ডার্ক মোড
Friday, 01 November 2024
ePaper   
Logo
দুর্নীতির অভিযোগে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুল গনি বদলি

দুর্নীতির অভিযোগে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আবদুল গনি বদলি

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

অবশেষ দুর্নীতির অভিযোগে বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) হলেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহা: আবদুল গনি।

তাকে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলায় বদলি করা হয়েছে। রবিবার (২৬ মে ২০২৪) প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন-১) মোঃ আব্দুল আলীম এক অফিস আদেশে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহা: আবদুল গনিকে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলায় বদলির চিঠি দিয়েছেন। যার স্মারক নং ৩৮.০১.০০০০.১০১.১৯.০১৫.২৩-১২৭, তারিখ: ২৬ মে ২০২৪ খ্রিঃ। বদলির আদেশে বলা হয়েছে,

তিনি বর্তমান কর্মস্থলের দায়িত্বভার ২৯ মে ২০২৪ তারিখের মধ্যে হস্তান্তর করবেন। অন্যথায় ৩০ মে ২০২৪ তারিখ থেকে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত (Stand Released) বলে গণ্য হবেন। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন রয়েছে।

এ বদলির আদেশের ফলে সাতক্ষীরার প্রাথমিক শিক্ষক সমাজের মাঝে বিরাজ করছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। সাতক্ষীরা সদরে দায়িত্ব পালনকালে শিক্ষা অফিসার আবদুল গনির বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। অনৈতিক সম্পর্কের সাথেও জড়িয়ে তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছেন। শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে শিক্ষা অফিসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। নিজের অনৈতিক কর্মকান্ড ও দুর্নীতি চাপা দিতে পুষেছেন কয়েকজন দালাল। প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে শিক্ষা বসে এসব দালালরা সাধারণ শিক্ষকদের শাসাতেন। প্রতিবাদ করতে গেলে সাধারণ শিক্ষকরা নির্যাতনের শিকার হতেন।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার একাধিক শিক্ষক জানান, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোহা: আবদুল গনির স্ত্রী মোসাঃ মৌসুমী খাতুন সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন চাপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলায়। অভিযোগ ওঠে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার যেকোন স্কুলে গেলে সুন্দরী নারী বিশেষ করে বিধবাদের টার্গেট করতেন আবদুল গনি। নিয়ম ভেঙে ক্লাস্টারের অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দিতেন মাসুম বিল্লাহ ও নজরুল ইসলাম নামের দুজনকে। পরবর্তীতে এ তালিকায় যোগ হয় সঞ্জয় কুমার সরকার। শিক্ষা অফিসার আবদুল গনির সাথে যুক্ত হয়ে এসব কথিত অফিসারগণ দুর্নীতির দোকান খুলে বসেন সাতক্ষীরা সদরে।

আবদুল গনির ঘনিষ্ট সহচর নজরুল ইসলাম ও মাসুম বিল্লাহ অবৈধভাবে গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়।

শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, আবদুল গনি তার নিজ জেলা ছাড়াও ঢাকা ও রাজশাহীর পবা উপজেলায় সম্পদ ক্রয় করেছেন বলে গল্প দিয়ে বেড়ান। এছাড়াও তার কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ রয়েছে বলেও দর্প সহকারে বলে বেড়ান।

শিক্ষা অফিসার আবদুল গনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে শিক্ষকদের সাথে মিলে গড়ে তোলেন চিংড়ির ঘের। সদরের পূর্ব দহাকুলা সপ্রাবি প্রধান শিক্ষক শওকত হোসেন, দহাকুলা সপ্রাবি শিক্ষক হালিমুর রহমান এবং সাড়াতলা সপ্রাবি এর শিক্ষক

আবু মুসার সাথে যৌথভাবে চিংড়ি ঘের ব্যবসা (মৎস্য খামার) করে আসছেন। সাতক্ষীরা জেলাধীন দেবহাটা উপজেলায় ১০৮ বিঘা ও ৫০ বিঘা করে ২টি জমি লিজিডিড নিয়ে উক্ত ৪ জনই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অফিস চলাকালীন স্কুল ভিজিটের নাম করে চিংড়ি ঘের দেখাশুনা করেন। তাছাড়া গনির নিজ এলাকায় ৫০ লক্ষ টাকা করে ২টি ইটেরভাটায় দাদন (সুদে) দেওয়া আছে বলে জানায় সূত্রটি।

সূত্রটির দাবি, 'রাসেল সোনা' বই বিক্রি নিয়ে সাতক্ষীরায় চরম বিতর্কের জন্ম দেন আবদুল গনি।

শিক্ষকরা বলেন, আমরা শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের সুনামকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে হেয় প্রতিপন্ন করতে ইচ্ছাকৃতভাবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর ৬০০টাকার বই ৩০০০টাকা বাধ্যতামূলকভাবে সকল বিদ্যালয়ে বিক্রি করে ৫ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করার অপচেষ্টা করেন আবদুল গনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখা বইয়ের মূল্য ১৫০ টাকা। বইটি বিদ্যালয়ে সংগ্রহের কথা বললে আবদুল গনি শিক্ষকের সাথে মারমুখী আচরণ করেন।

সূত্রটি আরও জানান, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার প্রত্যাশায় চালুকৃত অনলাইন বদলি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করাসহ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে বিতর্কিত করার লক্ষ্যে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করছেন আবদুল গনি। ২০২৩ সালে সিলভার জুবিলী মডেল সপ্রাবিতে শরীফা লায়লুন্নাহার নামক একজন সহকারী শিক্ষকের নিকট হতে তিন লক্ষ টাকা নিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে বদলি করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। একই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষক প্রতি দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা করে নিয়ে হোসনে আরা চৌধুরীকে শাখরা কোমরপুর সপ্রাবি হতে কাঁঠালতলা সপ্রাবিতে এবং মুর্শিদা খাতুনকে কাঁঠালতলা সপ্রাবি হতে আলীপুর সেন্ট্রাল সপ্রাবিতে পোষ্টিং দেয়া হয়। প্রধান শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক তফুরা খাতুনকে দক্ষিণ সুলতানপুর সপ্রাবিতে দুই লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকার বিনিময়ে বদলি করা হয়। তাছাড়া পিটিআইতে প্রশিক্ষণরত পূর্ণিমা রানী নামক একজন শিক্ষককে তিনলক্ষ টাকার বিনিময়ে নীতিমালা অমান্য করে কালিগঞ্জের রায়পুর সপ্রাবিতে বদলি করেন। এভাবে বদলি বানিজ্য করে ২০২৩ সালে কুড়ি লক্ষাধিক টাকা বাগিয়ে নেন আবদুল গনি। এছাড়াও শিক্ষক পদ সমন্বয় বদলি করে বাঁশখাটা সপ্রাবি হতে বাটকেখালী সপ্রাবিতে অবৈধ বদলির করে কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন আবদুল গনি। ২০২৪ সালে অনলাইন বদলিতে সকলের কাগজপত্র জমা নিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে উৎকোচ গ্রহণ করেন আবদুল গনি ও তার সহযোগীরা।

সূত্রমতে, নিলাম ছাড়া বিভিন্ন স্কুলের ভবন ও গাছ বিক্রি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেন আবদুল গনি। সূত্রটি জানায়, খানপুর সপ্রাবি, পূর্ব দহাকুলা সপ্রাবি, আডুয়াখালী সপ্রাবি, ঝাউডাংগা সপ্রাবি প্রভৃতি স্কুল থেকে সরকারি সম্পদ বিক্রি করে কুড়ি লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেন আব্দুল গনি।

সূত্রটি আরও জানায়, বিগত ৩ বছরে বিভিন্ন সরকারি বরাদ্দের কাজ হতে বিপুল অর্থ উত্তোলন করেছেন। ক্ষুদ্র মেরামতের ৯২টি বিদ্যালয় হতে ৬০হাজার টাকা করে মোট পঞ্চান্ন লক্ষ টাকা, প্রতিবছর স্লিপ ফান্ড হতে ৮হাজার টাকা হারে ১৬ লক্ষাধিক টাকাসহ তিন বছরে ৫০ লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করেন আবদুল গনি। এছাড়া সিএসএসআর হতে ভ্যাটের নামে ৪২টি স্কুল থেকে ৩৫০০ টাকা করে এক লক্ষ ৪৭হাজার টাকা, নিড বেজড প্লেয়িং স্কুল প্রতি ৫৫হাজার টাকা দরে চুক্তি করিয়ে দু'বছরে প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকা আত্মাসাৎ করেছেন আবদুল গনি। ওয়াশব্লকের কাজ না করে তিন লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রুটিন মেরামত থেকে স্কুল প্রতি ১০হাজার টাকা তিন বছরে ত্রিশ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন বলে দাবি সূত্রের। এভাবে বিগত ৩ বছরে ২ কোটি টাকার বেশি অর্থ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করেছেন বলে সূত্রটি দাবি করে।

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালের উত্তরপত্র আগের অনেক পুরাতন কাগজপত্র স্টোররুম থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিক্রি করে ২লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

আবদুল গনি সাহেবের নিজস্ব নামে বরাদ্দকৃত মোটরসাইকেল রয়েছে। যার নং 'ঢাকা মেট্রো হ ৩৪-৬৭১৩। তিনি নিজের মোটরসাইকেল ব্যবহার না করে ডিপিইও অফিস হতে মোটরসাইকেল (যার নং 'ঢাকা মেট্রো হ ৩৫-২১৮০' ইয়ামাহা ক্যাক্স) নিয়ে ব্যবসার করছেন। এভাবে তিনি সরকারি ৪ লক্ষ টাকার সম্পদের ক্ষতি সাধন করে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন।

সূত্রটি আরও জানায়, এর পূর্বে আবদুল গনির বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ০৮ মে ৩৮. ০১. ৮৭০০. ২৭. ০০৮. ১৭-৭২০ সংখ্যক মোতাবেক শিক্ষক বদলিতে অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্য প্রমাণিত হয়, নিলাম ছাড়া স্কুলের ভবন ও গাছ বিক্রি, এডুকেশন ইমাজেন্সির টাকা আত্মসাৎ, সরকারি বরাদ্দ ছাড়ের নামে উৎকোচ গ্রহণ, সমাপনীর উত্তরপত্র বিক্রির অর্থ আত্মসাৎ, জাতীয় দিবসে অনুপস্থিত (প্রমাণিত হয়), শিক্ষার গুণগত মান ক্ষুন্ন করা, দুটি সরকারি মোটরসাইকেল ব্যবহার (প্রমাণিত হয়), অহেতুক হয়রানি, বিনা কারণে শোকজ নোটিশ প্রদান, দালাল শ্রেণির শিক্ষকদের সাথে বিশেষ সখ্যতাসহ মোট ১২টি বিষয়ের দুর্নীতি ও অনিয়মের উপর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হোসনে ইয়াসমিন করিমী। তার ২১ জুন ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি বিষয় তদন্তে প্রমাণিত লিখলেও তিনি আবদুল গনির বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোন সুপারিশ করেননি। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ৩৮. ০১. ৪৭০০.০০০.৯৯.০০২. ২১-৩১৫/৫ নং স্মারক মোতাবেক শেখ অহিদুল আলম, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, খুলনা কর্তৃক ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিবেদন সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে আবদুল গনি বলেন, মো. আবদুল গনি বলেন, হ্যাঁ আমার বদলি হয়েছে। আমি বদলীর আদেশ হাতে পেয়েছি। কি কারণে বদলি হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, সরকারি চাকরির সাধারণ নিয়মেই বদলি হয়েছে। এছাড়া অন্য কোন কারণ নেই। তার ব্যাপারে অভিযোগ উঠেছে তিনি সাতক্ষীরাতে চিংড়ি চাষের ঘের করেছেন। এ ব্যাপারে বলেন, পুরোটাই মিথ্যা। আমি কোন চিংড়ি চাষের সাথে জড়িত নই। এছাড়া কিছু অভিযোগ তদন্ত হয়েছে এবং কিছু অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। তবে এসব অভিযোগের কোন তদন্ত প্রতিবেদন তার নেই বলে জানান।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন