ডার্ক মোড
Friday, 01 November 2024
ePaper   
Logo
দুদকের জালে গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ও স্ত্রী সন্তান

দুদকের জালে গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল ও স্ত্রী সন্তান

নিজস্ব প্রতিবেদক

গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (বর্তমানে হাউস অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক) মো. আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিকানা অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।

বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম সিন্ডিকেটের ঠিকাদারের গভীর যোগসূত্র থাকা, ১৫ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়া ও নিম্নমানের কাজের সুযোগ দেওয়া, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত অর্থে দেশে-বিদেশে তিনি নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক আনোয়ারুল হককে প্রধান করে দুই সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান দল তাদের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য জানাতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে ২০ মার্চের মধ্যে তথ্য দুদকে জমা দিতে বলা হয়েছে।

দুদকের তথ্যমতে, প্রকৌশলী আশরাফুল আলম গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী থাকাকালে এবং এর আগে বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ-দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন। এসব অর্থ থেকে তিনি দেশে-বিদেশে নিজে ও স্ত্রী-সন্তানের নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কিনেছেন বলে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে।

কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল হক ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকীর সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে। দুদকের অনুসন্ধান দল অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আশরাফুল আলম ও তার পরিবারের ৫ সদস্যের নামে রাজউকের আওতায় কোনো বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, দোকানপাট থাকলে তা দুদকে পাঠাতে গত ১২ মার্চ রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়। একই সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও রিহ্যাবে চিঠি পাঠানো হয়।

অনুসন্ধান টিমের সদস্য সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকী স্বাক্ষরিতে চিঠিতে বলা হয়, প্রকৌশলী আশরাফুল আলমসহ ৬ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে প্রকৌশলী আশরাফুল আলম, স্ত্রী সাবিনা আলম, সন্তান যারিন তাসনীম, নিশাত তাসনীম, ফারিহা তাসনীম ও আহনাফ সারাফের নামে রাজউকের আওতায় থাকা বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, দোকানপাট থাকলে তা ২০ মার্চের মধ্যে দুদকে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হলো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধান টিমের একজন কর্মকর্তা সংবাদদাতাকে বলেন, আশরাফুল আলমের অবৈধ সম্পদ অর্জনের একটি অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাদের সম্পদের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু তথ্য-উপাত্ত দুদকে আসতে শুরু করেছে। সব তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পর তা যাচাই শেষে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগে বলা হয়, কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম সিন্ডিকেটের ঠিকাদারের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র আছে প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের। ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে প্রতিটি প্রকল্প থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন পান তিনি। এ ছাড়া গণপূর্ত অধিদপ্তরের শেরেবাংলা নগর ডিভিশন-১-এ একসময় নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন আশরাফুল আলম।

সেখানে দায়িত্ব পালনের সময় ২০০৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়ে ৩০০ জনকে ভাউচারভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগ দেন। তার বিরুদ্ধে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে ১৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

দুদকের তথ্যমতে, এর আগে ২০১৯ সালের আগস্টে আশরাফুল আলম ও তার স্ত্রী সাবিনা আলমের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুদক। ওই সময় সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মেফতাহুল জান্নাত অনুসন্ধান কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। তখন দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য-উপাত্ত পেয়েছিল দুদক। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি আশরাফুল আলম ও তার স্ত্রী সাবিনার কাছে সম্পদের হিসাব বিবরণী চেয়ে পৃথক দুটি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল।

দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলম স্বাক্ষরিত নোটিশে আশরাফুল আলমের নিজের, তার স্ত্রী এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, দায়দেনা, আয়ের উৎস ও তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ নির্ধারিত ফরমে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে দাখিল করতে বলা হয়। ওই সময়ে প্রকৌশলী আশরাফুল আলম দুদক থেকে দায়মুক্তি পেতে চেষ্টা-তদবির শুরু করেন, একপর্যায়ে তিনি সফলও হন। দুদক থেকে দায়মুক্তি পেতে তিনি মোটা অঙ্কের অর্থের ব্যয় করেছেন এমন অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।

এ ঘটনাটি উচ্চ আদালতের নজরে আনা হলে ২০২২ সালের ২১ জুন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চ শুনানি শেষে আশরাফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পুনরায় অনুসন্ধান করার আদেশ দেন।

একই সঙ্গে দুদকের আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা বাদ দিয়ে নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে বলেন দুদক আইনজীবীকে। উচ্চ আদালতের আদেশে প্রকৌশলী আশলাফুল আলম ও তার স্ত্রী-সন্তানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান পুনরায় শুরু করে দুদক। নতুন করে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংস্থাটির উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল হক ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকীকে।

জানা গেছে, বিসিএস ১৫তম ব্যাচের প্রকৌশলী আশরাফুল আলম ১৯৯৫ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে উপবিভাগীয় প্রকৌলী, ২০০৭ সালে নির্বাহী প্রকৌশলী, ২০১৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, ২০১৮ সালে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পান মো. আশরাফুল আলম। গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী পদ পদোন্নতি পেতে তিনি ২০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত ২ ও ৪ এপ্রিল কয়েকবার আশরাফুল আলমের মোবাইলফোনে কল দেওয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন