
সিভিল এভিয়েশনের হাত ধরে দক্ষিণ এশিয়ার এভিয়েশন হাবে বাংলাদেশ
নিজ্বস প্রতিনিধি
তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কার্গো সেবা ও ডমেস্টিক উন্নয়নে এগিয়ে চলেছে দেশের বিমান চলাচল খাত।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে সেবার মান এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত, পরিচ্ছন্ন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসম্মত। যাত্রীরা আগের তুলনায় ল্যাগেজ হ্যান্ডলিং, যাত্রীসেবা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুস্পষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। ফলে অনেকেই বলছেন, দেশের বিমান চলাচল খাতে বর্তমানে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটছে।
যাত্রীরা জানিয়েছেন, আগে যেখানে বিমানবন্দরে নানা অসুবিধা পোহাতে হতো, এখন সেখানে রয়েছে সুশৃঙ্খল ও গতিশীল সেবা। লাগেজ সংগ্রহ, বোর্ডিং, নিরাপত্তা তল্লাশি থেকে শুরু করে ভ্রমণ-সংক্রান্ত তথ্যপ্রাপ্তি—সব ক্ষেত্রেই এসেছে পরিবর্তন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল যাত্রীবান্ধব পরিবেশই তৈরি করছে না, বরং দেশের এভিয়েশন খাতের প্রতি বিদেশি এয়ারলাইন্স ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বাড়িয়ে তুলছে।
বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতে সবচেয়ে বড় প্রত্যাশার নাম এখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহুল প্রতীক্ষিত তৃতীয় টার্মিনাল। ইতোমধ্যেই নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং যেকোনো সময় যাত্রার জন্য এটি খুলে দেওয়া হবে। বিশেষজ্ঞরা একে বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতে যুগান্তকারী এক অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখছেন।
নতুন টার্মিনালে অত্যাধুনিক সব সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে। এখানে রয়েছে ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার, ৬৬টি ডিপার্চার ইমিগ্রেশন ডেস্ক, ৫৯টি এরাইভাল ইমিগ্রেশন ডেস্ক এবং ৩টি ভিআইপি ইমিগ্রেশন ডেস্ক। এর বাইরে যাত্রীসেবা সহজতর ও দ্রুততর করতে স্বয়ংক্রিয় নানা ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে। ফলে যাত্রীরা অল্প সময়ে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে পারবেন, যা আগে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করত।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ায় এখন যাত্রী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মাঝে স্বস্তি ও আশাবাদ বিরাজ করছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন টার্মিনাল চালু হলে বিমানবন্দরের বার্ষিক যাত্রী ধারণক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। এতে কেবল দেশের বিদ্যমান যাত্রীচাপ সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না, বরং নতুন নতুন আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সও ফ্লাইট পরিচালনার সুযোগ পাবে। এর ফলে বাংলাদেশের আকাশপথে যাত্রী ও কার্গো পরিবহন আরও বৃদ্ধি পাবে।
যাত্রীরা আশা করছেন, তৃতীয় টার্মিনাল চালুর মধ্য দিয়ে দেশের এভিয়েশন শিল্প এক নতুন রূপ পাবে। ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হবে আরও উন্নত ও বিশ্বমানসম্পন্ন। ব্যবসায়ী মহল মনে করছে, এটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, বাণিজ্য ও পর্যটনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
শুধু রাজধানী নয়, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও এখন এভিয়েশন খাতের নতুন স্বপ্ন দেখছে। আগামী অক্টোবর মাস থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এখানে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রানওয়ে—১০,৭০০ ফুট, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ারও অন্যতম দীর্ঘতম রানওয়ে হিসেবে বিবেচিত হবে। এর ফলে বৃহদায়তন বোয়িং-৭৭৭, ড্রিমলাইনারসহ আধুনিক ও বড় আকারের উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারবে, যা দেশের বিমান চলাচল খাতে এক বিশাল অগ্রগতি।
এটি হবে বাংলাদেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ উদ্যোগ শুধু নতুন একটি এয়ারপোর্টের সংযোজন নয়, বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পের জন্য একটি মাইলফলক। কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকতের জন্য পরিচিত। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট না থাকায় বিদেশি পর্যটকরা সহজে এখানে আসতে পারতেন না। এখন সেই সীমাবদ্ধতা দূর হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি ইউরোপ থেকেও সরাসরি কক্সবাজারে পর্যটক আসতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরাসরি আন্তর্জাতিক সংযোগ চালু হলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়বে। এর ফলে শুধু পর্যটন খাত নয়, হোটেল-মোটেল ব্যবসা, রেস্তোরাঁ, স্থানীয় পরিবহন, হস্তশিল্প ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন বাজার তৈরি হবে। অর্থাৎ, পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবাহে নতুন গতি সঞ্চারিত হবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পর্যটন সংশ্লিষ্টরা এই প্রকল্পকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, এটি বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার কেবল বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এমনকি সরকার চাইলে কক্সবাজারকে ভবিষ্যতে আঞ্চলিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, যেখানে শুধু পর্যটক নয়, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক ফ্লাইটও পরিচালিত হবে।
সবমিলিয়ে, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শুধু একটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও পর্যটনশিল্পের বিকাশে এক গেম-চেঞ্জার পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, সম্প্রতি সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক কার্গো ফ্লাইট চালু হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী সমাজ এই সেবার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের মতে, এর ফলে দেশের রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। বিশেষ করে পচনশীল কৃষিপণ্য, মাছ ও ফুলের মতো সময়সাপেক্ষ পণ্য এখন দ্রুত আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এতে কেবল পরিবহন খরচ কমছে না, পণ্যের মানও অক্ষুণ্ণ থাকছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ উদ্যোগের ফলে তাদের রপ্তানি কার্যক্রম আরও সহজ, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে বলে তারা আশাবাদী।
এছাড়া দেশের অন্যান্য ডমেস্টিক বিমানবন্দরগুলোতেও একের পর এক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। রানওয়ে সম্প্রসারণ, যাত্রীসেবা বাড়ানো, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, আধুনিক ন্যাভিগেশন ব্যবস্থা সংযোজন—এসব উদ্যোগ বিমান চলাচল ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আঞ্চলিক পর্যায়ে এই ধরনের ধারাবাহিক উন্নয়ন বাংলাদেশকে একটি এভিয়েশন কানেক্টিভিটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
ফলে যাত্রীসেবার মান যেমন উন্নত হচ্ছে, তেমনি পণ্য পরিবহন ও আন্তর্জাতিক সংযোগও বাড়ছে। পর্যটন খাত, রপ্তানি বাজার, ব্যবসায়ী সমাজ ও সাধারণ যাত্রী—সবার কাছেই এই পরিবর্তন ইতিবাচক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
সবমিলিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের বিমান চলাচল খাত এখন এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংযোগ বৃদ্ধি, পর্যটন ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন—সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনা ও ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ অচিরেই দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ এভিয়েশন হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।