ডার্ক মোড
Saturday, 18 May 2024
ePaper   
Logo
শিবালয়ে কৃষি জমি নষ্ট করে খাল খনন দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রান্তিক কৃষকরা

শিবালয়ে কৃষি জমি নষ্ট করে খাল খনন দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রান্তিক কৃষকরা

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি

 

মানিকগঞ্জের শিবালয়ে ঐতিহ্যবাহী আরিচা কাশাদহ সেচ প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের আবাদী জমি বিনষ্ট করে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক অপরিকল্পিতভবে খাল খননের কারণে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। এতে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে সেচ প্রদান ব্যহত হচ্ছে এবং রোপনকৃত ধান আগাম বর্ষায় তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।এভাবে খাল খনন কাজ অব্যাহত থাকলে কৃষকদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশী। অপরিকল্পিত খাল খননের কারণে কৃষকের সারা বছরের খাবার ধান ঘরে তুলতে না পারার আশংকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অসহায় প্রান্তিক কৃষকরা। এতে এলাকায় খাদ্য সংকটসহ কৃষি বান্ধব সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকা করছেন অভিজ্ঞ মহল। এর প্রতিকার চেয়ে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ প্রান্তিক কৃষকরা।


অভিযোগে জানা গেছে, এবছর শিবালয় কাশাদহ সেচ প্রকল্পের আওতায় সকল জমিতে ধানের চারা রোপন সম্পন্ন করা হয়েছে। এসময় এমনিতেই প্রচুর পানি সেচের প্রয়োজন হয়। সে লক্ষ্যে কাশাদহ সেচ প্রকল্প যথাসময়ে তাদের সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এমতাবস্থায় জমিতে সেচ প্রদানের খালটি রংপুরের মো. হাসিবুল হাসান এক ঠিকাদারের নামে খনন কাজের ওয়ার্ক ওয়ার্ডার দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চার কিলোমিটার এ খাল খনন কাজের ব্যায় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।

খনন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার দু’টি স্কেভেটর (ভেকু) দিয়ে দুই পাড়ে কৃষকের জমিসহ খাল খনন করছেন। এতে কৃষকের আবাদকৃত ভুট্রা, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকের জমি রক্ষা এবং ফসলের ক্ষতিপুরণ দাবী জানিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা। এ পরিস্থিতিতে কৃষকের সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার উক্ত খনন কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে শিবালয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নের্তৃত্তে ঠিকারের লোকজন ও কৃষকদের নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের হল রুমে পরপর দুই দিন বৈঠকও হয়েছে। কিন্ত এতে কোন সুষ্ঠ সমাধান পায়নি স্থানীয় কৃষকরা। এভাবে খাল খনন অব্যাহত থাকলে এবছর ইরি-বোরো আবাদ করে আশানুরুপ ফলন না পাওয়ার আশংকা করছেন কৃষকরা। এছাড়া হাজার হাজার বিঘা আবাদী জমির ফসল বিনষ্ট এবং ভবিষতে অনেক জমি অনাবাদী থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে কৃষকরা চরম আতংকের মধ্যে রয়েছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে নি:স্ব হয়ে পথে বসার আশংকা করছেন এ এলাকার কৃষকরা । এতে একদিকে কৃষকের আবাদী জমির ফসল নষ্ট হয়ে যেমন চরম ক্ষতি হবে। অপরদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা অপচয় হবে বলে মন্তব্য করছেন স্থানীয়রা।
কোখাদি গ্রামের সুধাংশ কুমার দত্ত বলেন, কাশাদহ খালের পাড়ে স্কয়ার আকারে আমার ১শ’ শতাংশ জমিতে এবার ভুট্রার আবাদ করা হয়েছে। আমার ফসলি জমির কিছু অংশ জড়িয়ে খাল খনন করে খননকৃত সে মাটি আবার আমার জমিতেই রাখায় আবাদী ভুট্রা নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আমি দুই রকমের ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছি। একদিকে আমার পৈত্রিক জমির কিছু অংশ খালে চলে গেছে, অপরদিকে খননকৃত মাটি জমির উপর রাখায় আবাদী ফসল নষ্ট হয়েছে। গত বছর ওই জমিতে প্রায় ৬০মন ভুট্রা হয়েছিল। এবার এর অর্ধেকও হবে না। এ খাল খননের কারণে আমার বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এপর্যন্ত ক্ষতি পুরনের কোন আশ্বাসও পায়নি কারো কাছ থেকে।
একই গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য মো. মনির হোসেন বলেন, কাশাদহ খালের পাশে আমার ১শ’ ৯শতাংশ জমি রয়েছে। এ জমিতে প্রতিবছরের মতো এবারও মরিচ আর ভুট্রার আবাদ করা হয়েছে। জৈনক ঠিকাদার দু’টি ভেকু দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে খাল খননের কারণে আমার জমির প্রায় ১৫ ফুট কাটা পরেছে এবং বাকী ১৫ ফুট জমির মধ্যে মাটি ফেলা হয়েছে। এতে আমার আবাদী ফলস ভুট্রা ও মরিচের ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। গত বছর এ জমি থেকে প্রায় ৪০/৫০হাজার টাকা মরিচ বিক্রি করেছিলাম। এবার মনে হয় এক টাকারও মরিচ বিক্রি করতে পারবো না।


কোখাদি গ্রামের মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কৃষকদের ফসলি জমি নষ্ট করে অপরিকল্পিতভাবে খাল খননের কারণে জমির মালিকরা স্থানীয় আমিন দিয়ে পরিমাপ করলে দেখা গেছে, খালের কোথাও ৪৮ ও ৫৮ ফুট চওড়া রয়েছে। সেখানে খনন করা হচ্ছে ৭০ফুট। যে কারণে মানুষের ব্যাক্তিগত ফসলি জমি কাটা পড়ছে। এদিকে আবার খননকৃত খালের পাড়ও ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কৃষকরা। কাশাদহ খালের পাড়ে আমার ৯ শতাংশের একটি জমি রয়েছে। এতে এবার মরিচের আবাদ করা হয়েছিল। এর অর্ধেকের বেশী অংশ খালে চলে গেছে বাকীটুকো খননকৃত মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ফলে পুরো জমির ফসলই নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটি ৩৭শতাংশ জমিতে এবার মরিচের আবাদ করা হয়েছে। এ জমির অর্ধেকের বেশী অংশ কেটে খননকৃত মাটি জমির উপর রাখায় আবাদী ফসল মরিচ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে এবার আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি।


বোয়ালী গ্রামের কৃষক মো. ইয়াকুব শিকদার বলেন, যেহেতু আমাদের এ খালে সুইচ গেটের কোন ব্যবস্থা নেই। সেহেতু এবার বর্ষার আগে অতি সহজেই নদীর পানি ফসলি জমিতে ঢুকে ইরো-বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। গত বছর অতি বৃষ্টি কারণে বর্ষার আগেই ইছামতি নদীর পানি কাশাদহ খাল দিয়ে প্রবেশ করে আধাপাকা ধান তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এসময় শিবালয় ৩নং মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলাল উদ্দিন আলাল তাৎক্ষণিক খালের মাথায় মাটির বাঁধ দিয়ে তা প্রতিরোধ করেন। কিন্তু এবছর যেভাবে গভীর করে খাল খনন করা হয়েছে তাতে মাটির বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ প্রতিরোধ করে ফসল রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ফলে এবছর আগাম বর্ষায় কাশাদহ সেচ প্রকল্পের ইরি-বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার আশংকা করছেন। এতে এ এলাকার হাজার হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে তিনি জানান। আনুলিয়া গ্রামের কৃষক মো. পান্নু মিয়া বলেন, যেভাবে খাল খনন করা হচ্ছে এতে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হবো। এভাবে খাল খনন করলে আগাম বর্ষায় আমাদের ধান তলিয়ে যাবে। আমরা ধান ঘরে আনতে পারবো না।


কাশাদহ পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি’র সভাপতি মো. মশিউর রহমান আওয়াল বলেন, কাশাদহ সেচ প্রকল্পের আওয়তায় যমুনা নদী থেকে পানি উত্তোলনের করে ড্রেনের মাধ্যমে ইরি-বোরোর আবাদ করা হয়। এখানে প্রায় ১২টি গ্রামের মানুষ সুবিধা ভোগ করে। অপরিকল্পিতভাবে খাল খননের কারণে এবার এ এলাকার কৃষকরা তাদের ধান ঘরে তুলতে পারবে কিনা তা নিয়ে কৃষকরা সন্দিহান রয়েছেন। আমি একজন কৃষক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি পরিকল্পিতভাবে যেন খালটি খনন করা হয়। বর্তমানে যেভাবে খনন করা হচ্ছে তাতে মানুষের ব্যাক্তিগত জমি এবং ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। একই কারণে এবার অসময়ে জমিতে পানি ঢুকবে। এতে আমরা ভিশন ক্ষতিগ্রস্থ হবো। এর প্রতিকার চেয়ে শিবালয় উপজেলা নিবাহী অফিসার বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে।


এব্যাপারে শিবালয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার বি,এম রুহুল আমিন রিমন বলেন, বিষয়টি তিনি জানেন এবং কৃষকের জমি নষ্ট করে খাল খনন করা যাবেনা। সাময়িকভাবে খাল খনন কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সে প্রতিবেদন দেওয়ার পর পরবর্তি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এব্যাপারে শিবালয় ৩নং মডেল ইউপিনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, কৃষকের জমি রক্ষা করে সরকারী কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। যারা খাল খনন কাজ পর্যবেক্ষণ করবেন। খাল খননও হবে এবং কৃষকদের জমিও নষ্ট করতে দেওয়া যাবে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইন উদ্দিন বলেন, চার কিলোমিটার খালের একেক স্থানে একেক রকম রয়েছে, আর খালের জায়গাতেই ডিজাইন অনুযায়ী খাল খনন করা হচ্ছে। খাল খনন করতে গেলেতো একটু ক্ষতি হবেই। তবে ক্ষতি পুরুণ দেওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই বলে তিনি জানান।

 

 

শিবালয়ে কৃষি জমি নষ্ট করে খাল খনন দিশেহারা হয়ে পড়েছে প্রান্তিক কৃষকরা

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন