
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি রাষ্ট্রের উপেক্ষা: ঝুঁকি ভাতা ও রেশনিং সুবিধার বৈষম্য কেন
মনিরুজ্জামান মনির
দায়ের চেয়েও ধারালো বৈষম্য:
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা, সুরক্ষা ও সেবার প্রয়োজনে যারা সম্মুখভাগে দায়িত্ব পালন করেন, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বও ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, কিছু নির্দিষ্ট বাহিনী বা বিভাগ বরাবরই অবহেলার শিকার হয়ে এসেছে। এই অবিচারের জ্বলন্ত উদাহরণ—বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী।
এক সময় দেশের প্রধান পরিবহন মাধ্যম ছিল রেলপথ। আজও এটি দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশেষত পণ্য পরিবহন ও নিম্নআয়ের মানুষের যাতায়াতে প্রধান নির্ভরতা। এই রেলব্যবস্থার নিরাপত্তা, সম্পদ সংরক্ষণ, ট্রেন চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষা এবং যাত্রীদের নিরাপদ চলাচলের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই কাজ করছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী। অথচ, পুলিশের সমতুল্য দায়িত্ব পালন করেও এই বাহিনী ঝুঁকি ভাতা এবং রেশনিং সুবিধা পায় না—এটি শুধু অবিচার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতির চোখে লজ্জার বিষয়।
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী: আইন ও দায়িত্বের কাঠামো-
২০১৬ সালের “বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আইন” অনুসারে, এই বাহিনী একটি সংবিধিবদ্ধ শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে স্বীকৃত। আইন অনুযায়ী, বাহিনীর সদস্যরা রেলপথ, স্টেশন, গুদামঘর, ট্রেনসহ রেলওয়ের যাবতীয় স্থাপনাকে চোরাচালান, নাশকতা, অগ্নিকাণ্ড, টিকিট কালোবাজারি ও অন্যান্য অপরাধ থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তারা নিয়মিত টহল, দুর্ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজ, রাতভর ডিউটি, দূর্গম স্টেশন এলাকায় অবস্থান এবং জরুরি অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। তবে রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে এই ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বপালনের কোনো আর্থিক কিংবা মর্যাদাগত স্বীকৃতি নেই।
চারবার আবেদন, চারবার প্রত্যাখ্যান: অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীরব বর্বরতা:
গত পাঁচ বছরে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে যৌথভাবে চারবার রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ঝুঁকি ভাতা অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু প্রতিবারই “অর্থনৈতিক সঙ্কট” এর অজুহাতে তা নাকচ করে দেওয়া হয়।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে, একই সময়ে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, এমনকি কারা বিভাগেও ঝুঁকি ভাতা চালু রয়েছে এবং ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাহলে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী কেন এই বৈষম্যের শিকার?
এই অবহেলা শুধু প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যই নয়, এটি একটি স্পষ্ট সাংবিধানিক লঙ্ঘন।
রেশনিং সুবিধা: দায়িত্ব পালনকারীর প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব:
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ট্রেনে, দুর্গম স্টেশনে, কিংবা অনির্ধারিত দুর্যোগে দায়িত্ব পালন করেন। এসব স্থানে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সহজলভ্যতা নেই। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জন্য রেশনিং সুবিধা চালু করা হয়নি। পুলিশ, বিজিবি, আনসার এসব সুবিধা ভোগ করে থাকলেও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে বঞ্চিত রাখা সত্যিই অমানবিক। এতে বাহিনীর সদস্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে, কর্মস্পৃহা হ্রাস পায়, যা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে।
সংবিধান ও শ্রম আইনের দৃষ্টিতে এই অবিচার অবৈধ:
বাংলাদেশের সংবিধানের ২০(১) অনুচ্ছেদ বলছে: “কাজ প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একটি পবিত্র দায়িত্ব, আর প্রত্যেক কর্মীর ন্যায্য অধিকার রয়েছে ন্যায্য পারিশ্রমিক, নিরাপদ পরিবেশ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের।”
এছাড়া বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা (ঝুঁকি ভাতা, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, স্বাস্থ্য সুবিধা) প্রদান বাধ্যতামূলক। তাহলে রাষ্ট্র কেন এ নিয়ম রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বেলায় মানে না?
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে পোষ্য সোসাইটির আহ্বান:
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি মনে করে, এটি ন্যায় ও মর্যাদার প্রশ্ন। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী শুধুমাত্র একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়—তারা আইনগত ক্ষমতাসম্পন্ন ফৌজদারি অপরাধ তদন্তকারী একক বাহিনী। বাংলাদেশ পুলিশ ব্যতীত যেকোনো বাহিনীর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত (inherent) অপরাধ তদন্ত ক্ষমতা একমাত্র এই বাহিনীর রয়েছে। তারা বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, মামলা তদন্ত, আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনার ক্ষমতাসম্পন্ন। এমনকি বাহিনীর শূন্যপদে অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরাও কাজ করেন, যারা নিয়মিত ঝুঁকি ভাতা ও রেশন পান। তাহলে মূল বাহিনী কেন বঞ্চিত?
পোষ্য সোসাইটির দাবি:
১. অবিলম্বে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ঝুঁকি ভাতা চালু করতে হবে।
২. রেশনিং সুবিধা চালু করতে হবে।
৩. পেশাগত মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা সমতায় আনতে হবে।
৪. বাহিনীর জন্য নিজস্ব নিয়োগবিধি, পোশাক, অস্ত্র, যানবাহন ও সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে।
অবহেলার অবসান চাই, মর্যাদার পুনরুদ্ধার চাই:
একটি পেশাদার বাহিনীর প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা মানে সেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোকে দুর্বল করা। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী “বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী আইন, ২০১৬”-এর ধারা ৪(৩) অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনীর মর্যাদা লাভ করেছে। তাই তাদের প্রতি এই বৈষম্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্র যদি এই বৈষম্য অব্যাহত রাখে, তবে তা হবে নৈতিক দেউলিয়াত্ব এবং সাংবিধানিক বিধানের চরম ব্যত্যয়। এ অবস্থায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি রেলওয়ে মহাপরিচালক, রেলপথ সচিব, এবং অর্থ সচিব বরাবর স্মারকলিপি প্রদান এবং রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি আকর্ষণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
আমরা প্রত্যাশা করি—বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে পূর্ণ মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্র একটি ন্যায়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট