
হাজার বছরের ঐতিহ্যের স্মারক হান্ডিয়াল জগন্নাথ মন্দির
মামুন হোসেন, পাবনা
প্রাচীন স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলীতে সমৃদ্ধ জেলা পাবনা। আর এ জেলার অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ জনপদ হান্ডিয়াল। সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা এ অঞ্চলটি ঐতিহ্যবাহী চলনবিল, গুমানী ও করতোয়া নদীর পাশে অবস্থিত। সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এই অঞ্চলটিতে দেখা মেলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক মিল বন্ধন। চাটমোহর উপজেলায় অবস্থিত এই জনপদটির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
স্থানীয় ও বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, একসময়ে এই হান্ডিয়ালে ছিল ইংরেজদের নীলকুঠী, গোপীনাথের মন্দির, বিগ্রহ মন্দির, শেঠের বাংলো, জমিদার বাড়ি সহ নানান স্থাপনা। এবং ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ছিল থানা। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর বাংলা বিহার আট ভাগে বিভক্ত হলে হুগলি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয় হান্ডিয়াল। সংবাদ প্রভাকর ১২৬১ বঙ্গাব্দে ২৮ পৌষ সংখ্যায় উল্লেখ রয়েছে, পাবনা, নাজিরগঞ্জ, মথুরা, পাংশা, ধর্মপুর, কুষ্টিয়া, খোকসা ও হান্ডিয়াল থানার কথা।
বিভিন্ন তথ্য সুত্রে জানা যায়, এক সময় এ অঞ্চলটিতে পোড়ামাটির ভাস্কর্যের রমরমা ব্যবসা ছিল। সে সময়ে এই অঞ্চলটিতে প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা হতো মাটির হাঁড়ি। তখনকার সময়ে এলাকাটির নাম ছিল হাঁড়িয়াল। পরে ইংরেজদের উচ্চারণের সুবিধার্থে হাঁড়িয়াল'র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হান্ডিয়াল।
বিভিন্ন সুত্রে ও ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে উন্নত বন্দর ছিল এই হান্ডিয়ালে। সে সময় বন্দরটি ঘিরে ছিল নীল, রেশম ও তাঁত শিল্পের রমরমা ব্যবসা। জানা যায়, ভারতের ৪ ভাগের ৩ ভাগই নীল, রেশম ও তাঁত যেত এই অঞ্চল থেকে। এছাড়াও রেশম ও তুলা কিনতে ব্রিটিশরাও আসতো এই হান্ডিয়ালে। এছাড়াও মিষ্টির জন্যও সুখ্যাতি ছিল এই অঞ্চলের। এ অঞ্চলের গোয়ালদের (ঘোষ) হাতে বানানো মিষ্টি ইংরেজ সহ ভারতের দাদা-বাবুদের কাছেও ছিল বেশ জনপ্রিয়।
জানা যায়, একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে অঞ্চলটি এতটাই গুরুত্ব পায় যে, তারা এখানে বিশেষ পরগনা বানিয়ে কয়েকজন জমিদারকে ব্যবসা-বাণিজ্য সহ প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করে। এছাড়াও তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালেও প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য একজন সুবেদার ও একজন কাজী নিযুক্ত করা হয় এই অঞ্চলে। সেসময় শাহী সুবেদারদের অধীনে ছিল মুঘলদের ৫ হাজার সেনা ও সেনানিবাস।
এছাড়াও এই অঞ্চলটিতে অন্যান্য প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে মুসলিম স্থাপত্যর অন্যতম নির্দশন পীরে-কামেল হজরত শাহ মোখলেছুর রহমান (বুড়োপীর) সাহেবের পবিত্র মাজার শরীফ। জানা যায়, ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব জাহান থেকে কয়েকজন পীরে-কামেলের আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। এর মধ্যে ইরান প্রদেশের খোরাশানের বাদশা হজরত শাহ মোখলেছুর রহমান (রহ.) ওরফে বুড়া পীর সাহেব ছিলেন অন্যতম। মূলত তারা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যই এসেছিলেন এ সকল অঞ্চলে।
এছাড়াও রয়েছে, প্রাচীন ঐতিহ্যের আরেক অন্যতম স্থাপত্য জগৎ শেঠের বাংলো। এই বাংলোকে ঘিরে রয়েছে নানান কল্পকাহিনী। জানা যায়, লর্ড ক্লাইভ জগৎ শেঠকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন এই বাংলোটি। দু'চালা এই বাংলোটি চুন, সুরকি ও পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি। বাংলোটির গায়ে রয়েছে অসংখ্য দুর্লভ নকশা। এর পূর্ব পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক কুঠিবাড়ী। কোম্পানি আমলে এই কুঠিবাড়ী ঘাটে ছিল নৌবন্দর। কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মালবোঝাই বিশাল বিশাল বজরা নৌকা নোঙর ফেলত এই ঘাটে।
তবে ১২৯৪ বঙ্গাব্দে প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্পে এ জনপদের সব ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শেঠের বাংলো ও শ্রী শ্রী জগন্নাথ ধাম বিগ্রহ মন্দির। দেশের পুরাকীর্তি ও স্থাপনার মধ্যে অন্যতম পুরাতন স্থাপনা হান্ডিয়াল জগন্নাথ মন্দির যা আধুনিক যেকোনো স্থাপনার শৈল্পিক কারুকার্যকেও হার মানায়।
প্রত্নতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন, জগন্নাথ মন্দিরটি ১৫ শতকের শুরুর দিকে নির্মাণ হয়েছিল। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন মন্দিরটি ১৫৫০ সালের দিকে নির্মাণ হয়েছিল। তবে মন্দিরের গায়ে পাওয়া শিলালিপি অনুসারে জানা যায়, ১৫৯০ সালে ভবানীপ্রসাদ নামে জনৈক ব্যক্তি এই মন্দিরটি সংস্কার করেছিলেন। এই মন্দিরের বাইরের চারপাশে পোড়ামাটির ব্যাপক অলঙ্করণ করা রয়েছে এবং সুউচ্চ মিনারের গায়েও রয়েছে নানান নকশা।
এই মন্দিরটি এক দরজা বিশিষ্ট একটি মন্দির যা ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মঠটির উপরের দিকে সিঁড়ি ক্রমশই ছোট হয়ে গেছে। মন্দিরের আসনের দেয়ালে ট্যারাকোটার বিভিন্ন নকশা ও পুরো মঠটি একটি শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। পুরো মন্দিরটি চারদিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ করা ও এর পাশেই রয়েছে আরও দুটি মন্দির। বর্তমানে জগন্নাথ মন্দিরটিতে পূঁজা অর্চনা হয়ে থাকে। এই মন্দিরটিতে একটি মন্ডপ সহ রথও রয়েছে।
কথা হয়, সিরাজগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা দুলাল, নাটোর থেকে আসা উজ্জ্বল, নাটোর বড়াইগ্রাম থেকে আসা রাণী ঘোষ, সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়া থেকে আসা অর্পিতা সেন, পাবনা থেকে আসা অসীম বর্ণীক, উল্লাপাড়া থেকে আসা মাসুদ, শাহজাদপুর থেকে আসা জাহাঙ্গীর, তাড়াশ থেকে আসা আতিক, আটঘরিয়া থেকে আসা তামিমের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ছোট বেলা থেকেই শুনেছি এই জগন্নাথ মন্দিরের কথা, আজ নিজ চোখে এসে দেখলাম। প্রত্যান্ত এই অঞ্চলে এমন একটি মন্দির দেখে অবাক হয়েছি। তারা জানান, এই মন্দিরের উচ্চতা ও কারুকার্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে। শুধু মন্দির নয় অন্যান্য স্থাপনাগুলোও সংরক্ষণের দাবি জানান তারা।
স্থানীয়রা জানান, পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জের মিলনস্থলে অবস্থিত হান্ডিয়াল। তারা জানান, প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসে এই পুরাকীর্তি ও নির্দশন দেখতে। তারা জানান, আগে অনেকে নদী পথে আসলেও এখন শুকিয়ে যাওয়ায় সড়ক পথেই আসেন তারা।
তবে বর্তমানে চাটমোহর থেকে হান্ডিয়াল হামকুঁড়িয়া পর্যন্ত সড়কের বেহাল অবস্থা হওয়ায় দর্শনার্থীদের উপস্থিতি এখন অনকেটাই কমে গেছে বলে জানান তারা। বেদখল ও সংরক্ষণের অভাবে এ অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এখন অনেকটাই বিলীনের পথে বলে জানান তারা।
কথা হয়, হান্ডিয়াল জগন্নাথ মন্দির ও পূঁজা উদযাপন কমেটির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দীলিপ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে তিনি বলেন, এই জগন্নাথ বিগ্রহ মন্দিরটি প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ভক্তরামের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেন, ভক্তরাম জগন্নাথের দর্শন পেতে পুরীধামে যান। দূর্ভাগ্যবসত সেখানে মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, দেখা পান না তিনি। জগন্নাথের দেখা না পাওয়ায় কান্নাকাটি করতে থাকেন ভক্তরাম। তখন পাণ্ডাদের আদেশ দেন হান্ডিয়ালে দর্শন দিবেন জগন্নাথ। তখন ভক্তরাম কান্নাকাটি ছেড়ে হান্ডিয়ালের কোথায় দর্শন পাবেন বলে জানান তিনি। তখন শ্রোতমান খরস্রোতা করোতোয়া নদীতে মূর্তিমান রূপে ভাসমান অবস্থায় থাকবেন বলে জানান জগন্নাথ। সেখান থেকে তার মূর্তি নিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলেন তিনি। সেই সময়ে নির্মাণ করা মন্দিরটিই হান্ডিয়াল জগন্নাথ মন্দির বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, প্রথমে এই মন্দিরটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৭০ ফিট বর্তমানে এর উচ্চতা ৫০ ফিটেরও নীচে। তিনি বলেন, বংশপরম্পরায় এই মন্দিরটিতে সেবায়েত হিসেবে কাজ করে আসছেন তারা। তিনি জানান, বছরে প্রায় ১৬ টি পূঁজা অর্চনা হয়ে থাকে এই মন্দিরে। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পুষ্প রথ, জৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা, আষাড়ের তিথিতে রথযাত্রা, দুর্গাপূঁজা ও বৃন্দাবন গোস্বামীর জন্মদিন উপলক্ষে আবির্ভাব তিথি পালন করেন তারা। তিনি বলেন, শুধু এদেশ নয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন ভক্তরা। তাদের এই মন্দির প্রায় ৮০ হাজারেরও বেশি ভক্ত আছেন বলে জানান তিনি। ভক্তবৃন্দ, সরকারি অনুদান ও নিজেদের আয়ের উৎস থেকেই এই মন্দিরটি পরিচালিত হয় বলে জানান তিনি।
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন