ডার্ক মোড
Saturday, 27 July 2024
ePaper   
Logo
অভিযোগের ব্যাখ্যা দিলেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ

অভিযোগের ব্যাখ্যা দিলেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সম্পদ নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই মিথ্যা বলে দাবি করেছেন অবসরে যাওয়া এ পুলিশ কর্মকর্তা।

শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পাতায় ২৫ মিনিটের এক ভিডিওবার্তায় এ দাবি করেন বেনজীর আহমেদ।

তিনি যেসব সম্পত্তি অর্জনের তথ্যকে ‘মিথ্যা’ বলছেন, কেউ যদি সেই তথ্যকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তবে সেই সম্পত্তি সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে হাসিমুখে লিখে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর।

বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় সপ্তাহ তিনেক আগে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জে প্রায় ১৪০০ বিঘা জমিতে একটি ইকো রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন বেনজীর পরিবার। এছাড়া ঢাকা ও পূর্বাচলে সাবেক এ আইজিপির একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে।

বনের জমি দখল করে গাজীপুরে রিসোর্ট বানানোর অভিযোগও আনা হয়েছে দৈনিকটির প্রতিবেদনে। ওই রিসোর্টের এক-চতুর্থাংশের মালিকানা বেনজীর পরিবারের বলে পত্রিকাটি দাবি করেছে।

‘নানাভাবে চেষ্টা করেও’ এসব অভিযোগের বিষয়ে বেনজীর আহমেদের বক্তব্য জানতে না পারার কথা কালের কণ্ঠ তাদের প্রতিবেদনে লেখে।

‘আমার কিছু কথা’ শিরোনামের ভিডিওবার্তায় বেনজীর বলেছেন, “সম্প্রতি পত্রিকান্তরে আমার এবং পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু খুবই আপত্তিজনক, মানহানিকর, অসত্য এবং বিকৃত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আমার অবসর গ্রহণের দুই বছর পরে আকস্মিকভাবে আমার এবং আমার পরিবারের বিরুদ্ধে এরকম একটি মানহানিকর, অসম্মানজনক, অসত্য সংবাদ কেন পরিবেশিত হল- আমি সেই আলোচনায় সচেতনভাবে যাব না। এর কারণ রাজধানীর সকল সাংবাদিক এবং সচেতন মহলের মুখে মুখে।”

২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৫৯ বছর পূর্ণ হওয়ায় সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী অবসরে চলে যান বেনজীর।

তার ভাষ্য, এরপর জনপরিসর থেকে দূরে গিয়ে নিরিবিলি জীবনযাপন করে আসছেন। চাকরিকালীন সময়ে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সোশাল মিডিয়ায় একটি চক্রের হাতে ‘অবিরত অপপ্রচার’ এবং ব্যক্তিগত চরিত্র হননের মতো অপচেষ্টার শিকার হন।

দৈনিক কালের কণ্ঠে পরপর একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে যারা লেখালেখি শুরু করেন, তাদেরকে ধৈর্য ধরার ‘অনুরোধ’ জানিয়ে ২ এপ্রিল ফেইসবুক পোস্টে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বেনজীর। তার বিরুদ্ধে ‘কুৎসা’ রটানো হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন।

কলামিস্টদের ‘উত্তেজিত’ না হওয়ার অনুরোধ বেনজীরের

এর ১৮ দিনের মাথায় শনিবার তিনি যে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন, তাতে প্রকাশিত সংবাদকে মিথ্যা বললেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ পদে কাজ করে আসা বেনজীর।

“আমার এই বক্তব্যের লক্ষ্য কাউকে পাল্টা আক্রমণ করা নয়, কোনো বিদ্বেষ ছড়ানো নয়; কথার পরিপ্রেক্ষিতে কথা নয়। শুধুমাত্র নৈতিক এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার প্রেক্ষাপটে আমি আমার কথাগুলো বলব। আমার বিরুদ্ধে প্রকাশিত দুই কিস্তির সংবাদের পুঙ্খানুপুঙ্খু পর্যালোচনা করেছি। তাতে ৪৫টি তথ্য, অভিযোগ এবং অপমানজনক বক্তব্য সন্নিবেশিত আছে।

“তার মধ্যে ২৪টি তথ্য বা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা বা কল্পনাপ্রসূত। দুইটি বিষয়কে সাতবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এবং দুইটি তথ্যকে ভুল প্রেক্ষাপটে বিকৃতভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। বাকি ১০টি অভিযোগ বা তথ্যকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে শুধু তিলকে তাল নয়, তালগাছের ঝাঁড়সমেত ভুলভাবে উপস্থান করা হয়েছে।”

গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা বেনজীর স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। একই শিক্ষায়তনের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে পিএইচডি ডিগ্রিও আছে তার।

শনিবার সকালে ভিডিওবার্তায় বেনজীর দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় উপস্থাপিত অভিযোগ ধরে ধরে ব্যাখ্যা করেন।

কৃষিখাতে তার পরিবারের শতকোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে সাবেক পুলিশপ্রধান বলেন, “আমার জন্ম জেলা গোপালগঞ্জে ২০১৪ সাল থেকে আমাদের পারিবারিক কৃষি খামার ও কৃষিতে বিনিয়োগ আছে। সে সময় থেকে গত ১০ বছর ধরে কৃষিক্ষেত্রে আমাদের পারিবারিক বিনিয়োগ ও ব্যবসা চলে আসছে।

“প্রথমে সেখানে আমাদের পরিবারের সদস্যরা একটি ছোট মৎস্য খামার প্রতিষ্ঠা করে। সেই খামারের আয় থেকে আস্তে আস্তে ব্যবসার বৃদ্ধি হয়। পরবর্তীতে মৎস্য খামারের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন ধরনের বনজ, ফলজ, ঔষধি ও মসলাজাতীয় বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে ব্যাপক বনায়ন করা হয়।”

বেনজীর বলতে থাকেন, “কৃষিক্ষেত্রে ব্যবসার জন্য শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। এই যে প্রকল্প যেখানে রয়েছে, সেখানে যে পরিমাণ ভূমির উল্লেখ করা হয়েছে সেটি কোনোভাবেই সঠিক নয়।

“সত্য এই যে- সেখানে যে পরিমাণ টাকার জমি কেনা হয়েছে, তার থেকে বেশি আমার পরিবারের ব্যাংক এবং অন্যান্য সূত্র থেকে ঋণ এবং দেনা রয়েছে। এটি মূলত তাদের ব্যবসার আয় এবং ঋণের মাধ্যমে এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তারা গড়ে তুলেছে। এছাড়া এই জমির পরিমাণ ও টাকার উৎসের বিষয়গুলো ট্যাক্সফাইলে যথাযথভাবে সন্নিবেশিত আছে।”

শতকোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে তার স্ত্রীকে সংবাদে উপস্থাপন করার বিষয়ে বেনজীর বলছেন, “এটা পুরো মিথ্যা। আমি সরকারি চাকরিজীবী হলেও আমার স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যদের এদেশে ব্যবসা করার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। আমার সরকারি চাকরি কোনোভাবেই এদেশে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা সম্পত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

“আমার স্ত্রীর পরিবার সম্পর্কেও অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে। তার পিতা বাংলাদেশের একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তার পরিবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত। আমার স্ত্রী বিগত ২৪ বছর ধরে তার ব্যক্তিগত আয়ের বিপরীতে সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে আসছে। আরও দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের গোপনীয়তার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই সংবাদ প্রতিবেদনে আমার পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্ট, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ইমেইল ঠিকানা প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ”

‘শ্রমে-ঘামে পাওয়া অর্জনকে অপমান করা হয়েছে’

রাজধানীর পূর্বাচলে ৪০ কাঠা জমির উপর ডুপ্লেক্স বাড়ি থাকার তথ্যকে ‘মিথ্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন বেনজীর আহমেদ।

“প্রতিবেদন দুটিতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আমার পরিবারের সম্পত্তির বিষয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার কাছেই বিঘার পর বিঘা কোন জমিজমা আমার বা আমার পরিবারের নেই। পূর্বাচলে ৪০ কাঠা জমির ওপর আমার ডুপ্লেক্স বাড়ি নেই। আর এই ডুপ্লেক্স বাড়ির পাশে ১০ বিঘা জমিও নেই।”

‘বেনজীরের আয় এবং পারিবারিক ব্যবসার বিনিয়োগ আকাশচুম্বী’ বলে যে তথ্য প্রতিবেদনে এসেছে সেটিকেও মিথ্যা বলে বর্ণনা করেন বেনজীর।

তিনি বলছেন, “আমার ৩৫ বছরের চাকরিজীবনের বেতনভাতার যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে সেটিও ভুল এবং খুবই অপমানজনক। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে আমার অবসরের পর তথাকথিত থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। এ ধরনের শব্দপ্রয়োগও খুবই আপত্তিকর। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বিগত ১০ বছর ধরে প্রকাশ্যে এবং সর্বসম্মুখে পরিচালিত হয়ে আসছে।

“আমাদের পারিবারিক মৎস্য প্রজেক্ট জাতীয় পর্যায়ে মৎস্যচাষের জন্য স্বর্ণপদক পেয়েছে। এছাড়াও সেটি আরও একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছে। এগুলো একদিনে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে সবাই শ্রমে-ঘামে এগুলো অর্জিত হয়েছে। এই যে সবার চেষ্টা, এটিকেও এই ধরনের সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে আমি মনে করি অপমান করা হয়েছে।

গোপালগঞ্জে সাভানা অ্যাগ্রো প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের অভিযোগকেও মিথ্যা বলছেন বেনজীর আহমেদ।

তার ভাষ্য, “গোপালগঞ্জ প্রজেক্টে দুটি কোম্পানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে একটিতে ২০ কোটি টাকা আরেকটিতে ৫ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যেন সাধারণ পাঠক মনে করেন যে- এই দুটি কোম্পানিতে আমাদের পরিবার ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।

“আসলে অনুমোদিত মূলধন আর পরিশোধিত মূলধন এক জিনিস নয়। এখানে এই দুইটি কোম্পানির এক কোটি টাকাও পরিশোধিত মূলধন নেই। অথচ কথাটি এমনভাবে বলা হয়েছে যে, ২৫ কোটি টাকা আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। মূলত এই দুটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ব্যবসাকে সম্প্রসারণের জন্য। আমাদের পরিবার ওখানে এখন যে ব্যবসা করছে, সেটাকে সম্প্রসারণ করতে চায়, কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগকে সম্প্রসারণ করতে চায়।”

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ সময়ের দাবি মন্তব্য করে সাবেক আইজিপি বেনজীর বলেন, “ওই দুটি কোম্পানি করা হয়েছিল আরও বড় আকারের ব্যাংক লোন নেওয়ার জন্য। ব্যাংক লোনের জন্য আবেদনও করা হয়েছিল। কিন্তু সেসময় কোভিড মহামারীর প্রভাব, এরপরে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা-এসব বিভিন্ন কারণে ব্যাংকের সংকোচন নীতির কারণে এই লোন স্যাংশন হয়নি। ফলে যেটা হয়েছে, যে কোম্পানিগুলোর কথা বলা হয়েছে- তার কোনটিই আজ পর্যন্ত ব্যবসাতেই আসেনি।”

বেনজীরের চক প্রতিবেদকের ‘আবিষ্কার’

গোপালগঞ্জে বেনজীর পরিবারের প্রকল্প এলাকার নাম স্থানীয়রা ‘বেনজীরের চক’ নামে চেনে বলে যে সংবাদ যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেটিও সত্য নয় বলে ভাষ্য বেনজীর আহমেদের।

তিনি বলছেন, “এটি প্রতিবেদকের নিজস্ব আবিষ্কার। কারণ এ নামে কোনো জায়গা প্রকল্প এলাকায় নেই। প্রকল্প এলাকায় মিটার ছাড়াই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে যে তথ্য প্রতিবেদনে এসেছে, সেটিও মিথ্যা তথ্য। ওখানে সরকারিভাবে অনুমোদন নিয়ে মিটার স্থাপন করা হয়েছে বৈধভাবে এবং প্রতিমাসে আমাদের পরিবার তাদের ব্যবসার জন্য যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে তার বিল পরিশোধ করে আসছে।

“এখানে (প্রতিবেদনে) চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি কেনার কথা বলা হয়েছে। এটিও একটি অসম্ভব কল্পনা। কারণ হচ্ছে এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা এবং প্রকল্প এলাকাটি প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় আসন সন্নিহিত। ফলে এ ধরনের একটা জায়গায় গায়ের জোরে বা ক্ষমতা দেখিয়ে বা অন্য কোনোভাবে শক্তি প্রয়োগ করে জমি কেনার চিন্তা একটি অসম্ভব কল্পনা।”

ঢাকার মগবাজার ও আনন্দ হাউজিংয়ে ফ্ল্যাট ও বাড়ির বিষয়ে প্রতিবেদনে যে তথ্য এসেছে সেটিও মিথ্যা বলে দাবি করেন সাবেক আইজিপি বেনজীর।

তিনি বলছেন, “প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে ইস্টার্ন প্রোপার্টি মগবাজারে আমাদের চার হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে । এটি একটি মিথ্যা তথ্য। মগবাজার কেন সিদ্ধেশ্বরী, রমনা বা তার আশপাশে আমাদের কোনো ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট নেই। আনন্দ হাউজিংয়ে ৪০ কাঠা জমিসহ ৪৫ কোটি টাকার বাড়ি আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আনন্দ হাউজিং একটি বেসরকারি সমবায় সমিতি।

“২০০৭ সালে আমরা এই সমবায় সমিতির সদস্য হই এবং একটি প্লট বুকিং দেই। কিস্তির মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমরা এই টাকা পরিশোধ করি। সেখানে আমাদের ৪০ কাঠার কোনো প্লট নেই। সেটাকে বলতে গেলে শতগুণ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। আমাদের প্লটে পাঁচ ইঞ্চি দেয়াল বিশিষ্ট টিনের ছাদের একটি দোতলা বাড়ি আছে। যে হাউজিংয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নাগরিক সুবিধা গড়ে ওঠেনি, রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি, বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা নেই, ওয়াসার পানির ব্যবস্থা নেই- এমন একটা গ্রামের মধ্যে এই ধরনের একটা প্লটের ওপর টিনের ছাদ বিশিষ্ট বাড়ির দাম ৪৫ কোটি টাকা হবে- এই ধরনের দাবি রীতিমতো হাস্যকর।”

১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়া বেনজীর সন্ত্রাসদমন বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে বসনিয়া ও কসোভোতে কাজ করে এসেছেন তিনি।

২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি র‌্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে বেনজীর আহমেদ ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।

প্রায় সাড়ে চার বছর এলিট ফোর্স র‌্যাবের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল পুলিশের মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে আসনে বেনজীর আহমেদ। সব মিলিয়ে পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে ছিলেন প্রায় ৩৫ বছর।

আইজিপি থাকাকালীন পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট কিনেছেন বলে যে তথ্য সংবাদ প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটিকেও মিথ্যা বলে দাবি করছেন বেনজীর আহমেদ।

তিনি বলছেন, “আইজি হিসেবে আমি নাকি পূর্বাচলে ফারুক মার্কেটের পাশে ১০ কাঠার জায়গা কিনেছি, যেটার বাজারমূল্য ২২ কোটি টাকা। ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করা হয়েছে যে ২২ কোটি টাকা দিয়ে আমি আইজি থাকার সময় এই প্লটটি কিনেছি। শুধু আইজি না, র‌্যাবের ডিজি বা ডিএমপির কমিশনার হিসেবে কোনো সময় আমি পূর্বাচলে কোনো প্লট কিনি নাই।

“২০০১ সালে রাজউক যখন সরকারিভাবে আবেদন আহ্বান করে, তখন আমি আবেদন করে সরকারি কোটায় একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ পেয়েছিলাম আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে। এবং সেটিও আমরা পারিবারিক ও নিজস্ব অর্থের প্রয়োজনে বিক্রি করে দিয়েছি। এই মুহূর্তে পূর্বাচলে আমাদের কোনো ধরনের কোনো জমি বা প্লট কিছুই নেই।”

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় মেয়ের বিশ্রামের জন্য ফ্ল্যাট এবং রূপগঞ্জে তার দুই বিঘা জমি আছে বলে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেসব তথ্যও সঠিক নয় বলে দাবি করেন বেনজীর আহমেদ।

তিনি বলছেন, “রূপগঞ্জের নাওরায় আমাদের একটি দুই বিঘার প্লট আছে, যার বাজারমূল্য দুই কোটি টাকা বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। রূপগঞ্জের কোনো ইউনিয়নে আমাদের এরকম কোনো জমি নেই। এটি একটি সর্বাংশে মিথ্যা তথ্য। আনন্দ হাউজিং ছাড়া রূপগঞ্জে আমাদের কোনো জমি নেই। সেখানে আমাদের একটা প্লট আছে।

“মেয়ের বিশ্রামের জন্য সাড়ে তিন কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছি বলে অভিযোগ করা হয়েছে। আমার বড় মেয়ে সবসময় আমার সরকারি বাসা থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করত। তার বিশ্রামের জন্য বাড়ি কেনার কোনো প্রয়োজন আমরা কখনো অনুভব করিনি। বসুন্ধরাতে আমরা আনফিনিশড ফ্ল্যাট একটা কিনেছিলাম। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে আমাদের মনে হয়েছে যে, এটা বসবাস উপযোগী নয়; সেটাও আমরা বহু আগে বিক্রি করে দিয়েছি।”

তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বেনজীর বলেন, “সেই ফ্ল্যাটে নাকি একটা ৫০ লক্ষ টাকা দামের দরজা আছে- বাড়ির দারোয়ানের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে এমন একটা তথ্য দেওয়া হয়েছে। বাড়ির দারোয়ান কীভাবে দরজার দাম জানল, সেটাও একটা বিরাট প্রশ্ন।

“একটা দরজায় সাধারণত ২১ থেকে ৩২ বর্গফুট কাঠের প্রয়োজন হয়। যদি দরজার দাম ৫০ লাখ টাকা হয়, তাহলে প্রতি বর্গফুট কাঠের দাম পড়ে পৌনে ২ লাখ টাকা। এতো মূল্যমানের কোনো কাঠ পৃথিবীতে আছে কি না, সেটা আমার জানা নেই। আমি মনে করি, এটিও একটি হাস্যকর, নির্জলা মিথ্যা সংবাদ- শুধুমাত্র চরিত্র হননের জন্য যেগুলো করা হয়েছে।”

হোটেল-ব্যাংকে বিনিয়োগের তথ্য ‘নির্জলা মিথ্যা’

লো মেরিডিয়ান হোটেল এবং পদ্মা ব্যাংকে বেনজীর আহমেদের পরিবারের বড় বিনিয়োগ আছে বলে যে তথ্য দিয়েছে কালের কণ্ঠ, সেটিকেও মিথ্যা বলছেন বেনজীর আহমেদ।

তিনি বলছেন, “আমাদের পরিবারের স্টক এক্সচেঞ্জে পোর্টফোলিও আছে, তাদের শেয়ার ব্যবসা আছে। এবং সেই ব্যাবসার অংশ হিসেবে বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেলে আমাদের দুই লক্ষ প্রাইমারি শেয়ার রয়েছে। মোট সেখানে শেয়ারের সংখ্যা হচ্ছে ৩৫ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্য থেকে আমাদের কাছে দুই লাখ শেয়ার আছে- তাও প্রাথমিক শেয়ার, অভিহিত মূল্যে কেনা।

“সেটাকেও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে এটা বিশাল একটা ইনভেস্টমেন্টের বিষয়, যা আসলে সঠিক নয়। তাছাড়া দাবি করা হয়েছে পদ্মা ব্যাংকের শেয়ার কিনেছি আমরা, কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে শেয়ার কিনেছি। আমি বলতে চাই পদ্মা ব্যাংকে আমাদের কোনো শেয়ার নেই, কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়েও আমাদের কোনো শেয়ার নেই। পদ্মা ব্যাংকে আমাদের ন্যূনতম একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই। এটা একটা একেবারে নির্জলা মিথ্যা কথা।”

‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান ৭ কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর। ওই তালিকায় র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে বেনজীর আহমেদের নামও আসে।

দুবাই, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় তাদের শতকোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে বলে যে তথ্য প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি বেনজীর আহমেদের।

তিনি বলছেন, “দুবাইতে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা, সিঙ্গাপুরে অর্ধশত কোটি টাকার সোনার ব্যবসা, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াতে জমি কিনেছি বলে দাবি করা হয়েছে। এগুলোর কিছুই নেই আমাদের। …দুবাইয়ের কেন্দ্রস্থলে কনকর্ড হোটেলে মোটা অঙ্কের শেয়ার আমাদের রয়েছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। আমরা দুবাইতে ওই হোটেলে খোঁজ নিয়েছি। এই হোটেলটি কোনো শেয়ারড মালিকানায় পরিচালিত হয় না। এই হোটেলটি একক মালিকানাধীন হোটেল এবং আমরা জেনেছি এর মালিক স্থানীয় একজন আমিরাতের নাগরিক।”

বেনজীর বলেন, “সিঙ্গাপুরে তথাকথিত একটি জুয়েলার্সে আমাদের মালিকানা আছে বলে দাবি করা হয়েছে। এই ধরনের কোনো জুয়েলার্স আমাদের পরিবারের সদস্যরা পরিচালনা করে না। আমাদের মালিকানাও নেই, বিনিয়োগও নেই। এটি একটি সর্বাংশে মিথ্যা তথ্য, যা এই প্রতিবেদনে অসৎ উদ্দেশ্যে পরিবেশিত হয়েছে।”

সোনালী ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে সংবাদে, সেটিরও কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি বেনজীর আহমেদের।

তিনি বলছেন, “সোনালী ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আমরা আমাদের গোপালগঞ্জ প্রজেক্টে বিনিয়োগ করেছি। এবং সেখানে বড় বড় সাইনবোর্ড লাগানো আছে যে এখানে সোনালী ব্যাংকের ঋণ রয়েছে। লোন নিয়ে এই প্রকল্প করা হয়েছে, এটা জানা সত্ত্বেও আমি মনে করি অসত্যভাবে, বিকৃতভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে শুধুমাত্র আমার এবং আমার পরিবারের চরিত্র হনন করার জন্য এবং আমাদের অপমানজনক তথ্যের মাধ্যমে বিব্রত করার জন্য।”

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নারিকেল বাগান দখলের যে অভিযোগ প্রতিবেদনে করা হয়েছে, সেটিকেও মিথ্যা বলে বর্ণনা করেন বেনজীর।

“সেন্ট মার্টিনে আদৌ কোনো নারিকেল বাগান আছে কি না, আমার জানা নেই। তবে আমি যখন গিয়েছি, বিক্ষিপ্তভাবে নারিকেল গাছ দেখেছি। কিন্তু নারিকেলের ঘন বাগান আমি কখনো দেখিনি। এ ধরনের বাগান দখলে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। একজন দায়িত্ববান সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমি বা আমার পরিবার কারও জমি দখল-বেদখলের সঙ্গে কোনোক্রমেই নৈতিকভাবে বা অন্যকোনোভাবে জড়িত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে বিভিন্ন দাগ নম্বর উল্লেখ করে বিভিন্ন সম্পত্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো যোগ করে দেখবেন, যোগ করলে হয় ১৬৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। কিন্তু আরেক প্যারায় দাবি করা হয়েছে সেখানে আমাদের ৪১৮ শতাংশ জমি রয়েছে। তো এই প্রতিবেদনে যোগ-বিয়োগেরও সমস্যা আছে।”

