ডার্ক মোড
Wednesday, 21 May 2025
ePaper   
Logo
তিন পুরুষের ঐতিহ্য আর এক মানুষের সংগ্রামে ময়মনসিংহে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম

তিন পুরুষের ঐতিহ্য আর এক মানুষের সংগ্রামে ময়মনসিংহে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম

মো: আবুল মনসুর

এক সময় ময়মনসিংহের জনপদে লোকজ সুরে ভেসে বেড়াত মানুষের জীবন। বাঁশি, দোতারা, একতারা, সারিন্দা ছিল মানুষের আনন্দ-বেদনার অনন্য সঙ্গী। কালের বিবর্তন আর প্রযুক্তির আধুনিকতায় হারিয়ে যেতে বসেছে সেই সব বাদ্যযন্ত্র। এমন এক সংকটে দাঁড়িয়ে একক প্রচেষ্টায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন ময়মনসিংহের রেজাউল করিম আসলাম।

পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক এই মানুষটি নিজস্ব অর্থায়নে গড়ে তুলেছেন “এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম”—যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় ৬০০টিরও বেশি দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় বাদ্যযন্ত্র। যা আজ বাংলাদেশের সংগীত সংস্কৃতির অতীতকে ধারণ করছে নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় উচ্চারণে।

রেজাউল করিমের দাদা নবাব আলী ১৯৪৪ সালে ময়মনসিংহের দুর্গাবাড়ি এলাকায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। পরে তার বাবা জালাল উদ্দিন সেই ব্যবসার হাল ধরেন। তিন পুরুষের সেই ব্যবসা রেজাউলের হাতে এসে রূপ নেয় এক সংগ্রহশালায়, যেখানে কেবল ব্যবসার নয়, সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধেরও প্রকাশ ঘটেছে।

ঈদগাহ এলাকায় তিন কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় গড়ে তোলা এই জাদুঘরটি ২০২০ সালে যাত্রা শুরু করে। নাম দেওয়া হয়—এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম। এখানে রয়েছে ঢেম্পারেঙ, দোতারা, বরতাল, সারিন্দা, চিকারা, থিমিলা, শিঙ্গা, সারেঙ্গি, তানপুরা, এসরাজ, একতারা, মেকুঁড়সহ বহু লোকজ বাদ্যযন্ত্র।

জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে—২০০–৩০০ বছরের পুরনো ২০টি সারিন্দা, ৩০টি সরা,৬০টি মেকুঁড়,৮টি বিভিন্ন ধরনের সেতার
,প্রায় ৪০০টি এলপি রেকর্ড,৪০টি পুরোনো রেডিও,৮০টি গ্রামোফোন ও ক্যাসেট প্লেয়ার,নজরুলের কণ্ঠে গাওয়া গান সংরক্ষিত রেকর্ড।
লোকজ বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন সময়ের সংগীত বিষয়ক যন্ত্রপাতি, যা সংগীত গবেষণা ও শিক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহ্য রক্ষায় নিঃস্বার্থ সংগ্রহের বিষয়ে রেজাউল করিম বলেন,
“দাদার দোকানে বহু পুরোনো বাদ্যযন্ত্র থাকত, যা এখন আর তৈরি হয় না। মনে হলো, এই যন্ত্রগুলো হারিয়ে গেলে ইতিহাসই হারাবে। তাই নিজের সঞ্চয় থেকে ধীরে ধীরে সংগ্রহ শুরু করি। মানুষ দেখতে আসে, জানে, শোনে—এটাই আমার প্রাপ্তি।”
“আমার স্বপ্ন, এই মিউজিয়াম একদিন একটি জাতীয় সম্পদ হবে। এখানে গবেষণা হবে, শিল্পীরা শিখবে, পুরোনো দিনের সুরেরা ফিরে আসবে নতুন দিনের প্রাণে।”

জনপ্রিয় উপস্থাপক ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক পরিষদ সদস্য সারওয়ার জাহান বলেন,
“এই জাদুঘরে যে যন্ত্রগুলো আছে, নতুন প্রজন্ম সেগুলোর নামও জানে না। এখানে এসে তারা হারানো ঐতিহ্যকে চিনবে।”

নাট্যশিল্পী আসাদুজ্জামান রুবেল বলেন,
“একক চেষ্টায় এমন সংগ্রহ সত্যিই বিস্ময়কর। এই জাদুঘরকে রক্ষা করতে সরকারি সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।”
জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শিল্পী সংগঠকদের মতে,
‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’ কেবল একটি সংগ্রহশালা নয়—এটি এক মানুষের সংগ্রাম, এক পরিবারের ঐতিহ্য, এবং এক জেলার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের আলোকস্তম্ভ। এই মিউজিয়াম মনে করিয়ে দেয়, হারাতে হারাতে যাওয়া সংস্কৃতিও আবার জেগে উঠতে পারে—যদি এক মানুষের পাশে সবাই সাহস করে দাঁড়ায়, ঐতিহ্যকে ভালোবেসে।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন