
নড়াইলে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির ভাটা: পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব
নড়াইলে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির ভাটা: পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব
উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি, নড়াইল
নড়াইলে অনুমোদনহীন কয়লা ভাটার কারণে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে ভয়াবহ প্রভাব। সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছে একের পর এক কয়লার ভাটা। প্রতিদিন এসব ভাটায় পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার মণ কাঠ, উগরে দিচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া—যা বসবাসযোগ্য পরিবেশকে করে তুলছে বিপজ্জনক।
স্থানীয়রা জানান, এসব ভাটায় পুড়ছে বনজ ও ফলজ গাছ। গোলাকৃতি ইট ও মাটির তৈরি চুল্লিতে সারি করে সাজানো কাঠে আগুন লাগিয়ে সপ্তাহব্যাপী পোড়ানো হয়। উৎপাদিত কয়লা সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
একটি ভাটায় প্রতি সপ্তাহে ৩৫০ মণ কাঠ পুড়িয়ে উৎপাদন করা হয় প্রায় ৪.৫ টন কয়লা। জেলায় এ রকম প্রায় ২৫টি ভাটা সক্রিয় রয়েছে। মাসে এসব ভাটায় পুড়ছে প্রায় ৩৫ হাজার মণ কাঠ, উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৫০০ টন কয়লা। ফলে একদিকে বন নিধন, অন্যদিকে বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিজমি, বাড়ছে শ্বাসকষ্ট ও শিশুদের নিউমোনিয়ার মতো রোগ।
গোয়ালবাথান গ্রামের বাসিন্দা ফরিদা ইয়াসমীন লাকী বলেন, “এই ভাটার ধোঁয়ার গন্ধে আমি কোনো খাবার খেতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে, গলা টেনে টেনে বমি আসে।”নাওরা গ্রামের আবে খাতুন জানান, “আমার দুই ছেলে ও নাতি এই ভাটায় কাজ করে সংসার চালায়। কিন্তু ধোঁয়ায় আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।”বাধাল গ্রামের জামিরোন, ইয়াসমীনসহ আরও অনেকে বলেন, “ছোট-বড় সবাই শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ধানের জমিতে আগের মতো ফসল হয় না।”চন্ডিবরপুরের গোয়ালবাথানে ইউনুস মীরার জমিতে রুমন মীরা স্থাপন করেছেন পাঁচ চুল্লিযুক্ত একটি ভাটা। নাওরা সীমান্তে নাখন মীরা ও বাধাল গ্রামে শিবু খন্দকার পরিচালনা করছেন আরও দুটি ভাটা। কিছু চুল্লি আগে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেঙে দেওয়া হলেও পরে সেগুলো আবার চালু করা হয়েছে।স্থানীয়দের অভিযোগ, ভাটা মালিকরা প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই পুনরায় ভাটা চালু করছেন। একাধিকবার ভাঙচুর করেও কার্যকরভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না এসব কারখানা।
নড়াইলের সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুর রশিদ বলেন, “বায়ু দূষণের ফলে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ মানুষ শ্বাসজনিত সমস্যায় ভোগে। শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া বেড়ে গেছে। ধোঁয়া শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলে।”
পরিবেশ অধিদফতরের নড়াইলের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মালেক মিয়া জানান, “এগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ। আমাদের লোকবল, বাজেট ও প্রশাসনিক সহযোগিতার অভাবে নিয়মিত মনিটরিং সম্ভব হয় না। একবার ভাঙলেও তারা আবার স্থাপন করে।”
তিনি বলেন, “এই চক্রকে প্রতিহত করতে পরিবেশ অধিদফতরকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।”
অবৈধ কয়লা ভাটাগুলো এখন শুধু বন ও কৃষিজমির ক্ষতিই করছে না, জনস্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।