ডার্ক মোড
Tuesday, 24 December 2024
ePaper   
Logo
ভারত উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পাকশী রেলওয়ে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের দু’দিনব্যাপি জাকজমকপূর্ণ শতবর্ষ পালিত

ভারত উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পাকশী রেলওয়ে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের দু’দিনব্যাপি জাকজমকপূর্ণ শতবর্ষ পালিত

ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি, ঈশ্বরদী (পাবনা)

বিশ থেকে কারো বয়স আশি, কারো বয়স ৮৫ বছর । ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সী প্রাক্তনীদের সংখ্যা ছিল বেশী । তবে ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সীর সংখ্যাও কম ছিলনা। একে অপরের সাথে দেখা ৩০ থেকে ৬০ বছর পর। এত বছর পর বন্ধুকে কাছে পেয়ে প্রথম প্রশ্ন কেমন আছিস বন্ধু।

তোর বউ,ছেলে মেয়েরা কেম আছে,তুই কেমন আছিস ? এরপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছেলেবেলায় ফিরে গিয়ে নানা স্মৃতি রোমন্থন করা ছিল আকর্ষনীয় বিষয়। কেউ কেউ দদাঁড়িয়ে,কেউ টিস্টলে বা গোল ঘর বা বুক স্টলে আড্ডা ছিল চোখে ধরার মত। সব বয়স, বাধা ফেলে তারা এক হয়েছিলেন একদিনে এক জায়গায়। এতবছর পর সহপাঠি, বন্ধু-বান্ধবীকে কাছে পেয়ে উচ্ছসিত ছিল সবাই।

বাবা মায়ের আনন্দ দেকে ও কথোপকথন শুনে ছেলে ছেলে মেয়েরা তাদের অনুভ’তি প্রকাশ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছে,আমার ইচ্ছা হচ্ছে আমি যদি এই স্কুলে পড়তে পারতাম খুব ভাল হতো। না দেখলে ভাবা কঠিন কি যে আবেগঘন মুহূর্ত ছিল গোটা আয়োজনের মাঠ জুড়ে। প্রাণের টানে এমনই মিলনমেলা বসেছিল ঈশ^রদীর গর্বিত কন্যা ও প্রকৃতির রুপ তিলক বলে খ্যাত ঈশ^রদীর পাকশী পদ্মানদীর কোল ঘেষে বৃটিশ আমলে গড়ে ওঠা পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে অফিসের ঐতিহাসিক ফুটবল মাঠে। রেলওয়ের প্রায় দেড়’শ বছরের ইতিহাসের সাথে নানাভাবে জড়িয়ে থাকা ঈশ্বরদীর পাকশীস্থ ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ।

আলোকিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একশ’ বছর অতিক্রম করে আরও এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে। একশ বছরে রেলওয়ের সরকারি এই চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে কলকাতা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র,বিএনপির কেন্দ্রিয় নেতা সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সরদার,মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানী কমান্ডার এড.সদরুল হক সুধা,আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ,তার বিদেশে বসবাসকারী অন্যান্য বড় ভাই বড়ভাই,সচীব পর্যায়ের আমলা,আমেরিকায় বসবাসকারী ওয়াহেদ আলী খান বাচ্চু, শিক্ষাবিদ,শিল্পতি,কিডনীপ্রতিস্থাপন কারী ডা: কামরুল ইসলাম ও ডা: শাহেদ ইমরানের মত অসংখ্য চিকিৎসক ও ময়েন উদ্দিন রবির মত অসংখ্য ঘুনীজনের সুষ্টি করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সেজন্যই এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে দুইদিনব্যাপী জমকালো শতবর্ষ উৎসবের আয়োজন করে স্কুলটির প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। আয়োজনের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন,এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বিএনপির কেন্দ্রিয় নেতা সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সরদার,প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন,মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানী কমান্ডার এড.সদরুল হক সুধা ও সদস্য সচীব ছিলেন,বিশিষ্ট শিল্পপতি আশরাফ আলী খান মঞ্জু। সাথে ছিলেন, অসংখ্য উদ্যমী সংগঠক বিভিন্ন বয়সী প্রাক্তনীরা।

গত শুক্রবার (২১ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হয় দু’দিনব্যাপী আয়োজন। এর আগ থেকে প্রায় একমাস থেকে গোটা মাঠকে বর্ণিল সাজে সাজানো হয় চোখে ধরার মত করে । অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগ থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাণের টানে ছুটে আসেন নিজ এলাকা ঈশ্বরদী ও পাকশীতে । গত শনিবার (২২ ডিসেম্বর/২৪) আনন্দ শোভাযাত্রা, স্মৃতি চারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বর্ণিল আয়োজনে চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের শতবর্ষ পূর্তি উৎসব উদযাপন করা হয়। শুক্রবার সকাল থেকেই তারা হাজির হন উৎসবের স্থান পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ফুটবল মাঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন প্রাক্তণ সব শিক্ষার্থীরা। একসাথে পড়াশোনা করা তাদের কেউ জীবনের শেষ সায়াহ্নে,কেউ মধ্যবয়সী, কেউবা ভয়সের ভারে ন্যুজ। দীর্ঘবছর পর প্রিয় বন্ধু সহপাঠীকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরাধরি,হাসি,ঠাট্টা ছিল দেখার মত। খোঁজ খবর নেন একে অপরের। অনেকে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। স্কুল জীবনের প্রেমকাহিনী আর আনন্দ উচ্ছাস ও গল্প আড্ডায় ফিরে যান সেই স্কুল জীবনে। মেতে উঠেছিলেন খুনসুটিতে।

শনিবার সকালে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ফুটবল মাঠ থেকে একটা বর্ণিল শোভাযাত্রা বের হয়। শতবর্ষ পূর্তি উৎসবের থিম সং এর সুরে হাতি, ঘোড়ার গাড়ি, ব্যানার, ফেস্টুন, বাদ্য যন্ত্রের বাজনার তালে নেচে গেয়ে শোভাযাত্রা নিয়ে স্মৃতিঘেরা স্কুল প্রাঙ্গণে মিলিত হন শিক্ষার্থীরা। স্কুলের প্রধান ফটকে গিয়ে অনেকেই স্মৃতি ধরে রাখতে ছবি তোলেন। কেউবা স্কুলের পাশে মসজিদ প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখেন। শোভাযাত্রা শেষে দীর্ঘ বছর পর নিজেদের প্রিয় স্কুলের আঙিনায় পা রাখেন প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা। সেখানে জাতীয় সংগীতের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষর্থীরা। জাতীয় সঙ্গীত শেষে হাত তুলে জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শণ করেন তারা। এর আগে স্কুলের ঘন্টা বাজিয়ে লাইন ধরে দাঁড়ান প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা। শুধু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই নয়, দেশের বাইরে থেকেও বন্ধুরা আসেন নিজেদের স্কুলের শতবর্ষ আয়োজনে। আনন্দ ভাগাভাগি করতে পেরে উচ্ছসিত তারা।

এরপর বিকেলে রেলওয়ে মাঠে প্রধান অতিথি হিসেবে জাতীয় সঙ্গীতের সুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. আফজাল হোসেন। এ সময় প্রাক্তনী,বিএনপির কেন্দ্রিয় নেতা সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম সরদার,প্রধান উপদেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানী কমান্ডার এড.সদরুল হক সুধা ও প্রাক্তনী সদস্য সচীব বিশিষ্ট শিল্পপতি আশরাফ আলী খান মঞ্জুও অংশ নেন পতাকা উত্তলনে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা পুরনো বন্ধুদের সাথে স্মৃতিচারণ ও আড্ডায় মেতে ওঠেন। সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঈশ^রদীর কৃতি সন্তান সোহেল মেহেদী,রবি চৌধুরী,লুইপা ও উপজাতী শিল্পীদের কন্ঠে ও মনমাতানো নৃত্যের মধ্য দিয়ে গভীররাতে শেষ হয় দু’দিনের উৎসব।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘এত বড় একটি আয়োজনে আমি উপস্থিত থাকতে পেরে খুবই আনন্দিত, অভিভূত। নিজেকে ধন্য মনে করছি। না আসলে বুঝতে পারতাম না এত সুন্দর আয়োজন, এত মানুষের উপস্থিতি। এই আয়োজন নতুন ও পুরাতনের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরী করবে মনে করি।’

চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের ৬৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মচারী কাজী বদরুল হক মুক্তা বলেন, ‘মনে হচ্ছে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছি। স্কুলের কত স্মৃতি মনে পড়ছে। আমি আমার বন্ধু আলাউদ্দিন খেলাধুলায় ভাল ছিলাম। আমরা স্কুলের খেলায় একে অপরকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিতাম। যাতে নিজেরা প্রথম হতে পারি। আমার সেই বন্ধু আলাউদ্দিনের সাথে দেখা হলো। শেষ বয়সে অনেক ভাই বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে অনেক ভাল লাগলো।’

৮৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী ব্যবসায়ী আব্দুল হক ও জিন্নাহ হক বলেন, ‘দীর্ঘ ৪০ বছর পর বন্ধু বান্ধবদের সাথে দেখা হলো। এই শতবর্ষ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য জন্য খুবই উচ্ছসিত ছিলাম। তাই আমেরিকা থেকে ছুটে আসছি। স্কুলের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অনেক সময় স্কুলের অ্যাসেম্বলী ফাঁকি দিতাম। শিক্ষকরা খুব কড়া শাসনে রাখতেন আমাদের। মাঝে মধ্যে অ্যাসেম্বলী না করায় শিক্ষকদের ভয়ে আর স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে চলে যেতাম।’ ৮৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী বর্তমানে ব্যবসায়ী আকতার উজ্জামান ও জিয়াউল হক বলেন, ‘জীবন সন্ধিক্ষণে ছোট্ট ছোট্ট সময় যে বন্ধুগুলো পেয়েছি, প্রায় দীর্ঘ ৪৮ বছর পর সেই বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। সেই সময় কে কি করছি অনেক স্মৃতি রোমন্ধন করলাম, সেইদিনে ফিরেছিলাম আমরা। একে অপরের সাথে ভবিষ্যতে যোগাযোগের জন্য মোবাইল নাম্বার রাখলাম। এক কথায় স্কুলজীবনের সময়টা ছিল প্রাকৃতিক। আর বর্তমান এখন যান্ত্রিক। তাই এমন আয়োজন খুব দরকার ছিল।’ ৯২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আশরাফুল আলম বলেন, ‘আমরা প্রিয় স্কুল ঘুরে আসলাম। ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে আবেগ আপ্লুুত হয়ে পড়েছিলাম। স্কুলের পাশে মসজিদটি দেখে মনে পড়লো যখন আমরা স্কুল ফাঁকি দিতাম তখন ওই মসজিদের বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকতাম। আজ আমরা আবার প্রাণ ফিরে পেলাম, মনে হলো আমাদের বয়স সেই ১৪ কি ১৫ বছর বয়সে ফিরে গিয়েছি।’

শতর্বষ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব আশরাফ আলী খান মঞ্জু বলেন, ‘এই স্কুলের শতবর্ষ উৎসব আয়োজনে আমরা সবচেয়ে পুরাতন ১৯৫৪ সালের শিক্ষার্থী একজনকে খুঁজে পেয়েছি আমরা। ১৯৫৮ সালের একজনকে পেয়েছি। এই মিলনমেলায় সকলেই আনন্দিত। ফেলে আসা দিনগুলোকে সবাই একদিনে ফিরিয়ে এনে আনন্দ ভাগাভাগি করেছি আমরা। এই প্রাপ্তিটাই আয়োজনের সার্থকতা। শতবর্ষ উৎসবে প্রাক্তণ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার মিলে অন্তত দশ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন