ডার্ক মোড
Monday, 13 May 2024
ePaper   
Logo
ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে স্বপ্ন বুনে কক্সবাজার উপকূলবাসী

ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে স্বপ্ন বুনে কক্সবাজার উপকূলবাসী

স.ম ইকবাল বাহার চৌধুরী, কক্সবাজার

সোমবার ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের উপকূল দিয়ে ২১০ কিঃমিঃ বেগে বয়ে যায় ঘূর্নীঝড় হ্যারিকেন। সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূলীয় অঞ্চল। লক্ষাধিক মানুষের প্রানহানী সহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়।

এ সময় উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারের ২২ টি ফোল্ডারে ৫৯৬ কিঃমিঃ বেড়ীবাঁধের প্রায় সবগুলো বিলিন হয়ে যায়। বিষেশ করে কক্সবাজার জেলার শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালীর মাতারবাড়ী-ধলঘাট, কুতুবদিয়া দ্বীপের ৭০ কিঃমিঃ বেড়ীবাঁধ প্রায় বিলিন হয়ে এ দ্বীপ গুলোর প্রায় ৮ লাখ মানুষ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ৩৪ বছর ধরে উন্নয়নের কথার ফুলঝুরি ছুটলেও কাঙ্খিত টেকসই বেড়িবাঁধ এখনো স্বপ্নই রয়ে গেল।

প্রতিবছর সাগরের জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি আর গ্রামের পর গ্রাম সাগর বুকে বিলিন হলেও টনক নড়েনি সরকার প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু এই বেড়ীবাঁধকে ইস্যু করেই জরুরী মেরামতের নামে প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে প্রশাসনের কর্তাবাবুরা। অথচ সরকারের বেশীর ভাগ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে এই উপকূলকে ঘিরেই। কক্সবাজার জেলাবাসী সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এখনো স্বপ্ন বুনে টেকসই বেড়িবাঁধের।

উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার এর দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরখ্যাত মহেশখালীর মাতারবাড়ী। নামে সিঙ্গাপুর হলেও বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। দীর্ঘদিনের অরক্ষিত পশ্চিমের বেড়িবাঁধ ও প্রধান সড়কের নাজুক অবস্থা থেকে মুক্তি মিলছেনা স্থানীয়দের। দীর্ঘ প্রায় ৩ যুগেও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত না হওয়ায় লন্ডভন্ড বেড়িবাঁধ' স্বপ্ন ভঙ্গ মাতারবাড়ীবাসীর'।

দীর্ঘসময় অরক্ষিত ধলঘাট মাতারবাড়ীর বেড়িবাঁধ, প্রায়সময় বর্ষামৌসুমের শুরুতে জরুরি মেরামতের নামে লুটপাট হওয়ার 'অভিযোগ সচেতন মহলের। ঘুর্ণীঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ, অতঃপর আবার শুরু হয় নামমাত্র মেরামত। শতাধিক ঘরবাড়িসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় তখন। তবুও মিলেনি প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা। ইতিপূর্বে কয়েকবার জরুরি মেরামতের নামে কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি' এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

এছাড়াও প্রতিবারই নির্মাণ/ জরুরি মেরামতে ব্যাপক অনিয়মের কারণে বর্ষা মৌসুমে যানমালের ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ পাওয়া যায়। তবুও কর্তৃপক্ষ মানসম্মত কাজে গুরুত্ব না দেওয়ায় ধ্বস নামে বেড়িবাঁধে। অনেক সময় বেড়িবাঁধ এর কাছ থেকে জিও ব্যাগের জন্য বালি নেওয়ার ফলে নির্মাণ কাজ শেষ না হতেই শুরু হয় ভাঙ্গনের।

কয়েকবছর থেকে সুপার ডাইক বেড়িবাঁধ নির্মাণের কথা বললেও এখনও ফাইল বন্দি সুপার ডাইক এর স্বপ্ন। একে তো সুপার ডাইক হচ্ছে না তার ওপর লন্ডভন্ড বেড়িবাঁধের জরুরি মেরামত পাউবো'র গাফেলতির কারণে কাঙ্খিত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বার বার। তাই বর্ষা মৌসুম নিয়ে আতংকে স্থানীয়রা। বর্তমানে বেড়িবাঁধের যে অবস্থা তাতেই বর্ষার শুরুতেই প্লাবিত হবে এমনটা জানান ভোক্তভুগী মানুষগুলো। এ অবস্থায়ও নীরবে জনপ্রতিনিধি-কর্তৃপক্ষ। ফলে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেওয়া অসহায় পরিবারে আশ্রয়হীন হওয়ার আতংক দেখা দিয়েছে।

এছাড়াও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে। অনেকেই জানান- জনদুর্ভোগ নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের মাথাব্যাথা নেই, যে যার মতো নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। ফলে দ্বিতীয় সিঙ্গাপুরের স্বপ্ন যেন কাগজে কলমে। স্থানীয়র সচেতন মহল জানান, ইতিপূর্বে বেড়িবাঁধ নির্মাণের সময়ে আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছি।

কিন্তু কোন ব্যবস্থা হয়নি, উল্টো উচ্ছেদ ও মামলার ভয় দেখানো হয়েছে। নকশা অনুয়ায়ী কাজ না করে বেড়িবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় মাটি কম দেওয়া থেকে শুরু করে বসতভিটা থেকে মাটি নেওয়ার কারণে বর্ষাকালে পানি জমে থাকায় পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর আশংকা রয়েছে। প্রায়সময় ঠিকাদার দায়সারাভাবে কাজ করে যাওয়ায় অপচয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকার । ক্রমেই বাড়ছে গৃহহীন মানুষের সংখা। নকশা অনুযায়ী মানসম্মত কাজ না হওয়ায় অল্পতেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে বেড়িবাঁধ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, ইতিপূর্বে ক্ষতিগ্রস্ত ৮০০ মিটারের বেড়িবাঁধ নির্মাণেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছিল। একাধিক ঠিকাদারের কাজে ভিন্নতা লক্ষণীয়, কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। বেড়িবাঁধে নির্মাণ জিওব্যাগের নিছে জিও টেক্সটাইল না দেওয়ায় বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেওয়ে ব্যাপক মাটি ক্ষয় হয়ে ধ্বস নেমে ছিলো জিওব্যাগে।

দেখলে বুঝা যায়, কি রকম অনিয়ম হয়েছে! শর্ত অনুয়ায়ী, প্রস্থ ১০ মিটার হওয়ার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় ৭/৮ মিটার। এছাড়াও ওই সময়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণে উচ্চতায় কম হয়ে ছিলো বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে আসন্ন বর্ষামৌসুমে যেকোন মুহূর্তে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে গ্রামের পর গ্রাম। জানা যায় , বেড়িবাঁধের ভাঙনে বিগত কয়েক বছরে শতাধিক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। নিঃস্ব হয়ে বাধ্য হয়েছেন অন্যত্র চলে যেতে। কেউ কেউ মাথা গোঁজানোর ঠাঁই নিয়েছেন শহরের কলোনিতে, মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, ধলঘাটা- মাতারবাড়ীতে ১৭ কিলোমিটার সুপার ডাইক বেড়িবাঁধের জন্য আগামী সাপ্তাহের মধ্যে সংশোধিত চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। তবে এ মুহুর্তে জরুরী মেরামতের জন্য কোন বরাদ্দ নাই বলেও জানান তিনি।

এ অবস্থায় বর্ষামৌসুমে কি হবে মাতারবাড়ী ধলঘাটার মানুষের? নাকি প্রতিবারের মতো বর্ষামৌসুমে ভাঙ্গন শুরু হলে লুটপাটের মেরামত কাজ হবে? এমন প্রশ্ন সচেতন মহলে। সরজমিনে স্থানীয়রা জানান -ইতিপূর্বে মানসম্মত বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ না হওয়ায় কোটি কোটি টাকার কাজও ভেস্তে গেছে । এভাবে মেরামতের নামে নয়ছয় না করে মানসম্মত বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি বঞ্চিত মাতারবাড়ীবাসীর।

এ বিষয়ে কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) সংসদীয় আসনের এমপি আলহাজ্ব আশেক উল্লাহ রফিক ডেইলি কান্ট্রি টুডে 'কে জানান, সুপার ডাইক বেড়িবাঁধ অত্যন্ত ব্যয় বহুল। কুতুবদিয়া মহেশখালীর ৭০ ও ৭১ নং ফোল্ডারের ১৭ কিঃমিঃ বেড়ীবাঁধে জরিপ কাজ শেষ হয়েছে। পিডি তৈরী করা হচ্ছে। আশা করি আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে ৭০ ও ৭১ নং ফোল্ডারের ১৭ কিঃমিঃ সুপার ডাইক বেড়িবাঁধ নির্মাণ শেষ হবে। তাহলে মহেশখালী কুতুবদিয়ার মানুষ স্থায়ী ভাবে জলোচ্ছ্বাস থেকে মুক্তি পাবে। তিনি ১৯৯১ এর ২৯ এপ্রিলের ঘূর্নিঝড়ে নিহতদের আত্মারমাগফেরাত কামনা করেন।

মন্তব্য / থেকে প্রত্যুত্তর দিন