ডার্ক মোড
Tuesday, 26 August 2025
ePaper   
Logo
নাট্যমঞ্চে গণতন্ত্র, পেছনে ভূতের ছায়া

নাট্যমঞ্চে গণতন্ত্র, পেছনে ভূতের ছায়া

 

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক

প্রাচীন এক নাট্যমঞ্চ আছে, যার মঞ্চপট বদলালেও কাহিনি বদলায় না। কেবল চরিত্র বদলায়, সংলাপ পাল্টায়, আলোর রঙ ঘোরে। এই নাট্যমঞ্চের নাম—বাংলাদেশ। আর এখানে প্রতি কয়েক বছরে একবার, কোনো না কোনো ‘অদৃশ্য পরিচালক’ চুপিচুপি এসে চিত্রনাট্য বদলে দিয়ে যায়। জনতার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় পাণ্ডুলিপির শেষ পাতাটা—যেখানে লেখা থাকে, কে হবে তাদের নেতা।

এবারও সেই পরিচিত গন্ধ। বাতাসে ভাসছে “১/১১”-এর পুরোনো ঘ্রাণ, যেন কারো পোশাকে আজও লেগে আছে সেই জরুরি রাতের ধুলো। বিদেশি সংস্থার রিপোর্টে, অলিতে-গলিতে কফিশপে, সামাজিক মাধ্যমে অদৃশ্য কেউ ফিসফিস করে বলে—“তৃতীয় শক্তি আসছে!” অথচ কেউ বলছে না তারা কারা, কেন আসছে, কার নির্দেশে আসছে। যেন গণতন্ত্র একটি ভূতুড়ে বাড়ি, দরজায় তালা থাকলেও জানালায় ঢোকার রাস্তা সবসময় খোলা।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির কথাই ধরা যাক। বলা হয়েছিল, নির্বাচন হবে না, আগে দেশ ‘পরিষ্কার’ হবে। এরপর এলো এক অদ্ভুত সরকার—না নির্বাচিত, না দায়বদ্ধ। বলা হলো, ‘সংস্কার’ দরকার। এক বিশাল ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালিয়ে ফেলা হলো, যেন রাজনীতিবিদরা সবাই ‘সংক্রমিত’, আর দেশ চালানোর একমাত্র উপযুক্তরা হলেন কেরানি, কনসালট্যান্ট আর কিছু স্বর্ণচূড়া এনজিও-শাসিত মুখপাত্র।

এই শুদ্ধির ফলাফল কী? দু’লক্ষ মামলা, কিন্তু বিচারহীনতা। মিছিলের বদলে মিডিয়া ট্রায়াল। ব্যালটের বদলে ব্যারাকে বসে রাষ্ট্র পরিচালনা। জনগণের ইচ্ছা ‘অনুপস্থিত’ দাখিল।

এই “১/১১” আসলে একটি মানসিক ছত্রাক, যা গণতন্ত্রের শরীরে একবার ঢুকলে তাকে ধীরে ধীরে নিঃসাড় করে ফেলে। এরা হাত ধরে ‘পরামর্শ’ দেয়, মুখে ‘উন্নয়ন’ বলে, কিন্তু পেছনে ছুরি চালায় রাষ্ট্রের হৃদয়ে—সংবিধানে।

আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে সেই ভূতের পদচিহ্ন আবার দেখা যাচ্ছে। আবার বলা হচ্ছে, ‘পরিবেশ নেই’, ‘নেতৃত্ব নেই’, ‘জনগণ জানে না’। ঠিক যেন কেউ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আবার সেই পুরনো নাটক মঞ্চস্থ করতে—যেখানে জনগণ কেবল দর্শক, ভোট নয়, নাটকই শেষ কথা।

তবে এখনকার ভূতের পোশাক একটু আধুনিক। তারা টুইটার-নির্ভর, হিউম্যান রাইটস নির্ভর, বা ইউরোপিয় সেমিনারের থিসিসনির্ভর। তারা নিজেরা রাজনীতিবিদ নয়, কিন্তু সবাইকে শেখান রাজনীতি কেমন হওয়া উচিত। তারা মিছিল করতে জানে না, ভোট চায় না—তবে দেশের নেতৃত্ব নির্ধারণে মতামত দেওয়াটা যেন তাদের মৌলিক অধিকার।

এদের কেউ কেউ ভদ্র চেহারার গণতন্ত্রপ্রেমী, কেউ কেউ আবার এনজিওবৃদ্ধ, কেউ কনসালট্যান্টের স্যুটে বসে করেন দেশসংস্কার। তারা বলেন, “নতুন মুখ চাই”—কিন্তু সে মুখ আসে বিদেশি প্রশিক্ষণে ঘষা খেয়ে। তারা বলেন, “নির্বাচনে অংশ নেব না”—কারণ তাদের ধারণা, ব্যালট নয়, বরং বিদেশি প্রেস রিলিজই একমাত্র বৈধতা।

এখনকার কথিত 'তৃতীয় শক্তি' কারা? তারা কেউ জনতার মাঠে নেই, ভোটের লাইনে নেই। কিন্তু তারা ‘অংশগ্রহণ’ চায়—প্যানেল আলোচনায়। তারা 'সমাধান' চায়—বিনা ভোটে, সরাসরি উচ্চ আদালত বা উচ্চ কমিশনের ‘আশীর্বাদে’। তাদের কাছে গণতন্ত্র মানে একটি সুন্দর প্রেজেন্টেশন, কিছু দুর্নীতির পরিসংখ্যান, আর উন্নয়নের সুন্দর চার্ট।

তারা জিজ্ঞাসা করে না, মানুষ কী চায়। তারা বলে, জনগণ জানে না তারা কী চায়। তারা বলে, নেতৃত্বের সংকট আছে—যেন তারাই সেই "ডেলিভারি গাই" যারা নতুন নেতৃত্ব পৌঁছে দেবে প্যাকেজিংসহ।

কিন্তু তারা ভুলে যায়, গণতন্ত্রের সরল পাঠ—নেতৃত্ব আসে ভোটে, আলোচনা নয়। ক্ষমতা আসে জনগণের ইচ্ছা থেকে, লবিং থেকে নয়। কেউ চাইলে ভুলও করতে পারে, কিন্তু সেই ভুল সংশোধনের রাস্তা একটাই—আরও ভালো ভোট, আরও বেশি সচেতনতা, আরও বেশি গণযোগাযোগ।

‘এক-এগারো’ আবার আসতে চায়, এটা তাদের ভয় থেকেই। তারা জানে, একবার জনগণ জেগে উঠলে, মুখোশ খুলে ফেললে, সেই ভূতের স্থান হবে শুধু ইতিহাসের জাদুঘরে। আর জনগণের শক্তি একবার ফেরত এলে—তৃতীয় শক্তির দাওয়াত খারিজ হয়ে যাবে, চিরতরে।

আমরা ভুল করতে পারি, কিন্তু ভুল শুধরাতে হলে দরকার জনতার অংশগ্রহণ, পরিস্কার ব্যালট, আর স্বচ্ছ নেতৃত্ব। নাটক নয়, বাস্তব। ভূতের গল্প নয়, সত্য।

গণতন্ত্র এক চিরন্তন সাহসের নাম। সেটি যদি আবার ফিরে আসে—ভূতেরা পালাবে, মুখোশ পড়া লোকেরা চুপ হবে, আর রাষ্ট্রের নাট্যমঞ্চে অভিনয় করবেন একমাত্র সত্য নায়ক—জনগণ

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজচিন্তক 

ইমেইল - fokoruddincse@gmail.com

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন