ডার্ক মোড
Friday, 01 November 2024
ePaper   
Logo
সাবেক মেয়র আতিকের দুর্নীতির শেষ নেই : সকল সেক্টরে পারিবারিক সিন্ডিকেট

সাবেক মেয়র আতিকের দুর্নীতির শেষ নেই : সকল সেক্টরে পারিবারিক সিন্ডিকেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

গত পাঁচ বছরে ‘দুর্নীতির আখড়া’ হয়ে উঠেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেনের (ডিএনসিসি) নগর ভবন। এখানে ছিল সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের ‘পারিবারিক সিন্ডিকেট’। ভাগনে-ভাতিজাকে উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন তিনি। মেয়ে ছিলেন ডিএনসিসির অবৈতনিক চিফ হিট অফিসার। এসব নিয়োগে তিনি নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেননি।

গত বুধবার রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস থেকে ডিএনসিসির বরখাস্ত মেয়র আতিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, মেয়র থাকাকালে তিনি ডিএনসিসির ঠিকাদারি কাজ দিয়েছেন কমিশন নিয়ে। বদলি-পদোন্নতিও হয়েছে একইভাবে। চলেছে নিয়োগ বাণিজ্য। অন্যায় কাজে সম্মতি না দেওয়ায় নগর ভবন ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে একাধিক কর্মকর্তাকে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান আতিকুল। এর পর গত ১৮ আগস্ট রাতে তিনি নগর ভবনে প্রবেশ করলে খবর পেয়ে এলাকাবাসী সেখানে জমায়েত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পেছনের দরজা (ফায়ার এক্সিট) দিয়ে পালিয়ে যান তিনি। পরদিনই তাঁকে বরখাস্ত করে ডিএনসিসিতে প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। আতিকের ঘনিষ্ঠরাও এর পর থেকে পলাতক।

ডিএনসিসির প্রথম মেয়র আনিসুল হকের আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে প্রথম মেয়র হন আতিকুল ইসলাম। ওই পরিষদের মেয়াদ শেষে ২০২০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আবার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। এর পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পুরোদমে সক্রিয় হন এই ব্যবসায়ী নেতা।

পারিবারিক সিন্ডিকেট

২০২২ সালে আতিকুল ইসলাম ভাতিজা ইমরান আহমেদ ও ভাগনে তৌফিক আহমেদকে তাঁর উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন। কিছু দিন পর তাঁর মেয়ে বুশরা আফরিন হন ডিএনসিসির চিফ হিট অফিসার। একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁকে এই নিয়োগ দেওয়া হয়। চিফ হিট অফিসারের পরামর্শে নগরীর তাপমাত্রা হ্রাসে বিভিন্ন আইল্যান্ডে গাছ লাগায় ডিএনসিসি। কিছু সড়কে গাড়ি থেকে পানি ছিটানোর (কৃত্রিম বৃষ্টি) কাজে খরচ করা হয় প্রায় ২ কোটি টাকা।

২০২৩ সালে শক্তি ফাউন্ডেশনকে সবুজায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন আতিকুল। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হুমায়রা ইসলাম সম্পর্কে তাঁর শ্যালিকা। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেয়রের ভাই তোফাজ্জল হোসেন, ভাতিজা ইমরান এবং মেয়ে বুশরা আফরিনও যুক্ত ছিলেন। আর ভাগনে তৌফিক ও এপিএস ফরিদের দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা ও কমিশন আদায়। মেয়র থাকাকালীন আতিকুল যেখানেই যেতেন, তাঁর সফরসঙ্গী হতেন তৌফিক।

সড়কবাতির প্রকল্পে অনিয়ম

রাতের ঢাকায় আলো ছড়াতে ইউরোপ থেকে আনা হয় ৫০ হাজার সড়কবাতি। বলা হয়েছিল, এসব বাতি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবে। এমনকি আধুনিক এসব বাতি কেন্দ্রীয় তদারকির মাধ্যমে জ্বালানো-নেভানো যাবে, অকেজো হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা যাবে। ১০ বছরের ওয়ারেন্টিযুক্ত বাতিগুলো লাগানোর পরের পাঁচ বছর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। কোনো বাতির আলো ৭০ শতাংশে নেমে এলে সেটি বদল করার শর্ত ছিল চুক্তিতে। কিন্তু ডিএনসিসির সড়কে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে নিম্নমানের সিএফএল বাতি। যদিও ৩৬৯ কোটি ১৪ লাখ ৩২ হাজার টাকায় কেনা দুই ধরনের ৪৮ হাজার ৮১২টি বাতির প্রতিটির দাম পড়েছে ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা। লাগানোর মাসখানেকের মধ্যে সেগুলো বিকল হতে শুরু করে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আর বদলে দেয়নি। এ ব্যাপারে নীরব থেকেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। তখন চাউর হয়, প্রতিটি বাতির প্রকৃত দাম ছিল আসলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এই প্রকল্পে লুটপাট হয়েছে বিপুল অর্থ।

বস্তিবাসীর কল্যাণের টাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচি

মেয়র থাকাকালেই আতিকুলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে বস্তি উন্নয়নের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরচ হিসাব করে দেখা গেছে, বস্তি উন্নয়ন বিভাগের আড়াই কোটির বেশি টাকা লুটপাট হয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে।

২০২২ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বনানী কবরস্থানে আগমন উপলক্ষে প্যান্ডেল, গেট ও লাইটিং করে ডিএনসিসি। এ বাবদ খরচ দেখানো হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে একই স্থানে একই খাতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসেও প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সেখানে ১০ লাখ টাকা খরচ দেখায় ডিএনসিসি। তাছাড়া মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে ৪১ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খরচ দেখানো হয় ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডিএনসিসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিদেশিদের অবহিত করতে একটি পাঁচতারকা হোটেলে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করা হয়। বার্ষিক বনভোজন ও করপোরেশন সভায় খরচ দেখানো হয় ৬৫ লাখ টাকা। সব খরচ করা হয় সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে।

এ ছাড়া পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে বিভিন্ন সড়কে আলোকসজ্জার নামে প্রায় ৭০ লাখ এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের নামে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ দেখান আতিকুল। অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থের একটি বড় অংশ গেছে তাঁর পকেটে।

লুটপাটে সহযোগিতা না করায় বদলি

২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর বেরাইদের একটি রিসোর্টে ডিএনসিসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন আতিকুল ইসলাম। ওই সভায় খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু ভাউচার তৈরি করা হয় ২৯ লাখ টাকার। ওই ভাউচারে সই করতে রাজি না হওয়ায় তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাশার মো. তাজুল ইসলামকে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়।

২০২৩ সালের ২ মে আতিকুল ইসলাম তৎকালীন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আরিফুর রহমানকে দরপত্র ছাড়াই সরাসরি বিটিআই টেকনোলজি কোম্পানি থেকে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর ৭৬(১) ধারায় ৪৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকার মালপত্র কেনার নির্দেশনা দেন। আরিফুর বিধিমালা ভেঙে মেয়রের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় তাঁকে ওই পদ থেকে অপসারণ করা হয়। চারটি প্রকল্পে দায়িত্বে অবহেলা, অসদাচরণ ও অদক্ষতার অভিযোগ এনে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরে তাঁকে গাজীপুরে বদলি করা হয়। দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আরিফুর রহমান স্থানীয় সরকার বিভাগে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

 

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন