গবেষণার উন্মাদনা দেখে চোখে ভেসে উঠল বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছবি। সেখানে শিক্ষার চেয়ে প্রায়ই রাজনীতি বড় হয়ে দাঁড়ায়। বিতর্ক, নাটক, ক্রীড়া, উদ্ভাবন—সবই গৌণ। গবেষণা প্রায় স্তব্ধ। প্রশ্ন করা? অনেক সময় সেটিই অপরাধ মনে হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একদিন স্বপ্ন দেখেছিল জ্ঞানের বাতিঘর হবে, কিন্তু বাস্তবে তা ক্ষমতার আস্তানা হয়ে গেছে।
প্রথমত, গবেষণাকে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। দ্বিতীয়ত, মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে সৃজনশীলতা ও অনুসন্ধিৎসাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষার পথে রাজনীতির অনধিকার প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। তাহলেই হয়তো কোনো একদিন বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়ও পড়বে এক আপেল, আর সেখান থেকেই জন্ম নেবে নতুন জাগরণের গল্প।
ক্যাম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম—শিক্ষা আসলে কী? কেবল ডিগ্রি পাওয়া? নাকি আলোর প্রদীপ, যা অজ্ঞতার অন্ধকার কাটিয়ে দেয়? ক্যামব্রিজ প্রমাণ করেছে—একটি প্রতিষ্ঠান যদি জ্ঞানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়, তবে তা কেবল একটি দেশের নয়, সমগ্র পৃথিবীর গর্ব হয়ে উঠতে পারে। একটি আপেলের পতন যেমন মহাকর্ষ সূত্রের জন্ম দিয়েছিল, তেমনি একদিন বাংলার তরুণও আবিষ্কার করবে নতুন কিছু, যদি পায় স্বাধীন চিন্তার মুক্ত আকাশ।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ইংল্যান্ডের গৌরব নয়; এটি মানবসভ্যতার উত্তরাধিকার। বাংলাদেশি তরুণদের জন্য এটি এক প্রেরণার বাতিঘর। আমাদের যদি থাকে প্রশ্ন করার সাহস, গবেষণার প্রতি শ্রদ্ধা, আর মুক্ত চিন্তার পরিবেশ, তবে একদিন পৃথিবীর মানুষ বলবে—“এটাই বাংলার ক্যামব্রিজ—যেখানে জন্ম নেয় মেধা, আর আলো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।”
ক্যাম নদীর জল বয়ে চলেছে শান্তভাবে, বিকেলের নরম আলোয় ঝলমল করছে নদীর বুক। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে—শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্ঞান যে স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে, সেই স্রোতের সঙ্গে আমার হাত মেলানো হয়ে গেল। চোখে শুধু ইট-পাথরের দেয়াল নয়, বরং গথিক খিলান, প্রাচীন টাওয়ার আর গ্রন্থাগারের জানালা। প্রতিটি দেয়াল যেন ফিসফিস করে বলছে—“আমরা জ্ঞানের সাক্ষী, যুগ থেকে যুগে আলো বয়ে এনেছি।”
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল বিদ্যাপীঠ নয়, এটি এক চলমান জ্ঞানের যাদুঘর। ১২০৯ সালে কয়েকজন বিদ্রোহী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড ত্যাগ করে যাত্রা শুরু করেন। ১২৩১ সালে রাজা হেনরি তৃতীয় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন, ১২৯০ সালে পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। তারপর থেকে একটানা আলোর স্রোত বইছে। আজ এখানে ৩১টি কলেজ রয়েছে, যেন ৩১টি বাতিঘর, যেখানে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হচ্ছে জ্ঞানের আলো।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বজুড়ে অজস্র মনীষী ও শিক্ষার্থীর জন্মদাতা। আমি সেই প্রাচীন আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ইতিহাসের বাতাস ফিসফিস করে। চারপাশে দেয়াল, টাওয়ার আর গ্রন্থাগারের জানালা—সবই যেন গোপন গল্প বলে।
সেই আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো—আমি কি সত্যিই সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে নিউটন আকাশের রহস্য মাপতেন? যেখানে ডারউইন লিখেছিলেন Origin of Species? যেখানে অ্যালান টুরিং আধুনিক কম্পিউটারের বীজ বুনেছিলেন? যেখানে স্টিফেন হকিং ব্ল্যাক হোল ও কোসমোলজির জটিল রহস্য উন্মোচন করেছেন। এখানে জন্ম হয়েছে বার্ট্রান্ড রাসেল—যৌক্তিকতার আলো ছড়ানো দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ; এখানে হেঁটেছেন অমর্ত্য সেন, কল্যাণ অর্থনীতির পথিকৃৎ এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ; মুহম্মদ আবদুস সালামের পদক্ষেপ রেখেছে পদার্থবিজ্ঞানের অমর ছাপ; ট্যাংগ সিউয়েন লিউ কেমিস্ট্রির রহস্য উন্মোচনের স্বপ্ন দেখেছেন; ফ্রিডা নাসের সমাজে নতুন উদ্ভাবন গড়েছেন, আর ডেভিড আয়ানগারের হাত ছুঁয়েছে আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির আকাশ।
আমি তাদের ছায়ার মধ্য দিয়ে হাঁটছি, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে জ্ঞান ও অন্বেষার নলেজে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ভাবছি, কীভাবে এক আপেলের মতো সাধারণ প্রশ্নও জন্ম দিতে পারে মহাকাশ কাঁপানো উত্তর। হ্যাঁ, আমি ঠিক সেই ইতিহাসের উঠোনে দাঁড়িয়েছি। এখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করলাম—জ্ঞান কেবল বইয়ের পাতায় নয়, বরং প্রশ্নের স্রোত, অনুসন্ধানী মন এবং সাহসী কল্পনার মধ্যে জন্ম নেয়।
প্রায় ১৪০টিরও বেশি দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। বাংলাদেশ থেকেও বহু তরুণ-তরুণী এখানে অধ্যয়ন করছেন। ক্যামব্রিজে অধ্যয়ন করেছেন তাওফিক হাসান, ন্যানোইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করে বর্তমানে গ্রাফিন সেন্টারের অধ্যাপক; জোবেদা আলী, ইতিহাসে স্নাতকোত্তর অর্জন করে সমাজকর্মী ও ডকুমেন্টারি নির্মাতা; অর্থনীতিবিদ মাহদী আমিন, লন্ডনের SOAS বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক; আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ নিহাদ কবীর; চিকিৎসাবিজ্ঞানে পিএইচডি সম্পন্ন মুসতাক হোসেন খানও ক্যামব্রিজের গর্ব।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। ভারতের ইতিহাসবিদ জয় চ্যাটার্জি, পার্থ দাসগুপ্ত, শ্রীলঙ্কার সুজিত শিবসূন্দরাম, মানালি দেশাই ও সৌম্যা বলসারি ক্যামব্রিজের আঙিনায় নিজেদের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
ক্যামব্রিজের ছাত্ররা শুধু একাডেমিক মেধা দিয়ে নয়, খেলাধুলা, সেলিব্রিটি ও মানবিক কর্মকাণ্ডেও বিশ্বে গৌরব অর্জন করেছেন। প্রিন্স উইলিয়াম রাজকীয় ও মানবিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়; বিশ্বখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় সির রজার ফেডারার ক্রীড়া ও মানবিক কাজে অনন্য অবদান রেখেছেন।
ট্রিনিটি কলেজের আঙিনায় দাঁড়িয়ে আমার দৃষ্টি আটকালো এক আপেল গাছের দিকে। কথিত আছে, এক শরতের বিকেলে তরুণ নিউটন উঠে বসেছিলেন। হঠাৎ একটি আপেল মাটিতে পড়ল। অন্য কেউ হয়তো কেবল ফলটা কুড়িয়ে নিত, কিন্তু নিউটনের কৌতূহল জাগল—“কেন সোজা নিচে পড়ল? কেন আকাশের দিকে উড়ল না?” সেই প্রশ্ন থেকেই জন্ম নিল মহাকর্ষ সূত্র। একটি আপেল, একটি সাধারণ প্রশ্ন—কিন্তু তার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল পৃথিবী কাঁপানো উত্তর।
ক্যামব্রিজে শিক্ষা মানে কেবল পাঠ্যসূচি শেষ করা নয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রাণবন্ত আলাপ, যুক্তি-তর্ক, খণ্ডন আর নতুন ভাবনার জন্ম দেওয়াই মূল চর্চা। “সুপারভিশন সিস্টেম” নামে পরিচিত শিক্ষাপদ্ধতিতে প্রতিটি ছাত্রকে চ্যালেঞ্জ করা হয় ভাবতে, প্রশ্ন তুলতে, এমনকি শিক্ষককেও খণ্ডন করতে। এটি শিক্ষার্থীদের শুধু তথ্য নয়, চিন্তার স্বাধীনতা দেয়, যা সৃষ্টিশীলতার মূল চাবিকাঠি।
জীববিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ন্যানোটেকনোলজি, জলবায়ু পরিবর্তন—প্রতিটি অগ্রযাত্রার পেছনে আছে ক্যামব্রিজের গবেষকদের হাতছানি। গ্রন্থাগারগুলো কেবল বইয়ের ভাণ্ডার নয়, বরং স্বপ্নের কারখানা, যেখানে ইতিহাস ও আধুনিকতার মিলনে জ্ঞান জন্ম নেয়।
ক্যামব্রিজের শৃঙ্খলা ও গবেষণার উন্মাদনা দেখে চোখে ভেসে উঠল বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছবি। সেখানে শিক্ষার চেয়ে প্রায়ই রাজনীতি বড় হয়ে দাঁড়ায়। বিতর্ক, নাটক, ক্রীড়া, উদ্ভাবন—সবই গৌণ। গবেষণা প্রায় স্তব্ধ। প্রশ্ন করা? অনেক সময় সেটিই অপরাধ মনে হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একদিন স্বপ্ন দেখেছিল জ্ঞানের বাতিঘর হবে, কিন্তু বাস্তবে তা ক্ষমতার আস্তানা হয়ে গেছে।
প্রথমত, গবেষণাকে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। দ্বিতীয়ত, মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে সৃজনশীলতা ও অনুসন্ধিৎসাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষার পথে রাজনীতির অনধিকার প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। তাহলেই হয়তো কোনো একদিন বাংলার বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়ও পড়বে এক আপেল, আর সেখান থেকেই জন্ম নেবে নতুন জাগরণের গল্প।
ক্যাম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম—শিক্ষা আসলে কী? কেবল ডিগ্রি পাওয়া? নাকি আলোর প্রদীপ, যা অজ্ঞতার অন্ধকার কাটিয়ে দেয়? ক্যামব্রিজ প্রমাণ করেছে—একটি প্রতিষ্ঠান যদি জ্ঞানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়, তবে তা কেবল একটি দেশের নয়, সমগ্র পৃথিবীর গর্ব হয়ে উঠতে পারে। একটি আপেলের পতন যেমন মহাকর্ষ সূত্রের জন্ম দিয়েছিল, তেমনি একদিন বাংলার তরুণও আবিষ্কার করবে নতুন কিছু, যদি পায় স্বাধীন চিন্তার মুক্ত আকাশ।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ইংল্যান্ডের গৌরব নয়; এটি মানবসভ্যতার উত্তরাধিকার। বাংলাদেশি তরুণদের জন্য এটি এক প্রেরণার বাতিঘর। আমাদের যদি থাকে প্রশ্ন করার সাহস, গবেষণার প্রতি শ্রদ্ধা, আর মুক্ত চিন্তার পরিবেশ, তবে একদিন পৃথিবীর মানুষ বলবে—“এটাই বাংলার ক্যামব্রিজ—যেখানে জন্ম নেয় মেধা, আর আলো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।”
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন