ডার্ক মোড
Tuesday, 21 May 2024
ePaper   
Logo
‘বঙ্গবন্ধু ইশারা দিলেন যেন গাড়িতে উঠি’

‘বঙ্গবন্ধু ইশারা দিলেন যেন গাড়িতে উঠি’

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

সোহরাওয়ার্দী মাঠে গাড়িতে ঝুলেই গেলাম। সেখানে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তখন আর থাকতে পারিনি...’

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদার্পণের ক্ষণটি স্মরণ করে আবেগে আপ্লুত প্রফেসর মোস্তফা কামাল বলছিলেন কথাগুলো। তিনি জানান, হাজারো মানুষের ভিড় ঠেলে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু যেন দেখেন তিনি বেঁচে আছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণশক্তি বঙ্গবন্ধুর অবিচল নেতৃত্বে বাঙালি জাতি মরণপণ যুদ্ধ করে বাংলার বিজয় ছিনিয়ে আনে। পরাজিত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। একই দিন সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে তিনি লন্ডনে অবতরণ করেন। সেখানে কমনওয়েলথ মহাসচিবের আহ্বানে বাংলাদেশের সদস্যপদ গ্রহণে তাৎক্ষণিক সম্মতি জানান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সংবাদ সম্মেলন করেন।
জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লিতে যাত্রা বিরতি দিয়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বাংলার মাটিতে পদার্পণ করেন। ওই দিন রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রে এক ভাষণে তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন, সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা সংঘটনের দায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বিচারের মুখোমুখি করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি পাওয়া ও পরবর্তীতে দেশে আসার মুহূর্তটি স্মরণ করে মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল বলেন, সমস্ত বিশ্বব্যাপী একটা খবর চলে আসে রেডিওকে যে বঙ্গবন্ধু ছাড়া পেলো। অধীর আগ্রহে সবাই অপেক্ষা করছে। ছাড়া পেয়েই তিনি লন্ডনে চলে গেলেন। লন্ডন থেকে চলে আসলেন ইন্ডিয়াতে। ওখানে জনসভা করলেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। এই সময়টা আমরা উৎসুক জনতা যারা অধীর আগ্রহে ছিলাম সবাই তো... বঙ্গবন্ধু... বিকল্প তো কিছু নাই। সেই সুবাদে আমরা দলবেঁধে হেটে এয়ারপোর্ট চলে আসি। ৮ তারিখ কুমিল্লা থেকে রওনা দিয়ে পরদিন ঢাকায় পৌঁছি।
‘সেই সময়টা... আমার গায়ের লোম কাঁটা কাঁটা হয়ে গেলো। কী যে বলবো আপনাকে। ’
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটির ওই ক্ষণের স্মৃতিচারণ করে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মোস্তফা কামাল বলেন, বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নামলেন। আমরা দূর থেকে দেখছি যে বিমান নামতেছে। কতো লোকের ধাক্কাধাক্কি... ওনাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হলো। এরপর উনি ট্রাকে উঠবেন, কতো কষ্ট, ধাক্কাধাক্কি। একটু শক্তির তো প্রয়োজন ছিল। তখন তো একটু শক্তি ছিল।
‘আমার একটা চিন্তা-চেতনা ছিল যে, আমি বেঁচে আছি। এটা শুধু বঙ্গবন্ধুকে দেখাতে চেয়েছি (বলতে বলতে গলা ধরে আসে তার)। সেজন্য সামনে যাওয়ার একটা চেষ্টা ছিল। বেঁচে যখন আছি তখন অন্তত বঙ্গবন্ধু দেখুন যে, আমি বেঁচে আছি... (আবারও গলা ধরে আসে মোস্তফা কামালের)। ’
সেই সময়ের টগবগে যুবক কামাল বলেন, দুপুরের পর বঙ্গবন্ধু নামলেন। ট্রাকের সামনে গেলাম। আমার চেয়ে আরো শক্তিশালী আছে, আর্মি আছে, পুলিশ আছে, সিপাহি আছে। মুড়ির টিনের মতো ট্রাকের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
‘তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে... (মোবাইলের ওপ্রান্তে প্রায় ডুকরে কেঁদে ফেলেন মোস্তফা কামাল)। তিনি (বঙ্গবন্ধু) হাতে ইশারা দিচ্ছেন যেন সামনে উঠি আমি। আমি উঠে লটকে থাকলাম। যতগুলো ফুল বঙ্গবন্ধুর কাছে যাচ্ছে সবগুলো হাতের মধ্যে জড়িয়ে বহু কষ্টে ঝুলে ছিলাম। সোহরাওয়ার্দী মাঠে গাড়িতে ঝুলে গেলাম। সেখানে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো। তখন আর থাকতে পারিনি। জুতা কোথায় ছিঁড়ে পড়ে গেছে...। ’
সেদিনের সেই ছবিটি এলাকার এক সাংবাদিকের কাছে পেয়ছিলাম, নাম তার সিরাজুল ইসলাম। তিনি আমাকে চিনে ছবিটি দিয়েছিলেন, বলেন মোস্তফা কামাল।
কুমিল্লার বক্সনগরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এই মুক্তিযোদ্ধা। স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাইরে যেতে চাইলেও বঙ্গবন্ধু যেতে দেননি ঢাকা কলেজের এই ছাত্রকে।
সেই স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার স্যারকে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী বলেছিলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশ ছাড়া তাকে পার করতে পারব না। কারণ, সবাই দেখেছে আমি বঙ্গবন্ধুর নানা অ্যাসাইনমেন্ট করেছি।
তিনি বলেন, দু’দিন পর বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলাম, বিদেশ যাওয়া যখন হলো না তখন মন খারাপ কেন, বাইরে যাওয়ার জন্য সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু বললো যা..., আমি কি মরে গেছি— একথাটা এখনও আমার কানে বাজে। এরপর থেকে শিক্ষকতাই করছি।
সত্তর বছর বয়সী এই শিক্ষাবিদ ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন। আর বেশ কয়েকটি কলেজ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত ছিলেন। এখনও নানা জনকল্যাণমুখী কাজ করছেন।
২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিটিভিতে ‘আমাদের অহংকার’ নামে একটি প্রোগ্রাম করতেন, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেক্টর কমান্ডারদের সাক্ষাৎকার প্রচার হতো।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন