কুড়িগ্রামে তহশিলদারের সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় মানুষ
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
পদ অনুযায়ী অভিযোগ পাহাড় সমান থাকলেও স্বপদে থেকে দিব্যি দুর্নীতি করে যাচ্ছেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা সাহাদৎ হোসেন। একের পর এক লিখিত অভিযোগ করে প্রতিকার না পেয়ে তার সিন্ডিকেট চক্রের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন অভিযোগকারীরা।
অভিযোগকারী দম্পতিকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন, ইউনিয়ন পরিষদের জায়গা ভূমি অন্যের নামে ভূমি বন্দোবস্ত, জবর দখল, ভূমিহীন পরিবারের বসতভিটা অন্যের নামে ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া, একই জমি একই ব্যক্তির নামে একাধিকবার নাম খারিজ করে দেওয়াসহ প্রকাশ্যে ঘুষ বাণিজ্য করার হাজারও অভিযোগ ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার) সাহাদৎ হোসেনের বিরুদ্ধে। অদৃশ্য কারণে তার অনিয়ম-দুর্ণীতি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেও প্রতিকার না পেয়ে উল্টো সিন্ডিকেট চক্রের রোষানলে পড়তে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের ।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র ও ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে অর্থ নিয়ে কাজ না করার অভিযোগ করেছিলেন রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের জাবেদ আলী-হাফিজা বেগম নামক এক ভূমিহীন দম্পতি। এসিল্যান্ড অফিসে তাদের অভিযোগের শুনানি ছিল ৬জুন ২০২১। অফিসের কাছাকাছি পৌঁছলে ওইদিন রবিবার সকাল ১১টার দিকে ভূমিহীন দম্পতি জাবেদ আলী-হাফিজা বেগমকে অপহরণ করেন তহশিলদার ও তার লোকজন। উপজেলা ভূমি অফিসের পাশেই কাঁচা বাজারে অবস্থিত ৪তলা ভবনের একটি কক্ষে প্রায় ২ঘন্টা আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ঘটনাটি জেলা প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছলে তাদের হস্তক্ষেপে সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানভীর আহমেদ ওই দম্পতিকে উদ্ধার করেন।
অভিযোগকারী জাবেদ আলী বলেন, তাদের একমাত্র বসতভিটার ১৬শতক জমি ভুলক্রমে খাস খতিয়ানভুক্ত হয়। সে জমিতে তারা ঘর তুলে বাপদাদার আমল থেকে বসবাস করছেন। সেই ভূমি বন্দোবস্ত করে দিবেন বলে তাদের কাছ থেকে ৫৫হাজার টাকা নেন তহশিলদার সাহাদৎ হোসেন। ১৬শতক জমির মধ্যে ৯শতক জমি ভূমি বন্দোবস্ত করে দেন। বাকী ৭শতক জমি না পেয়ে টাকা ফেরত চেয়ে চলতি বছরের ২১জানুয়ারি রৌমারী ভূমি কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেন তারা। অভিযোগের বিষয়ে জানতে পেরে কয়েক দিন পরে ১৫হাজার টাকা ফেরত দেন অভিযুক্ত তহশিলদার। বাকী টাকা ফেরতসহ বাকি ৭শতক জমির নাম খারিজ দ্রুত করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার কাছ থেকে একটি সাদা কাগজে টিপসই নেন ওই তহশিলদার।
দীর্ঘদিন ঘুরেও জমির খারিজ ও বাকী টাকা না পেয়ে গত ১২ এপ্রিল আবারও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে ৬জুন নোটিশের মাধ্যমে সহকারী কমিশনারের কার্যালয়ে ডাকা হয় তাকে। পরে স্ত্রীসহ তিনি উপজেলার থানা মোড়ে পৌঁছলে তহশিলদার সাহাদৎ হোসেনের নেতৃতে মাইদুল ইসলাম, আনিছুর রহমান (মুক্তা), নজরুল ইসলাম, বাবু মিয়াসহ ১০-১২জন তাদের দু’জনকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রায় ২ঘন্টা আটকে রাখে। এসময় খবর পেয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তারা উদ্ধার হয়। পরে ওই দিনই জাবেদ আলীর স্ত্রী হাফিজা বেগম বাদী হয়ে তহশিলদার সাহাদৎ হোসেনসহ ১০/১২জনকে আসামি করে রৌমারী থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
যাদুরচর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরবেশ আলী বলেন, ‘কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই, মাঠ জরিপ ছাড়াই যাদুরচর ইউনিয়ন পরিষদের নামে দলিলকৃত ও ভোগ দখলীয় পুকুরের ৩০শতক জমি অবৈধভাবে স্থানীয় ৫জন ব্যক্তির নামে ভূমি বন্দোবস্ত করে দেন তহশিলদার সাহাদৎ হোসেন এবং সার্ভেয়ার আব্দুল আউয়াল। ভূমি অফিসের এই দুই কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদদে গত ৫এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ইউনিয়ন পরিষদের পুকুর পাড় জবর দখল করে ৫টি ছোট ঘর তোলেন ভূমি বন্দোবস্ত নেওয়া ব্যক্তিরা। এ নিয়ে গত ৬এপ্রিল রৌমারী সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা সাহাদৎ হোসেন, সার্ভেয়ার আব্দুল আউয়ালসহ ৭জনকে অভিযুক্ত করে রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের বড়াইবাড়ি এলাকার রফিকুল ইসলাম নামক ভুক্তভোগী বলেন, তার মায়ের নামীয় ১৬শতক জমির নামখারিজ করে দিবেন বলে তহশিলদার সাহাদৎ হোসেন তার কাছ থেকে দুই ধাপে সাড়ে ৬হাজার টাকা নিয়েছেন কিন্তু নামখারিজ করে দিচ্ছেন না। ১বছর ধরে ঘোরাচ্ছেন। মায়ের চিকিৎসার খরচ ও অভাবের কারণে জমিটি বিক্রি করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নাই। কিন্তু নামখারিজ না থাকায় তা বিক্রি করতে পারছেন না।
যাদুরচর পূর্বপাড়া এলাকার ভূমিহীন আবু বক্কর মিয়া বলেন, তার ভোগদখলীয় পৈতৃক বসতভিটার ২৪শতক জমি অবৈধভাবে অন্য তিন ব্যক্তির নামে ভূমি বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন তহশিলদার সাহাদৎ হোসেন। অবৈধ ভূমি বন্দোবস্ত বাতিলসহ তহশিলদার সাহাদৎ’র শাস্তির দাবী জানান তিনি।
ভুক্তভোগী আমজাদ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, তহশিলদার সাহাদৎ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। হিসেব করলে পাহাড় সম অভিযোগ তার বিরুদ্ধে কিন্তু তিনি স্বপদে বহাল রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে তার সিন্ডিেিকেটের সদস্যদের লেলিয়ে দেওয়া হয় অভিযোগকারীদের ক্ষতি করার জন্য। তহশিলদারের সিন্ডিকেটের কাছে সবাই অসহায়।’
একই এলাকার আবুল কালাম অভিযোগ করে বলেন, ৫৩বছর ধরে তাদের ভোগদখলীয় ও রেকর্ডকৃত ১৩শতক জমি যাচাই-বাছাই, মাঠ-জরিপ ছাড়াই টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে ২০১৭ সালে একই এলাকার আবুল ফজল গং’র নামে নামখারিজ করে দেন তহশিলদার সাহাদৎ হোসেন। পরে বিষয়টি জানতে পেরে আবুল কালাম বাদী হয়ে মিস কেস দায়ের করলে আবুল ফজল গং’র নামখারিজটি ২০২০সালে বাতিল হয়। ২০২০সালে ওই একই আবারও আবুল ফজল গং’র নামে নামখারিজ করে দেন তহশিলদার সাহাদৎ হোসেন। যে কোনো উপায়ে জমিটি জবর দখলের মদদ দেন তহশিলদার সাহাদৎ। এ নিয়ে গত ২৮জানুয়ারি আবুল কালাম বাদী হয়ে তহশিলদার সাহাদৎ হোসেনসহ ৮জনকে আসামি করে রৌমারী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযুক্ত রৌমারী সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদার) সাহাদৎ হোসেন বলেন, আমার নামের সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমার সম্পর্কে যদি কিছু জানতে হয় তবে আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসিল্যান্ড সাহেবের কাছে জানতে পারবেন। এই বলে তিনি মোবাইল সংযোগ কেটে দেন।
এ বিষয়ে কথা হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানভীর আহমেদ তহশিলদার সাহাদৎ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার কথা প্রথমে স্বীকার করতে চান না এবং রিপোর্ট না করার অনুরোধ করেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আপনাকে সব অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে কেন আপনি লুকাতে চাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানভীর আহমেদ বলেন, ‘আমি মাত্র ১ মাস আগে এখানে যোগদান করেছি। তহশিলদারের বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হবে। আমি এ অফিসের সব অনিয়ম দুর্নীতি দূর করার চেষ্টা করছি। আপনাদের সহযোগিতা চাই। আর আমার নাম বাদ দিয়ে রিপোর্ট করার অনুরোধ করছি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল ইমরান বলেন, ‘রৌমারী সদর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযোগ পেয়েছি, সবগুলো নতুন যোগদানকারী এসিল্যান্ডকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছি। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’