সেন্ট মার্টিনের এমন জমির মালিকানায় নেই দাবি করে বেনজীর বলেন, “তবে আজ থেকে ১৭-১৮ বছরে আগে এখানে আমাদের একটা প্লট কেনা আছে। কিন্তু আপনারা জানেন কয়েকবছর আগে হাই কোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে সেখানে সকল ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ আছে।

“এর ফলে এই জমিগুলো এখন আর কেউ কেনেও না। এর ফলে এগুলো পরিত্যক্ত এবং পতিত জমি হিসেবে পড়ে আছে। আমাদের যে ছোট প্লটটি আছে, সেখানে এখন বালু আর পাথর রয়েছে, সেখানে কোনো গাছপালাও তেমন একটা নেই। সেটা বিক্রি করার চেষ্টা করলে বিক্রি করা যায় না। এই জমির বিষয়টি আমাদের ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ করা আছে। এটার সোর্সও ট্যাক্সফাইলে বলা আছে।”

‘যারা সততার সঙ্গে চাকরি করতে চান, তারা নিরুৎসাহিত হবে’

বেনজীর আহমেদ বলেন, “শেষ কথা হচ্ছে, আমার এবং আমার পরিবারের যে সম্পত্তি রয়েছে তার প্রত্যেকটির বিপরীতে অর্থের উৎস সহকারে ট্যাক্স ফাইলে যথাযথভাবে সেগুলো বর্ণিত আছে। আমার পরিবার তাদের ব্যবসার জন্য এবং আমি নিয়মিতভাবে কর পরিশোধ করি।

“আপনারা জেনে খুশি হবেন আমি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেরা করদাতার সম্মানও লাভ করেছি। চাকরিজীবনে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আইজিপি হিসেবে আমি সরকারের শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি।”

সাবেক এ পুলিশপ্রধান বলেন, “আমার অবসরের পরে আমাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণের চেষ্টা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ও দুঃখজনক। যারা সততার সঙ্গে চাকরি করতে চান, জনগণের সেবা করতে চান- এ ধরনের অপপ্রয়াস তাদের নিরুৎসাহিত করবে।

“পত্রিকায় প্রকাশিত যে সমস্ত সম্পত্তির কথা আমি বলেছি ‘নেই’- আপনারা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমার এবং আমার পরিবার হাসিমুখে সেই ব্যক্তিকে বা সেই গ্রুপকে সেই সম্পত্তি বিনা পয়সায় লিখে দেব।”

ভিডিওবার্তার কয়েক ঘণ্টা বাদে বিকালে ফেইসবুকে এক পোস্টে সংযুক্তি হিসেবে বেনজীর লিখেছেন, “পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সম্পত্তির তালিকায় আরও তিনটি সম্পদের বিষয় উল্লেখ আছে, যে বিষয়ে স্পষ্টীকরণ জরুরি বলে প্রয়োজন মনে করি । প্রতিবেদনে কক্সবাজারের রামাদা হোটেল, ভাওয়াল রিসোর্ট ও বনানীর ইউনিক হোটেলে আমাদের বিনিয়োগ/ মালিকানা আছে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রকৃতসত্য এই যে, এই তিন সম্পত্তি/প্রতিষ্ঠানে আমাদের কোনো মালিকানা বা বিনিয়োগ নাই।

“আমাদের মালিকানা প্রমাণ সাপেক্ষে এই তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও ইতিপূর্বে প্রদত্ত বিনা পয়সায় লিখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে অন্তর্ভূক্ত।”

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন