
নিরাপত্তাহীনতার বাংলাদেশ: রাষ্ট্র কি শুধুই দর্শক
কে.এম. মোজাপ্ফার হুসাইন
শুধু খুন নয় এ এক উন্মত্ত নরকের উল্লাস!রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে, অসংখ্য মানুষের সামনে, একজন মানুষকে পিটিয়ে, কুপিয়ে, মাথা থেঁতলে হত্যা করা হলো। তারপর সেই রক্তাক্ত মৃতদেহের ওপর পাথর তুলে দাঁড়িয়ে ‘উল্লাস’ করল ঘাতক।
ঘটনাটি মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন রজনী ঘোষ লেনের। নিহত ব্যক্তি মো. সোহাগ একজন ভাঙারি ব্যবসায়ী, একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু অসাধারণ নৃশংসতায় খুন হলেন।
ঘটনার দুই দিন পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ। দৃশ্যটা সহ্য করার মতো না একজন মানুষ শুয়ে আছেন, নিথর, রক্তাক্ত; আর অপর ব্যক্তি পাথর দিয়ে তার মাথা থেঁতলে দিচ্ছে। পাশে অসংখ্য মানুষ, কিন্তু কেউ কিছু করছে না। কারণ? ঘাতক ব্যক্তি প্রভাবশালী, রাজনৈতিক পরিচয়ধারী।
এটি কেবল সোহাগ নামের একজন ব্যক্তির খুন নয়। এটি পুরো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে, বিচার ব্যবস্থাকে, প্রশাসনের দায়বদ্ধতাকে নগ্ন করে দিল।
অপরাধী যুবদলের নেতা এবং এই অপরাধের রাজনীতিক কাঠামো, ঘাতক হিসেবে যিনি অভিযুক্ত মাহমুদুল হাসান মহিন, তিনি যুবদলের চকবাজার থানার সাধারণ সম্পাদক পদের একজন প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে আগে থেকেই চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও হাসপাতাল দখলের অভিযোগ রয়েছে।
হত্যার পেছনের কারণ ভাঙারি ব্যবসায় সিন্ডিকেট, আধিপত্য বিস্তার, এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ। জানা যাচ্ছে, সোহাগ একসময় আওয়ামী রাজনীতির আশ্রয়ে ছিলেন; সরকার পতনের পর তিনি বিএনপির রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। এরপর শুরু হয় ভেতরের দ্বন্দ্ব। অথচ একদল সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছিল, ২০২৪ সালের জুলাই গণ–অভ্যুত্থান রাজনৈতিক সহিংসতা, দখলবাজি, অপরাজনীতি সবকিছুর অবসান ঘটাবে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা বলছে ক্ষমতা বদলেছে, কিন্তু চরিত্র বদলায়নি।
দৌলতপুরের রক্ত ও খতিবের কান্না: খুন এখন সর্বত্র :
একই দিনে খুলনার দৌলতপুরে সাবেক যুবদল নেতাকে গুলি করে, রগ কেটে হত্যা করা হলো। তিনি একসময় রামদা হাতে ভাইরাল হয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যাঁরা আগেও সহিংস ছিলেন, তাঁরা কেন সংগঠনের আশ্রয়ে ছিলেন? কেন তাঁদের শুদ্ধি হয়নি? এটাই কি নতুন রাজনীতির নমুনা?
অন্যদিকে চাঁদপুরে, নামাজ শেষে একজন ইমাম ও খতিবকে মসজিদের ভেতরে কুপিয়ে জখম করল এক ব্যক্তি, যার বক্তব্য ‘খতিব নবী (সা.)-কে অসম্মান করেছেন।’ অথচ কোনো বিচার, কোনো ধর্মীয় পর্যালোচনা, কোনো আলেমদের সিদ্ধান্ত নেই শুধু আত্মঘোষিত বিচারক আর চাপাতি।
যত্রতত্র মানুষকে ‘শাতিম’ আখ্যা দিয়ে হত্যা বা হামলার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তা আজ মসজিদেও থেমে নেই। ধর্মীয় অনুভূতিকে হাতিয়ার বানিয়ে যে উগ্রতা ছড়ানো হচ্ছে, তা আমাদের ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য, সহনশীলতা এবং মর্যাদাকেও বিপন্ন করছে।
রাষ্ট্র কি শুধুই বিবৃতি দেওয়া যন্ত্র?
এত ভয়াবহ ঘটনার পরও কোথাও যেন রাষ্ট্র নেই। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজিপি কেউ সরাসরি এগিয়ে আসছেন না। পুলিশ শুধু বলে, “তদন্ত চলছে” বা “গ্রেপ্তার হয়েছে”। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই অপরাধীরা কীভাবে এতটা সাহস পেল?
কার আশ্রয়ে এই ক্ষমতা পেল? কেন প্রশাসনের সংস্কার নেই? কেন পুলিশ সংস্কার নিয়ে আলোচনা পর্যন্ত নেই?
ক্ষমতার পালাবদলের এক বছরেও যদি রাষ্ট্র নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে এ রাষ্ট্র কাদের জন্য?
বিএনপি কি কেবল ‘বহিষ্কার’ করেই দায়িত্ব শেষ করবে?
যুবদলের ঘাতক কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এটি কি যথেষ্ট?
দলের ভেতরে যদি অপরাধী তৈরি হয়, তাহলে কেবল বহিষ্কার নয় নিজেদের রাজনৈতিক শিক্ষা, নেতৃত্বের শুদ্ধি, সাংগঠনিক কাঠামো নিয়েও প্রশ্ন তুলতে হবে। চট্টগ্রামের রাউজানে দলীয় কোন্দলে ১৫ জনের বেশি হত্যা হয়েছে। দলীয় বিরোধে রক্ত ঝরছে। দল থেকে কেউ যায়নি, কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। বহিষ্কার করে দায় ঝেড়ে ফেললে সাধারণ মানুষ কী করে বিশ্বাস করবে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ন্যায়ের প্রতীক হবে?
একটি প্রশ্ন এই জাতি কীভাবে বাঁচবে?
খুনের এমন বীভৎসতা, ধর্মীয় উগ্রতা, রাজনৈতিক অপরাধ সবকিছুর মধ্যে থেকেও আমরা প্রতিদিন বেঁচে আছি। কিন্তু এ বেঁচে থাকাটা কি মানুষ হিসেবে সম্মানজনক? নাকি কেবল সংখ্যার হিসাবে টিকে থাকা?
জুলাইয়ের গৌরবগাথা কী তাহলে আজকের নৈরাজ্যের জন্মদাত্রী? যে মানুষ রাজপথে নেমে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, সেই মানুষ কি আজ নীরব দর্শক হয়ে গেছে?
নাকি আমাদের হৃদয়ই পাথর হয়ে গেছে?
শেষ কথা: শুদ্ধি দরকার রাষ্ট্রের, শুদ্ধি দরকার রাজনীতির আমরা আজ এমন এক রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ প্রকাশ্যে
ধর্মের নামে বিচার হচ্ছে চাপাতি হাতে দলীয় কোন্দলে রক্ত ঝরছে আর সরকার কেবল হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কি এভাবেই চলবে?
না, আমরা এমন দেশ চাই না। আমরা এমন রাজনীতি চাই না।
আমরা নতুন বাংলাদেশ চাই যেখানে অপরাধী অপরাধী হিসেবেই বিচার পাবে রাজনীতি হবে জনসেবার মাধ্যম ধর্ম হবে নৈতিকতা আর মানবতার আশ্রয় আর রাষ্ট্র হবে সবার জন্য সমান।
এখন সময় জেগে ওঠার।রাজনীতি, প্রশাসন, নাগরিক সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।
কারণ, যদি আমরা আজ মুখ না খুলি, কাল হয়তো কেউ থাকবে না কান্নার জন্যও।
লেখক ও কলামিস্ট
মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন
আপনি ও পছন্দ করতে পারেন
সর্বশেষ
জনপ্রিয়
আর্কাইভ!
অনুগ্রহ করে একটি তারিখ নির্বাচন করুন!
দাখিল করুন