ডার্ক মোড
Saturday, 22 February 2025
ePaper   
Logo
বাংলাদেশে বেকারত্ব বিনিয়োগ বাড়ালেই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব

বাংলাদেশে বেকারত্ব বিনিয়োগ বাড়ালেই বেকারত্ব দূর করা সম্ভব

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে প্রকট হওয়া বেকার সমস্যার জন্য সমাধান অনুযায়ী প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, তবেই গড়ে উঠবে বিশ্বমানের দক্ষ জনশক্তি আর সমাধান হবে বেকারত্বের। এছাড়াও গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেকারত্ব সমস্যা তীব্র হয়েছে গ্রামীণ এলাকায়। এখন প্রয়োজন কৃষি, অকৃষি সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ। শুধু অর্থায়ন জরুরি না, তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন, ব্যবসায়িক উন্নয়ন মডেলও সমন্বয় করা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর লালমাটিয়ায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্টের অফিসে আয়োজিত ‘বাংলাদেশে শ্রমবাজারের গতিশীলতা এবং কর্মসংস্থানের স্তর: চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রগতির পথ’ শীর্ষক বিশেষ সেমিনারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ড. মুস্তফা কামাল মুজেরী এই মন্তব্য করেন।

ইদানিং কেয়ার গিভার, প্যালিয়েটিভ কেয়ার (উপশম যত্ন), নার্সিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে কর্মসংস্থানের সুযোগের দিকে ফোকাস বাড়াতে পারলে দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি রপ্তানি সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন, দেশের বৃহৎ চাকুরির বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ওয়েবসাইট বিডিজবসের মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের পরিচালক প্রকাশ রায় চৌধুরী। মুজেরী তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, প্রযুক্তি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করছে। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বর্তমানের আরও সব উন্নত প্রযুক্তির সাথে যত দ্রুত আমরা খাপ খাইয়ে নিতে পারব, তত দ্রুত বেকার সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ড. মুজেরী।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) – এর সাবেক এই মহাপরিচালক আরও বলেন, লেনদেনযোগ্য পণ্যের উৎপাদনে যেমন গুরুত্ব থাকবে তেমনি অবাণিজ্যযোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব রয়েছে। তাতে মানুষ নিজেই উৎপাদন করে নিজের জন্যে ব্যবহার করবে এবং স্বয়ংসম্পন্ন হবে। এক্ষেত্রেও প্রযুক্তির সমন্বয়ের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন এই অর্থনীতিবীদ।
গবেষণা ও নীতিসহায়ক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুজেরী জানান, আমাদের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ আয় (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আর্ন) করতে হবে। এই আয় করার অবস্থা আমরা তৈরি করতে পারিনি। এক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি অনেক বড় প্রভাবক ছিল বলে অন্যান্য বক্তাদের সুরে সুর মেলান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ মুজেরী। প্রযুক্তির সঠিক সহায়তায় এমন ঘাটতি পূরণের আহ্বান জানান তিনি।

সেমিনারের মডারেটর বিআইএসআর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. খুরশিদ আলম বলেন, আমরা চরম বেকারত্বের একটি জলজ্যান্ত নমুনা দেখতে পাচ্ছি বর্তমানে অহরহ ছিনতাইয়ের খবর থেকে। বেকারত্ব ঘোচানোর যে আশা নিয়ে তরুণ সমাজের এত ত্যাগ ও সংগ্রাম তা এখনও সেই অর্থে পূরণের কোন নমুনা চোখে পড়েনি। বেকারত্বকে এখনও তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। ড. আলম বলেন, আমার গবেষণায় পেয়েছিলাম, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া এই দেশগুলো বেকারত্ব রোধে নিজের জনশক্তি বাইরে রপ্তানি না করে দেশের বাইরে থেকে বিনিয়োগ নিয়ে আসে এবং তাদের বেকার সমস্যার অনেকাংশে সমাধান করে। আর আমরা রেমিটেন্স নির্ভর হয়ে যাচ্ছি নিজেদের জনশক্তিকে দক্ষ না করেই। আমাদেরও উচিত দেশীয় উৎপাদন ও বিনিয়োগে জোর দেওয়া। তিনি আরও বলেন, নব্বয়ের দশকে আমাদের দেশে জনসংখ্যাকে চিহ্নিত করা হয় এক নম্বর সমস্যা হিসেবে। সেখানে সেই সমস্যা মোকাবিলায় নিয়োগ দেওয়া হত সরকারের দশ নম্বর শ্রেণীর কর্মকর্তাকে। অর্থাৎ সবচেয়ে বড় সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে কম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মকর্তা নিয়োগ। এইসব চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। এছাড়াও জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে দক্ষ লোক নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেন ড. আলম, যাতে করে তারা বেকারদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা করতে পারে।

বিডিজবস ডটকমের মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের পরিচালক প্রকাশ রায় চৌধুরী যিনি প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ২১ বছর ধরে কর্মরত, তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানান, কৃষিখাতে বা শ্রমিকদের মধ্যে তেমন কেউ বেকার থাকছে না। অটোরিকশা চালিয়েও বেকারত্ব ঘোঁচাতে পারছেন তাঁরা। বর্তমানে স্নাতকদের কর্মসংস্থান (গ্রাজুয়েট এম্পয়মেন্ট) এর অবস্থা ভয়াবহ। আমাদের দেশের মত মাস্টার ডিগ্রিধারীদের ঘনত্ব হয়ত পৃথিবীর আর কোন দেশে বিরল।

গ্রাজুয়েটদের জন্যেও যেমন পর্যাপ্ত চাকুরি নেই, ঠিক তেমনই শূন্যপদের চাকুরি (এভেইলেবল জব) গুলোর জন্যেও দক্ষ জনশক্তি নেই। জব সেক্টরে পরিবর্তন আসছে, দক্ষতায় ভিন্নতা এসেছে, কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও তেমন পরিবর্তন আসেনি। গ্লোবাল ভ্যালু চেইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এগিয়ে যেতে হবে বলে তিনি জানান।

দেশের বৃহৎ চাকুরির বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ওয়েবসাইট বিডিজবসের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্তমানের তরুণ গ্রাজুয়েটরা শুধু সরকারি চাকরি, বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যাংক, আন্তর্জাতিক এনজিওতে চাকরি পেতে চায়। এক্ষেত্রে সীমিত ক্ষেত্রে বড় প্রতিযোগিতা দেখা যায়। তরুণদের এই বিষয়ে উপলব্ধিতে সমস্যা লক্ষণীয়। অথচ গার্মেন্টস খাত অনেক বড় একটি ক্ষেত্র। এখানে শিক্ষিত গ্রাজুয়েটদের তেমন কোন ফোকাস দেখা যায় না। আর তাই দেশের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি এই শিল্পটি মানসম্পন্ন জনশক্তি পায় না। এছাড়াও অনেকেই এখন ঢাকায় চাকরি করতে চায়, মফস্বলে না। একবার স্যামসাং - গবেষণা ও উন্নয়ন বাংলাদেশে এসেছিল, চাকরিও দিয়েছিল আমাদের দেশের কর্মীদের। তবে তাদের যে কোন কারণে আর চাকরি করা হয়নি।

তিনি যোগ করেন, সুযোগেরও যেমন অভাব রয়েছে, তেমন দক্ষতারও অভাব রয়েছে। এর ফলে যতটুকু চাকরির বাজার আছে সেটাও ধরতে পারছেন না গ্রাজুয়েটরা। আবার অরেকটি বড় সমস্যা হল, নিয়োগকারীরা দক্ষ জনবলও চান, কিন্তু আবার কম বেতনও দিতে চান। এক্ষেত্রে শিক্ষিত বেকারের পরিমাণ বাড়ে। এছাড়া দেশে ব্যক্তির চাহিদানুযায়ী কাজের সুযোগ কম থাকায় বিদেশি শ্রমবাজার ধরতে হয়। গ্রাজুয়েটদের আলাদা করে শ্রমশক্তি হিসেবে রপ্তানির উদ্যোগ দেখা যায় না। অনেকে যান অদক্ষ শ্রমিক কোটায়।

জনাব প্রকাশ পরামর্শ দেন, ইদানিং কেয়ার গিভার, প্যালিয়েটিভ কেয়ার (উপশম যত্ন), নার্সিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সেক্টরগুলোয় ফোকাস বাড়াতে পারলে দক্ষতা সম্পন্ন জনশক্তি রপ্তানি সম্ভব। ড. বদরুন নেছা আহমেদ, জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো (সিনিয়র রিসার্চ ফেলো), বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, দাবি করেন, জব মার্কেট ট্রেন্ড বিষয়ে তথ্যের ঘাটতি (ইনফরমেশন গ্যাপ) আছে। আর এই ঘাটতি দূর করতে না পারলে বেকারত্বের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এছাড়াও জব মিস ম্যাচ আরেকটি ইস্যু। নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাইছি এক দিকে, আর নিজেকে এমপ্লয় করছি আরেক দিকে। এটাও তথ্যগত ঘাটতির জন্য। তাই তিনি দক্ষ শ্রমশক্তির জন্য প্রশিক্ষণ, আইসিটি প্রশিক্ষণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জব ফেয়ার আয়োজনের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. বদরুন জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজগুলোর যেগুলোয় গবেষণার কাজে নমুনায়ন (স্যাম্পলিং) করা হয়েছিল তার ১% কলেজেও জব ফেয়ার (চাকুরি মেলা) আয়োজন করা হয় না। তরুণরা জানতেও পারে না নতুন নতুন সুযোগ সম্পর্কে। ড. বদরুন সব শ্রেণীর বেকারত্বের জন্যে আলাদা আলাদা পলিসি বা নীতি প্রণয়নের সুপারিশ করেন। শিক্ষিত বেকারদের জন্য একটি পরিশীলিত নীতি (সফিস্টিকেটেড পলিসি) থাকার বিষয়ে তিনি গুরুত্বারোপ করেন। কারণ তারাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে। বিশেষ এই সেমিনারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিআইএসআর ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকগণ, শিক্ষকসহ এনজিও কর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন