ডার্ক মোড
Saturday, 27 July 2024
ePaper   
Logo
সুষ্ঠু প্রজন্ম বিকাশে মাদক ও প্রযুক্তি আসক্তির প্রভাব

সুষ্ঠু প্রজন্ম বিকাশে মাদক ও প্রযুক্তি আসক্তির প্রভাব

ইফতেখার নাজিম

দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, মানুষ নিছক পরিস্থিতির পণ্য নয় বরং তার নিজের ভাগ্যের স্থপতি। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজের ভাগ্যের স্থপতি হবার যে মানস প্রেক্ষাপট, সেটি অবশ্যই কৈশোরের ধারণায় জন্মে।

জীবনের প্রাথমিক পর্যায় মানব সন্তানের জন্য অগ্নিপরীক্ষা, যেখানে নাগরিকত্ব ও নৈতিক সংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী ও অনুষেদগুলো বিস্তৃত রয়েছে। প্লোটো তাঁর ‘দ্যা রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্রজ্ঞা ও গুণের অধিকারী দার্শনিক-রাজাদের দ্বারা শাসিত ইউটোপিয়ান সমাজের কল্পনা করেছিলেন।

তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি ন্যায়সঙ্গত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে শিক্ষার ধারণা। তিনি স্বীকার করেছিলেন- চরিত্র ও বুদ্ধির চাষ শৈশব থেকেই শুরু হয়। এ সময়ে আত্মা জলের মতো ভেসে যায়, আবার জলের মতো শুকিয়ে যায়, শিশু কিশোরদের সাধারণ মঙ্গলের আলোকিত কার্যাধিক্ষে পরিণত করে।

প্লোটোর ধারণা থেকে শিশু কিশোর-কিশোরীদের সামগ্রিক বিকাশে বিনিয়োগের গভীরতা অনুধাবন করা যায়। এই বিনিয়োগ প্রচেষ্টা নিছক পরার্থপরতা নয় বরং জাতি গঠনে জন্য কৌশলগত বাধ্যতামূলক। তরুণ প্রজন্মের মঙ্গল মূলত সমাজরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও স্থিতিস্থাপকতার সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে রয়েছে, যা অনাগত প্রতিক‚ লতার মাঝেও জাতিকে শিকড় আঁকড়ে আত্মমর্যাদায় এগিয়ে যেতে কার্যকর নির্দেশনা দেবে।

একটি উপযোগীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোন জাতিরাষ্ট্রের জন্য শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের বিকাশের বিনিয়োগ লভ্যাংশ বহুগণ। সুস্থ, শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত যুব প্রজন্মের সাথে একটি জাতিরাষ্ট্রের সমৃদ্ধি নানানভাবে জড়িত।

সমসাময়িক বিশ্বের অগণিত চ্যালেঞ্জ ভালোভাবে মোকাবেলার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। কেননা, তারা উদ্ভাবনের স্থপতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রক্ষক ও সামাজিক অগ্রগতি-অগ্রগমনের অগ্রদূত। অধিকন্তু, প্রাথমিক শৈশব বিকাশে বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা দেয়, যা অর্থনৈতিক ছন্দ বজায় রেখে জাতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। এটি আন্তঃপ্রজন্মীয় সংক্রমণের একটি পূণ্য চক্রের জন্ম দেয়, যেখানে সমবেদনা, স্থিতিস্থাপকতা ও সততার মূল্যবোধগুলো এক দল থেকে অন্য দলে চলে যায়, যা সম্মিলিত মানবতার দায়বোধের চেতনায় আবৃত্ত থাকে।

সমাজ ও রাষ্ট্রবাস্তবতা, নাগরিকদের জীবনাচরণের গতি প্রকৃতি, প্রযুক্তি প্রয়োগের ধরন, উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ও ক্রমাগত প্রযুক্তিগত প্রভাবের এ যুগে এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের পথটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ ও জটিলতায় পরিপূর্ণ। কেননা, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও ভ‚-রাজনৈতিক উত্থান পতনে উদীয়মান তরুণ প্রজন্ম নানান কারণে বিকশিত হতে পারে না। বিকাশের সুযোগগুলো সুকৌশলে সংকুচিত করে রাখে কায়েমী স্বার্থান্বেষী শ্রেণী। এতে শিশু কিশোর-কিশোরীদের যথেষ্ট বিভ্রান্ত হবার সুযোগ রয়েছে। সমৃদ্ধ আগামীর জন্য এখানে জাতীয় আদর্শগত বিভাজনের সীমানা অতিক্রম করে সম্মিলিত পদক্ষেপের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নৈতিকতা অপরিহার্য।

গেল কয়েক দশকে প্রযুক্তির কল্যাণে উন্মুক্ত বিশ্ব জানালায় প্রবেশ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সমাজ বাস্তবতায় জাতীয় জীবনাচরণে যে বিরূপ পড়েছে, তা শিশু কিশোর-কিশোরী তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলেছে। সার্বিক প্রভাবে তরুণ প্রজন্মের মাঝে ‘বিত্ত থাকলে সবই সম্ভব’ এমন এক বিকৃত ধারণার জন্ম নিয়েছে। এই বিত্ত আহরণ কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজেকে জ্ঞান বিজ্ঞান, শিক্ষা দীক্ষায় সমৃদ্ধ করে তৈরি করতে হয়, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্ভাবনী ধারণা অর্জন করতে হয়, তা বর্তমান প্রজন্মের একটা অংশ মানতে নারাজ।

বহুধা বিভক্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের রাষ্ট্রসমাজ ব্যবস্থায় পরমত সহিষ্ণুতার অভাব, দুর্নীতির ব্যাপকতা, কালোটাকাওয়ালাদের বিকৃত মানসিকতার প্রভাব, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ এক্সেস, শিক্ষার অবাধ বাণিজ্যকরণ তরুণ প্রজন্মের মাঝে সহজলভ্য প্রাপ্তির আকাংখা ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মাদকের সহজ প্রাপ্তি ও এর বাণিজ্যিক মূল্য এবং মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে তরুণ প্রজন্ম অবারিত সম্ভাবনার দুয়ার অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে বিকৃত পথে পা বাড়ানোটা জাতির জন্য ক্রমেই শংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সামনে আদর্শের ধারণাটা ক্রমেই গৌণ হয়ে পড়ছে। ক্রমেই বাড়ছে শংকার গভীরতা। একটা দেশ-জাতিকে ধ্বংসের জন্য একটা প্রজন্মকে সুকৌশলে ধ্বংস করলেই চলে।

অনাদর্শিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নিজস্ব বিত্ত বলয় বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাশাপাশি বিত্তশালী গোষ্ঠির অপকৌশল বা তৎপরতা শিশু কিশোর-কিশোরীদের বিপথে নিয়ে যায়। এলাকায় রাজনৈতিক-অবৈধ ব্যবসায়িক আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, দখলবাজি বজায় রাখতে কিশোর তরুণদের ব্যবহারের বিষয়টি এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক বড় ভাই ও বিত্তশালীদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে তরুণ প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তারা সংঘবদ্ধভাবে অপ্রতিরোধ্য অপরাধ বিস্তার করছে। এদেরকে পেছন থেকে ক্ষমতাসীন স্থানীয় নেতাকর্মীরা মদদ দিচ্ছে। পিছিয়ে নেই ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও। নেপথ্য রয়েছে কালোটাকাওয়ালা ও প্রশাসনের দুষ্টচক্রের ইন্ধন।

এই বিপদগামী কিশোররা হিরোইজম প্রকাশ করতে পাড়া মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছে। আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদক, চাঁদাবাজি সহ নানান অপরাধে সম্ভাবনাময় কিশোররা খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। ইয়াবার ন্যায় মরণঘাতি মাদকসেবন, মাদক বাণিজ্যের সংস্থান দিতে গিয়ে প্রজন্মের একটা অংশ জুয়াখেলা ও সুদী কারবার করতে গিয়ে পুরো পরিবারকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

বাড়ছে পারিবারিক দ্ব›দ্ব সংঘাত। মাদকাসক্ত সন্তানের দ্বারা বাবা মা খুন হবার ঘটনা জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। অনাদর্শিক রাজনৈতিক দর্শন ও মানহীন শিক্ষায় ভর করে সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করে ক্ষমতার বৃত্তবলয়ের ব্যক্তিরা জাতিকে কী ম্যাসেজ দিতে চাচ্ছেন! সেটি ভাবার সময় এসেছে। কিশোর গ্যাং বর্তমানে নির্দিষ্ট এলাকাকেন্দ্রিক নয়, এর বিস্তার ঘটেছে দেশের আনাচে কানাচে। জাতির ভবিষ্যত রক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার স্বার্থে তরুণ প্রজন্মের এই বিপথগামীতা যে কোন মূল্যে থামাতে হবে। আদর্শিক রাজনৈতিক চর্চার বিস্তার, কালোটাকার প্রভাব হ্রাস ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা ছাড়া এই অধঃপতন রোধ সম্ভব নয়।

সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি প্রযুক্তি পণ্যের আসক্তির ভয়াবহতা শিশু কিশোর কিশোরীদের সুষ্ঠু বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। শিশু কিশোরদের মাঝে প্রযুক্তির অত্যাধিক ব্যবহার প্রবণতা কতটা ক্ষতিকর, তা সমাজ বাস্তবতা বলে দিচ্ছে। এক গবেষণা বলছে-যেসব টিনএজার অতিমাত্রায় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে হতাশা বেড়ে যায় অন্যদের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি।

যেসব শিশু কিশোর দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, তাদের জন্য বিষয়টি ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় বলা হয়েছে-সেখানকার টিনএজারদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। এর মূল কারণ হিসেবে স্মার্ট ফোনকেই বেশি দায়ী করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা মোবাইল ফোনকে তুলনা করেছেন টাইম বোমার সঙ্গে। তাদের ভাষায় মোবাইল ফোন হলো হেলথ টাইম বোমা বা স্বাস্থ্যনাশক সময় নিয়ন্ত্রিত বোমা।

যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের টিউমার ও ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে মোবাইল ফোনকে চিহ্নিত করেছেন। এই ফোনের কারণে মানুষের রক্তচাপ বেড়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আসক্তি মানব মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বিজ্ঞানীরা এর অধিক ব্যবহার মস্তিষ্কের ভেতর গ্রে-ম্যাটারের ঘনত্ব বেড়ে যায় মর্মে মত দিয়েছেন। যা মস্তিষ্কের আকার পরিবর্তন করে এবং অপ্রয়োজনীয় চিন্তা দর্শন প্রয়োজনীয় স্মৃতিশক্তিকে হ্রাস করে। তথ্যপ্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহারের নামে দেশে যেভাবে শিশু কিশোর-কিশোরীদের অবাধ ইন্টারনেট এক্সেস, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার, মোবাইল ফোন ব্যবহারের অবাধ সুযোগ দেয়া হয়েছে, সেটির বৈজ্ঞানিক ক্ষতির প্রভাব ইতোমধ্যে দেশের তরুণ প্রজন্মের মাঝে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা ও তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা সেটি নির্দেশ করে।

শিশু কিশোর কিশোরী জাতির ভবিষ্যত। তাদের সুষ্ঠু প্রতিভা বিকাশের ওপর নির্ভর করে আগামীর বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ও স্থিতি। একটি বীজ যতেœর সাথে লালন পালনের মধ্য দিয়ে এক সময়ে সুউচ্চ বৃক্ষে পরিণত হয়, তেমনি শিশু কিশোর কিশোরীদের যুগোপযোগী শিক্ষা দীক্ষা, মানবিক দৃষ্টান্ত, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদি গুণে বিকশিত করা গেলে অনাগত ভবিষ্যতে জাতীয়তাবোধের গভীরতা সুদৃঢ় হবে। মনে রাখতে হবে-প্রজন্মের হাত ধরে প্রজন্ম এগিয়ে যায়।

তরুণদের নাগরিক চিন্তার গভীরতা ও মঙ্গল চেতনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করবে সমাজরাষ্ট্রের জীবনীশক্তি ও স্থায়িত্ব।

তরুণ প্রজন্মের বিকাশের জন্য একটি ন্যায়ভিত্তিক, সমতা ও মানবিক মর্যাদা সমাজরাষ্ট্র নির্মাণে অবশ্যই অঙ্গীকার থাকতে হবে। ভবিষ্যতের উর্বর বীজে প্রতিশ্রæতির বীজ বোপনের কাজটি সমন্বিতভাবে করতে হবে।

কিশোরগ্যাং কেন্দ্রিক মাদকসেবন ও বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব, খুন খারাবি, আধিপত্য বিস্তার প্রকৃতঅর্থে জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না, সেই দৃষ্টান্ত তরুণ প্রজন্মের সামনে সমাজরাষ্ট্রের ক্ষমতার বৃত্তবলয়ে থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন, ব্যবসায়ী, সমাজপতি, শিল্পকারখানার মালিকদের রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে আঁধার যখন ভালোবাসবে-জীবন গহীন অরণ্য, জীবন তখন ব্যর্থ হবে-জীবন সমুদ্রের জন্য। বিষয়টি সকলে অনুধাবনে নিলেই জাতির মঙ্গল।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন