ডার্ক মোড
Sunday, 19 May 2024
ePaper   
Logo
সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার পথে বসলো

সৌদিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার পথে বসলো

বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধি

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে ওমরাহ পালন শেষে মদিনা থেকে মক্কায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মোজাম্মেল হোসেন মৃধা গত ২৩ বছর আগে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন সৌদি আরবে। সেখানে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন। আর সেখানে ভাগ্য পরিবর্তনে গত দের বছর আগে কাজে যোগ দিয়ে ছিলেন শ্যালক মো. সাগর জোমাদ্দার (৪৫)। কিন্তু তাদের সকল আশা ও স্বপ্নই অধরা রয়ে গেল।

বেতাগী ও মির্জাগঞ্জ দুই বাড়িতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে বাকরুদ্ধ তাদের দুই পরিবার। এক মাস চারদিন পর প্রিয় জনের লাশ ফিরে পেয়ে চোখের জলে বিদায় দিলেও মনে হয় এমন, চোখের পানি যেন শুকিয়ে গেছে তাদের।

বাড়িতে ছোট টিনের ঘরে বসবাস করেন নিহত সাগর জোমাদ্দারের পরিবার। সাত বছর প্রেমের পর দুই বছর আগে শান্তা আক্তারের সাথে বিয়ে হয় সাগর জোমাদ্দারের। বিয়ের পর মাত্র দুই মাস একসাথে সংসার করেন তারা। এরপর সৌদি প্রবাসী দুলাভাইয়ের রেস্টুরেন্টে কাজে যোগ দেন সাগর। বিলাপ বিলাপ করতে করতে শান্তা আক্তার জানান,‘ ভাগ্য বদলের জন্য স্বামী সৌদি গিয়ে অবশেষে দেশে ফিরলো লাশ হয়ে। আমাদের সব আশা আজ শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন কোথায় যাবো, কি করবো ?

চিৎকার করে কাঁদছিলেন মেঝ ভাই মো: সুমন জোমাদ্দার। এ সময় তিনি বলেন, ‘পরিবারের উপর্জণক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে আজ আমরা দিশেহারা ও চরম অসহায় হয়ে পড়েছি। সেখানে কয়েকমাস আগে দুলাভাই মোজাম্মেলের ব্যবসায় লোন ও ধারদেনা করে যে অর্থ বিনিয়োগ করে ছিলাম। কিন্ত এখন তা সব হারিয়ে নি:স্ব ও পথে বসে গেছি।’

মোজাম্মেল নিজের জমি বিক্রি ও এনজিও থেকে ঋণ তুলে সৌদিতে হোটেল ব্যবসা শুরু করে। দিনে দিনে ব্যবসার পরিধি আরও বৃদ্ধি করেন। এতে দীর্ঘদিন যাবত প্রবাসে থাকলেও শেষ করতে পারেন নি ঋণের বোঝা। একদিকে প্রবাসে পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষের মৃত্যু অপরদিকে মাথার উপর ঋণের বোঝা। এসব চিন্তায় অনেকটা নির্বাক এই দুটি পরিবারের মানুষগুলো।

মোজাম্মেলের স্ত্রী রুবিনা ইয়াসমিন জানান, মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই তাদের সবকিছু যেন শেষ হয়ে গেছে। তারা কিভাবে এই ঋণ মুক্ত হবে, পরিবারের অন্য সদস্য ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাবিয়ে তুলছে তাদের। এথন তাদের রোজেরই বাজার হয়না। মানবিক বিবেচনায় সৌদি সরকারের কাছে তিনি আর্থিক সহায়তার দাবি করেন।

মোজাম্মেলের ছোট মেয়ে রানিম জাহান অন্তু বলেন, ‘আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি ৮ বছর হয়, তখন আমার বাবা সৌদি যান। বাবাকে হারিয়ে এখন অনিশ্চয়তায় কাটছে আমাদের দিন। আপনারা পারেন তো আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।’

নিহতের মোজাম্মেলের ভায়রা ও সাগরের ছোট দুলাভাই মো. তারেক মুন্সি বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ আমাদের শুধু লাশ পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা পরিবারের দেনা পাওনা, ইন্স্যুরেন্সের টাকা ও দোকানের টাকা কিছুই দেইনি। এতে দুই পরিবারের লোকজনের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। এ বিষয় আমরা সৌদি সরকারের কাছে দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

তিনি আরও বলেন, এ মৃত্যু যেন নিয়তির লিখন। জন্মিলে মরিতে হয়। একথা ধ্রæব সত্য। তবে প্রতিটি মানুষের ইচ্ছা থাকে স্বাভাবিকভাবে যেন মৃত্যু হয়। কিন্তু মৃত্যু তো দিন তারিখ সময় দিয়ে হয় না। মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নিতে যেখানে কষ্টের অনুভূতিতে আঘাত লাগে, সেখানে অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর কত যে কষ্টের তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারেন না।

শনিবার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদে ইউনিয়নের বতটলা ও মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছৈলাবুনিয়া গ্রামে দুই জনকেই স্ব-স্ব পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে গত শুক্রবার রাত পৌনে ১২ টায় ঢাকা থেকে তাদের লাশ বাড়িতে পৌঁছার পর দুই বাড়িতে হাজারো মানুষের ঢল নামে। বাড়িতে দেখা যায়, এখনো হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা। কবর ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা। বিশেষ করে নিহত মোজাম্মেল মৃধার স্ত্রী, দুইমেয়ে এবং সাগর জোমাদ্দারের স্ত্রী,বাবা ও তিন ভাই ও বোনরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রæজলে সিক্ত করছেন।

সাগর জোম্মাদ্দারের মামা ও বেতাগী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো: মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, আমার ভাগ্নি জামাই মোজাম্মেল নিজের জমি বিক্রি করে ও এনজিও থেকে লোন নিয়ে সৌদিতে হোটেল ব্যবসা শুরু করে। পরে সাগর সেখানে গিয়ে কাজে যোগ দেয়। তাদের উপার্জনের উপরেই তাদের পরিবার নির্ভরশীল ছিল। তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কথনো পুষিয়ে ওঠার নয়। তবুও তারা যেন তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেতে পারে সেই বিষয়ে সরকারের সহযেগিতা কামনা করছি।

উল্লেখ্য, গত ২৫ মার্চ বাংলাদেশ সময় রাত ৮টার দিকে ওমরাহ হজ শেষে ফেরার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তারা সৌদি আরবের আলগাছিমের উনাইয়া নামক স্থানে ব্যবসা করতেন। ওমরাহ হজ পালনের জন্য মক্কায় যান। ওমরা হজ পালন শেষে শনিবার কর্মস্থলে ফেরার পথে তাদের বহন করা গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি পাথরের পাহাড়ারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। এতে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন