
ট্রাফালগার স্কয়ার: ইতিহাস, প্রতিবাদ ও বৈচিত্র্যের স্পন্দন
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ট্রাফালগার স্কয়ার শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়—এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও নাগরিক চেতনার এক সম্মিলিত প্রতীক। প্রতিদিন হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখরিত এই চত্বর যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস, যেখানে যুগে যুগে আঁকা হয়েছে বিজয়ের গৌরব, প্রতিবাদের আগুন, আর বৈচিত্র্যময় মানবিকতার রঙিন রেখাচিত্র।
গতকাল ট্রাফালগার স্কয়ার ঘুরে এসেই এই কলাম লিখতে বসলাম। ঘুরে যা উপলব্ধি হলো তা হলো মূলত এটি ১৮০৫ সালের 'Battle of Trafalgar'-এর স্মরণে নামকরণ করা এই স্কয়ার ব্রিটিশ নৌবাহিনীর এক ঐতিহাসিক বিজয়ের সাক্ষ্য বহন করে। নেপোলিয়নের ফরাসি-স্প্যানিশ যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে অ্যাডমিরাল হোরেশিও নেলসনের নেতৃত্বে এই যুদ্ধ জয় ইউরোপে ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় তৈরি করে। স্কয়ারের কেন্দ্রে স্থাপিত ৫৬ মিটার উঁচু নেলসন কলাম এবং তার চারপাশে থাকা বিশাল ব্রোঞ্জের সিংহমূর্তিগুলো ইতিহাসের সেই বীরগাথার নীরব ভাষ্য।
তবে ইতিহাসের গর্বিত গৌরব ছাড়িয়ে ট্রাফালগার স্কয়ার আজ হয়ে উঠেছে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের এক উন্মুক্ত মঞ্চ। এখানে জলবায়ু আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, মানবাধিকার রক্ষার জন্য বিশ্বজুড়ে চলমান নানা আন্দোলনের স্পন্দন প্রতিনিয়ত ধরা পড়ে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি, ইরানি নারীদের স্বাধীনতার দাবি কিংবা ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ—সবকিছুরই সাক্ষী এই স্কয়ার। এর বিশেষত্ব হলো—এখানে কোনো নির্দিষ্ট দলের চিহ্ন নেই, নেই বিভাজনের গণ্ডি; আছে কেবল সচেতন মানুষের কণ্ঠস্বর।
এই স্কয়ার যেন এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজের প্রতিচ্ছবি। এখানে মিলেমিশে থাকে সাদা-কালো, মুসলিম-খ্রিস্টান, আফ্রিকান-এশিয়ান, অভিজাত-বঞ্চিত সবাই। কেউ গিটার বাজায়, কেউ কবিতা পাঠ করে, কেউ নীরবে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। মতপ্রকাশের এই পরিসরকে ঘিরে যে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক আবহ তৈরি হয়, তা আজকের সময়ে বড়ই বিরল।
ট্রাফালগার স্কয়ারের আরেকটি পরিচয় তার সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ। এখানে পালিত হয় দিওয়ালি, হোলি, ঈদ, বড়দিন, এমনকি বাংলা নববর্ষের মতো উৎসবও। স্কটিশ ব্যাগপাইপের সাথে আফ্রিকান ড্রামস বা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সম্মিলন, নানা দেশের খাবারের স্টল, রঙিন পোশাকের মানুষের ভিড়—সব মিলিয়ে এটি এক বৈচিত্র্যময় মেলবন্ধন। বিশেষত ৩১ ডিসেম্বর রাত, যখন হাজারো মানুষ এখানে একত্রিত হয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়, তখন এটি যেন বিশ্বের ছোট সংস্করণ হয়ে ওঠে।
শুধু ইতিহাস বা সংস্কৃতি নয়, স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনার দিক থেকেও ট্রাফালগার স্কয়ার এক অনুকরণীয় উদাহরণ। এর খোলা আকাশ, পানি, ভাস্কর্য ও চলাচলের অবাধ ব্যবস্থা নাগরিক জীবনে শ্বাস নেওয়ার মতো অবকাশ এনে দেয়।অন্যদিকে আমাদের শহরগুলোয় খোলা স্থানগুলো আজ দখলদার, অস্থায়ী বাজার কিংবা যানজটের কবলে। মতপ্রকাশ বা প্রতিবাদ মানেই শাহবাগ কিংবা রাস্তা দখল ফলে পুলিশের বাঁধা, লাঠিচার্জ আর সরকারি খতিয়ানে ‘উগ্র’ পরিচিতি। অথচ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন উন্মুক্ত স্থান থাকা শুধু জরুরি নয়, এটি তার নৈতিক দায়িত্ব। প্রশ্ন আসে, বাংলাদেশে কি এমন কোনো জনতার স্কয়ার গড়ে তোলা সম্ভব নয়? যেখানে নাগরিকতা শুধুই জাতীয় পরিচয়পত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রকাশ পাবে চিন্তা, বাক, ও অভিব্যক্তির স্বাধীনতায়।
ট্রাফালগার স্কয়ার আমাদের শেখায়—একটি সমাজ কিভাবে একই জায়গায় ইতিহাস, প্রতিবাদ, উৎসব ও সহাবস্থানকে সম্মান করে। এটি বলে দেয়—যেখানে বহুস্বরের সম্মান আছে, সেখানেই গণতন্ত্রের শিকড় শক্ত হয়। আমরা যদি উদার, সহনশীল ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, তবে আমাদের প্রয়োজন এমন একটি স্কয়ার—যেখানে মানুষ শুধু হাঁটবে না, গাইবে, বলবে, ভাববে এবং অন্যকে জানবে যার ফলে একটি চত্বর ‘আমি’ আর ‘আপনি ’ থেকে হয়ে উঠবে ‘আমরা’।
লেখক, গবেষক ও সমাজচিন্তক
ইমেইল - fokoruddincse@gmail.com