ডার্ক মোড
Friday, 02 May 2025
ePaper   
Logo
স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ছুটে চলে মটর শ্রমিকেরা

স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ছুটে চলে মটর শ্রমিকেরা

 

 
মামুন হোসেন, পাবনা
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া। পৃথিবীব্যাপী ধনী গরীবের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে যুগে যুগে হয়েছে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম, দিতে হয়েছে জীবন। তা না হলে শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই কবিতার মধ্য দিয়ে সেটিই বোঝাতে চেয়েছেন। 
 
পৃথিবীব্যাপী ধনী-গরীবের বৈষ্যমের অন্যতম ভুক্তভোগী শ্রমিক শ্রেণী। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস মে দিবস। কর্মঘন্টাকে আট ঘণ্টা করার সঙ্গে সম্পৃক্ত এই মে দিবস। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। সেই সূত্র ধরেই বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই মে দিবস পালন করা হয়। 
 
জানা যায়, মে দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকারের লড়াই। এখন ২০২৫ সাল। ১৮৮৬ সাল থেকে ২০২৫, প্রায় ১৩৯ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে এই দিবসটি। এই দীর্ঘ সময়ে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই। কিন্তু পরিবর্তন হয়নি পরিবহন শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়ন। স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অনেকটা অনিশ্চিত জীবন নিয়েই ছুটে চলেন তারা।
 
শ্রমিকদের অভিযোগ, প্রতিবছর মে দিবস আসে আবার চলে যায়। কিন্তু হয় না শ্রমিকদের ভাগ্যর পরিবর্তন। তারা জানান, এ পেশায় শ্রমিকরা পায় না তাদের ন্যায্য মজুরি। দিনশেষে যা পান তা দিয়েই কোনরকমে চলে তাদের সংসার। তারা জানান, আমাদের দেশের বেশির ভাগ শ্রমিকরাই জানে না তাদের অধিকার। শোষক শ্রেণীও জানতে দেয় না তাদের অধিকারের কথা। 
 
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় পাবনা বাস ট্রার্মিনালের কয়েকজন পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে তারা জানান, আমাদের দেশের একেক প্রতিষ্ঠান একেক ধরনের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে থাকে। কোনো অফিসের কর্মঘণ্টা ৬ আবার কোনো অফিসের কর্মঘণ্টা ৮। মালিকপক্ষ নিজেদের মুনাফা বাড়ানোর জন্যই এই কর্মঘণ্টা ঠিক করে থাকেন বলে জানান তারা। শ্রমিকদের অভিযোগ, খাতা কলমে একজন শ্রমিকের কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ করা হলেও ২০ থেকে ২৩ ঘন্টা পর্যন্তও কাজ করতে হয় তাদের। এছাড়াও মাসিক বেতন ও নিয়োগপত্র সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও তাদের কর্মক্ষেত্রে তা মানা হয় না, অভিযোগ শ্রমিকদের। 
 
কথা হয় সিরাজগঞ্জের ইসলাম পরিবহনের শ্রমিক শরীফুল ইসলাম'র সাথে তিনি জানান, প্রতিবছরই মে দিবস পালন হয়, দেওয়া হয় নানান প্রতিশ্রুতি কিন্তু মাসের পর মাস চলে গেলেও পূরণ হয় না তাদের দেওয়া সেই আশ্বাস। দিনশেষে পরিশ্রমের সেই মূল্যটুকুও পান না তারা। 
 
কাঠফাটা রোদে গাড়ির মধ্যে বিশ্রাম নেওয়া আবুল কালাম নামের এক শ্রমিক জানান, সাঁথিয়া থেকে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত চলে তাদের গাড়ি। টার্মিনালে বিশ্রাম নেওয়ার তেমন জায়গা না থাকায় গাড়িতেই শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। তিনি জানান, শুধু বিশ্রামের জায়গা নয়, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সকল কাজ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে দিয়েই করতে হয় তাদের। এতে করে চড়ম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরেন তারা।   
 
পরিবহন শ্রমিক আশরাফ হোসেন রবি, গাড়ি চালক মোস্তফা, সুপারভাইজার রাকিব, শ্রমিক হাফিজুর রহমান, শ্রমিক এনামুল, গাড়ি চালক জামাল উদ্দিন নান্নু সহ অনেকেই জানান, বেশিরভাগ গাড়ি চালক সহ অন্যান্য শ্রমিক কমিশন চুক্তিতে কাজ করে থাকেন। মালিক ও গাড়ির তেলের টাকা যোগারের পর যা থাকে তা দিয়েই কোনরকমে চলে তাদের সংসার। এছাড়া কোন দূর্ঘটনার স্বীকার হলে জনসাধারণের হাতে জীবন সংশয়েরও আশংকা থাকে তাদের। এছাড়াও প্রতিদিন শ্রমিক কল্যাণের নামে যে চাঁদা উঠানো হয় তা শ্রমিকদের কোন কাজে আসে না বলে অভিযোগ করেন শ্রমিকরা। এছাড়াও দীর্ঘসময় গাড়ি চালিয়ে অবসরে গেলেও পান না কোন ভাতা বা পেনশন। একটা সময়ে শারীরিক অসুস্থতা সহ নানান অনিশ্চিয়তায় দিন কাটে তাদের।
 
কথা হয় পাবনা থেকে সাতক্ষীরাগামী দূর পাল্লার বাস চালক মুকুল হোসেনের সাথে তিনি জানান, ভোর পাঁচটায় বাসা থেকে বের হয়ে গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে বাস কাউন্টারে যান তিনি। নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়ার পর ছুটে যান দক্ষিণবঙ্গের জেলা সাতক্ষীরাতে, সেখানে পৌঁছাতে তার সময় লাগে প্রায় ১৪ থেকে ১৬ ঘন্টা। শ্রমিক আইন অনুযায়ী ৮ কর্মঘন্টার কথা উল্লেখ থাকলেও সে-সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত বাস ও ট্রাক চালকরা। শুধু মুকল হোসেন নয়, মুকুল হোসনের মত সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, খুলনা, কক্সবাজার, বরিশাল, পটুয়াখালী, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেটের বাস চালকরা জানান, শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা থাকলেও দুঃখের বিষয় এই আইনগুলো কেউই মানেন না। শুধু তাই নয় শ্রম আইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত সময় কাজ করার পরেও ওভারটাইমও পান না তারা। এছাড়াও দীর্ঘসময় কাজ করা এইসব চালকরা জানান, বেশিরভাগ চালকই অস্থায়ী নিয়োগে দিনমজুরি হিসেবে কাজ করে। তারা জানান, উৎসব ও বেতন ভাতা তো দূরের কথা অসুস্থতার কারণে কাজে না আসতে পারলে সে দিনের মুজুরিও পান না তারা।শ্রম আইন বাস্তবায়নে তদারকির অভাব ও মালিকদের অতি মুনাফার লোভে নূন্যতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা। 
 
সচেতন মহল জানান, গাড়ি ড্রাইভিং একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। তারা জানান, একজন চালক যদি দীর্ঘসময় ড্রাইভিং করেন এবং তিনি যদি পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিতে পারেন। তাহলে তার চোখে ঝিমুনি ভাব সহ নানান সমস্যা দেখা দিতে পারে। এতে করে বড় ধরনের দূর্রঘটনাও ঘটতে পারে বলে জানান তারা। তারা আরও জানান, আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী একটানা ৫ ঘন্টার বেশি ড্রাইভিং করলে কমপক্ষে আধাঘন্টা বিশ্রাম নিতে হবে। এছাড়াও ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৮ ঘন্টা ড্রাইভিং করতে হবে তাকে। অথচ কাগজে-কলমে আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও একজন দূর পাল্লার গাড়ি চালক ভোরে পাবনা থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্য রওনা হলে তার পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ ঘন্টা এবং সড়কে জ্যাম থাকলে সময় লাগে প্রায় ২০ ঘন্টার মত। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবারও ফিরে পাবনার উদ্দেশ্য। এতে করে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে চালক, হেল্পার, সুপারভাইজার সহ গাড়িতে থাকা যাত্রী ও পথচারীদের জীবন। তাই ঝুঁকি এড়াতে যাথীদের সচেতনতা, একটা গাড়িতে একাধিক চালক নিয়োগ, কাজের সুস্থ পরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, বিআরটি ও প্রশাসনের সঠিক নজরদারির প্রত্যাশা করেন তারা।
 
পাবনা জেনারেন হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সালেহ মুহাম্মদ আলী বলেন, দীর্ঘসময় ধরে গাড়ি চালানোর ফলে চালকদের মানসিক চাপ বেড়ে যায়, ফলে কাজের প্রতি  মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন তারা। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হীট স্টোক, হার্ড-এ্যাটাকের মতও দূরর্ঘটনা ঘটতে পারে তাদের। তিনি বলেন, চালকের আসনটি স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়ায় ফলে দীর্ঘসময় গাড়ি চালানোর পরে চালকদের পিঠে ও কোমরে ব্যাথা করে। এছাড়া ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সে গিয়ে নানান অসুস্থতায় ভোগেন তারা।
 
সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিমুল বিশ্বাস বলেন, ২০১৮ সালের একটা বৈষম্যমূলক আইন করে সড়ক পরিবহন সেক্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, আমরা এ আইন সংশোধন সহ বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেছি। শ্রমিক পরিবহনের অবদান রাষ্ট্র স্বীকার করে ২০০৮ সালে সড়ক পরিবহন শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আইন প্রণয়ন করেছিলেন। যেটা বিভিন্ন কারণে বাস্তববায়ন সম্ভব হয়নি। শুধু পরিবহন সেক্টর নয় সমস্ত শিল্প সেক্টর, সার্ভিস সেন্টার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের আমরা ঐক্যবদ্ধ করবো। তিনি জানান, পরিবহন সংগঠন অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় নতুন করে সংগঠিত হয়েছে। তিনি মনে করেন, সামনে শ্রমিকদের জাগরণ গড়ে উঠবে এবং বাংলাদেশে শ্রমিকদের গণজাগরণ ঘটবে। বাংলাদেশকে উন্নত বাংলাদেশে পরিণত করার জন্য শ্রমিক শ্রেণী তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন এই শ্রমিক নেতা।
 

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন