
ফলাফল বিপর্যয় নয়, মেধার সঠিক মূল্যায়ন
লায়ন মো.শামীম সিকদার
সুষ্ঠু, সুন্দর ও নকলমুক্ত পরিবেশে চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা আয়োজন এবং খাতা মূল্যায়নে ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করায় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা যাচাই হয়েছে। ফলে বিগত বছর গুলোর তুলনায় এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাশের হার কমলেও শিক্ষার গুনগতমান বজায় থাকবে। পরীক্ষা পদ্ধতির এ ধারা অব্যহত থাকলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আরো মনোযোগী হবে এবং লেখা পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে। থাকবে না পরীক্ষা হলের অবৈধ সুযোগ সুবিধা। যার যেমন মেধা সে তেমনি ফলাফল অর্জন করতে পারবে। যদিও অনেকে ফলাফল নিয়ে কিছুটা হতাশ হয়েছেন তবে এটি সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে সাহায্য করবে। এই পদক্ষেপটি শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়নে জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পাবে তাই সামগ্রিকভাবে বলা যায় যে এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল মেধার সঠিক মূল্যায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমান সরকারের নির্দেশনায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কঠোর অবস্থানের কারণে সুন্দর সুষ্ঠ ও নকরমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা আয়োজন সম্ভব হয়েছে। এ জন্য মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
১০ জুলাই এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। দেশের ১০টি শিক্ষা বোর্ডে এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় নিয়মিত-অনিয়মিত মিলিয়ে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৯ লাখ ২৮ হাজার ৯৭০ জন। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ৯ লাখ ৫১ হাজার ৬৯৭ জন এবং ছাত্রী ৯ লাখ ৫২ হাজার ৩৮৯ জন। এদের মধ্যে উত্তীর্ণ ৬ লাখ ২৬ হাজার ৯৮১ জন ছাত্র এবং ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪৫ জন ছাত্রী। এ বছর সকল বোর্ডের গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। যা গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৩২ জন। গত বছর পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আর জিপিএ-৫ পেয়েছিল এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার কমেছে ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ বছর পাসের হারে শীর্ষে আছে রাজশাহী বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ ও সর্বনিম্ন বরিশাল বোর্ড। এই বোর্ডে পাসের হার ৫৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। পাসের হার ৭৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৭৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭২ দশমিক ০৭ শতাংশ, মাদরাসায় ৬৮ দশমিক ০৯ শতাংশ, সিলেটে ৬৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ঢাকা বোর্ডে ৬৭ দশমিক ৫১ শতাংশ, দিনাজপুরে ৬৭ দশমিক ০৩ শতাংশ, কুমিল্লায় ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ৫৮ দশমিক ২২ শতাংশ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর চেয়ে এবার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি ছিল। অন্যান্য বছর উত্তরপত্র মূল্যায়নে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হতো। তারপর পাসের হার বাড়াতে দেয়া হতো কমন গ্রেজ নম্বর। উত্তরপত্র মূল্যায়নে বোর্ড গুলোর পক্ষ থেকে পরীক্ষক, নিরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকদের দেয়া হতো বিশেষ নির্দেশনা। কিন্তু এ বছর এসবের কোন কিছুই হয়নি। উত্তরপত্র মূল্যায়নে হয়েছে সঠিক নিয়মে। তার মানে পরীক্ষার্থী যতকুটু লিখেছে তাকে সেভাবেই নম্বর দেয়া হয়েছে। বোর্ডের পক্ষ থেকেও কোন প্রকার বিশেষ নির্ধেশনা দেয়া হয়নি। উত্তরপত্র মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ির’ বিষয়ে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের কোনো টার্গেট ছিল না যে পাসের হার এত করব, বাড়াব, নাকি কমাব। আমাদের মিশন ছিল পরীক্ষা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষকেরা যখন উত্তরপত্র নিতে বোর্ডে আসেন, তখন ওনাদেরও প্রশ্ন ছিল কোনো নির্দেশনা আছে কি না। আমরা বলেছি, আমাদের বিশেষ কোনো নির্দেশনা নেই। উত্তরপত্র মূল্যায়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়ে আমাদের কাছে যে ফলাফল এসেছে তাই প্রকাশ করা হয়েছে।’
বর্তমান সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কঠোর নজরধারীর কারনে পরীক্ষায় অসৎ উপায় অবলম্বন করতে না পারায় সুষ্ঠু ও সুন্দর নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে পরীক্ষার্থীদের মেধার সঠিক যাচাই হয়েছে। এবারের ফলাফলে অসৎ উপায় অর্জিত নম্বর যোগ হয়নি। জিপি বা জিপিএ যা অর্জিত হয়েছে তা পুরোটাই নিজের মেধার দ্বারা আসছে। এ প্রসংগে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জিএম শহীদুল ইসলাম ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সরকারের নির্দেশনায় শিক্ষার গুণগত মান নির্ণয় করার জন্য কঠোরভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। যার কারণে কোনো অসদুপায় অবলম্বন করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য পরীক্ষার খাতা দেখতে শিক্ষকরা বেশ আন্তরিক ছিলেন। আগের মত ছাড় দেননি। এতে ফলাফল একটু খারাপ হয়েছে।
এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী এবার অকৃতকার্য হয়েছে—এটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। এখন বড় দুশ্চিন্তার জায়গা হলো এই শিক্ষার্থীরা আবার মাধ্যমিক শিক্ষা থেকেই ঝরে পড়বে কিনা? তারা কি তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাবে নাকি অদক্ষ বেকার হিসেবে সমাজে যুক্ত হবে? এ বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে ভাবতে হবে। এই শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কোনো শিক্ষার্থী যেন শিক্ষা থেকে ঝরে না পড়ে। তাদের প্রতি শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদেরকে লেখাপড়ায় সংযুক্ত রাখতে হবে। হয়তো এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। তাদের ধারনা তারা আর পরীক্ষায় ভাল করতে পারবে না। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচিত অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা করে পৃথক পাঠদানের ব্যবস্থা করা। কাউন্সেলিং এবং সহানুভূতিশীল দিকনির্দেশনা অত্যন্ত জরুরি। কাউন্সিলিনের মাধ্যমে তাদের হতাশা কাটানো যেতে পারে। অভিভাবক ও শিক্ষকদেরও উচিত হবে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে না দিয়ে উল্টো উৎসাহ দেওয়া। হতাশার বদলে আশাবাদ তৈরি করা। মনে রাখতে হবে, একটি পরীক্ষায় ব্যর্থতা মানেই জীবনের ব্যর্থতা নয়।
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। যেখানে নম্বর নয়, প্রাধান্য পেয়েছে মেধা ও নৈতিকতা। এই ফলাফল কোনোভাবেই "ফলাফল বিপর্যয়" নয়; বরং এটি বাংলাদেশের শিক্ষা কাঠামোতে গুণগত মান প্রতিষ্ঠার এক সাহসী প্রচেষ্টা। আমরা বহুদিন ধরে এমন একটি মূল্যায়ন চেয়ে এসেছি। যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী তার প্রকৃত জ্ঞান ও মেধার ভিত্তিতে মূল্যায়িত হবে। এবার সেই প্রত্যাশার বাস্তব রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি। ফলাফলের পরিসংখ্যান দেখে হয়তো অনেকে হতাশ হয়েছেন, কারণ বিগত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এই হ্রাস মানে যে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়েছে, তা নয়। বরং এই ‘কম’ সংখ্যাগুলোই বলে দিচ্ছে, এবার আর কোনো বাড়তি নম্বর, সহানুভূতির নম্বর কিংবা রাজনৈতিক চাপ নেই। যা অর্জিত হয়েছে, তা একান্তই নিজের পরিশ্রম আর প্রকৃত মেধার ফসল। এখন মূল দায়িত্ব আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক, নীতিনির্ধারক ও সমাজের সকল স্তরের মানুষদের-যারা অকৃতকার্য হয়েছে, তাদেরকে অবহেলার চোখে নয়, বরং সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তাদের হতাশা দূর করে, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। এই শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা সহায়ক পাঠ, কাউন্সেলিং ও শিক্ষামূলক প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে তারা পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারে। শিক্ষা কখনোই শুধু পরীক্ষার নম্বরে সীমাবদ্ধ নয়, এটি জীবন গঠনের হাতিয়ার। তাই একটি পরীক্ষায় কম ফলাফল পাওয়া মানেই ব্যর্থতা নয়। বরং এটি হতে পারে আত্মসমালোচনার সুযোগ, উন্নতির সিঁড়ি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আজ যারা অকৃতকার্য, ঠিক তারাই সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দিতে পারে।
এবারকার ফলাফল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি সুস্থ সংস্কৃতির সূচনা করেছে। যেখানে মেধা ও সততার জয় হয়েছে। যদি এই ধারা বজায় থাকে, তাহলে অচিরেই আমরা পাব একটি জ্ঞানভিত্তিক, ন্যায়ভিত্তিক ও যোগ্যতা-ভিত্তিক বাংলাদেশ। যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিজ মেধা ও মননে গড়ে উঠবে, এবং গড়বে একটি সমৃদ্ধ আগামীর জাতি।
লায়ন মো. শামীম সিকদার
কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক