ডার্ক মোড
Friday, 02 May 2025
ePaper   
Logo
সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা চরম সংকটে

সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা চরম সংকটে

          এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির,সুন্দরবন 

জাতীয় অর্থনীতিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চললেও মানুষের জীবন-জীবিকা চরম সংকটে। লিডার্সের গবেষণায় বলছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাগেরহাট খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকুলীয় এলাকায় প্রতিবছর পরিবার প্রতি গড়ে ৫ লক্ষ দুই হাজার ৪৮৯ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে একটি পরিবারে সর্বোচ্চ ১০০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৪৫ হাজার ২০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ১৯৯১ থেকে ২০২৪সালের মধ্যে বাংলাদেশ যে ১৯৮টি বড় প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে স্বাধীনতার পর বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের জন্য স্মরণকালের দুর্যোগ ছিল এটি।কিন্তু ২৬ মে ২০২৪ ঘূর্ণিঝড় রেমাল সিডরের দুর্যোগকেও হার মানিয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চল। যা এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সম্পদ, খাদ্য, পানি, বাসস্থানসহ অন্যান্য সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংকট দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে সব থেকে বেশি। এই সংকট থেকে উত্তোরণে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলকে দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে ঝুঁকি মোকাবেলায় চলতি জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের নেতারা। সূত্রমতে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। স্বাধীনতার পর মোরেলগঞ্জের জন্য স্মরণকালের দুর্যোগ ছিল এটি।কিন্তু ২৬ মে ২০২৪ ঘূর্ণিঝড় রেমাল সিডরের দুর্যোগকেও হার মানিয়েছে।বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার, এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট-বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্রসৈকত ৩১০ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলেই দেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, বিশ্বের সেরা গহীন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের অন্যতম অখন্ডিত সমুদ্র সৈকত বা বেলাভূমি কক্সবাজার অবস্থিত। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ যেমন এ উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এ অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্তে¡ও এ অঞ্চল, এর অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার। অথচ এটা ঠিক বঙ্গোপসাগরের তীরে ও বিশ্বের সেরা গহিন গরান বনের নীড়ে গড়ে ওঠা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র বিলাস। পাঁজি-পুঁথি ও সরকারি পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, ১৭৯৭ থেকে শুরু করে এই সেদিন গত মে মাসে সর্বশেষ ইয়াস পর্যন্ত মোট ৪৯৪ বার মাঝারি ও মোটাদাগের জলোচ্ছ¡াস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, আইলা, নার্গিস, মহাসেন, ফণী, বুলবুল, আম্পান বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পরপর, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে ১৭৪টি ঝড় বা জলোচ্ছ¡াস ঘটেছে ঘন ঘন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ ও মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনসংক্রান্ত পরিসংখ্যান বলছে, উপকূলীয় অঞ্চলে শস্য উৎপাদন দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় বাড়েনি, বরং কমছে। জিডিপিতে এখনো সমানুপাতিক হারে অবদান (২৫%-২৩%) রেখে চলেছে এ অঞ্চল। সময়ের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে, তার গতি-প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে । উষ্ণায়নের প্রভাবক ক্ষয়ক্ষতি যথানিয়ন্ত্রণ ও মোকাবেলা করা সম্ভব না হলে সমূহ সম্ভাবনাময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের আবদান থেকে অদূরভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতি শুধু বঞ্চিতই হবে না, সময়ের অবসরে জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি গোটা দেশ ও অর্থনীতির জন্য দুর্ভাবনা-দুর্গতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছে, উপকূলীয় বাঁধগুলো টেকসই এবং নির্মাণ কাজে যথাযথ তদারক করা হলে আগামী ১০০ বছরেও এই বাঁধের কোনো ক্ষতি হবে না। টেকসই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলে উপকূল এবং উপকূলের চর ও চরাঞ্চলগুলোর জীবন ও জীবিকার গতিপথ ত্বরান্বিত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা পরিমাপ করা হলেও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর গতিক্রকৃতি, ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের প্রকৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে এখনই উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কথা ভাবতে হবে। সংরক্ষিত ও সমৃদ্ধ উপকূল গড়ে উঠলে মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে। সমৃদ্ধ উপকূলে মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠবে। মঙ্গলবার সকাল ১০ মে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘লিডার্স’ এবং নাগরিক সংগঠন ‘সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন।সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উত্থাপন করেন লির্ডাসের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল। সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত সুপারিশে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায় রেখে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ উপকূলীয় অঞ্চলে স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। ওই এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারসহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উপকূলীয় অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে বেড়িবাঁধ টেকসই আকারে নির্মাণ সহ সুন্দরবন সুরক্ষা এবং উপকূলীয় জনপদ, জীবন ও জীবিকা ও কৃষি অর্থনীতির দুর্দশা লাঘব-উত্তর বিকাশকে গুরুত্ব দিতে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রদত্ত বরাদ্দ এবং এরই মধ্যে ঘোষিত উদ্যোগ ও নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর কড়া নজরদারি, আগামী অর্থবছরে বিশেষ বরাদ্দ দান ও তা বাস্তবায়নে দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন