
নিবন্ধন অধিদপ্তরে বদলি বাণিজ্য, একই পদে দুজনকে বদলি, বদলির পরের দিনই তদবিরে স্থগিত
এ.বি. রাজ্জাক
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে ঘুষের এক লাখ টাকাসহ হাতেনাতে ধরা পড়ার পর কুষ্টিয়া সদরের সাব-রেজিস্টার সুব্রত কুমার সিংহকে আদালত কারাগারে পাঠালে ২০২০ সালে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল আইন মন্ত্রণালয়। এক মাস কারাগারে থেকে জামিন পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে চাকরি রক্ষা করেন তিনি।
পরে স্বাক্ষর জালিয়াতি ও ভুয়া দলিলের মাধ্যমে দুই বোনের অন্তত ১০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি জবরদখলের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কুষ্টিয়ার এই সাবেক সাব রেজিস্ট্রার সুব্রতকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠিয়েছিলো আদালত। কিন্তুু দূর্নীতির দায়ে কারাগারে গেলেও নিয়ম অনুযায়ী তাকে বরখাস্ত না করে উল্টো ২৮ এপ্রিল দিনজাপুর থেকে প্রাইজ পোষ্টিং হিসেবে রংপুর সদরে বদলী করা হয়। অভিযোগ রয়েছে বরখাস্ত আদেশ এর পরিবর্তে এই প্রাইজপোষ্টিং এর জন্য মোটা অংকের অর্থ খরচ করতে হয়েছে তাকে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গত তিন মাসে ১৬৬ জন সাব রেজিষ্ট্রার ও ১০ জন জেলা রেজিষ্ট্রারকে বদলী করা হয়েছে। এর মধ্যে গত এপ্রিল মাসেই ৮৫ জনকে বদলী করা হয়েছে। বদলী বানিজ্যের কারনে একই পদে দু’জনকে বদলী করার পাশাপাশি বদলীর পরের দিনই তদবিরের কারনে একাধিক বদলীর আদেশ বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইন মন্ত্রনালয়ের দুই জন কর্মকর্তা এবং নিবন্ধন অধিদপ্তরের দু জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট বদলী বানিজ্য করছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৫ জন, মার্চ মাসে ৩৯ জন এবং এপ্রিল মাসে ৮৫ জন সাব রেজিষ্ট্রারকে বদলী করা হয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লাকে সম্প্রতি উত্তরা থেকে বদলী করা হয় নীলফামারী জেলার জলঢাকায়। তদবিরের মাধ্যমে গত ৯ এপ্রিল তাকে চট্টগ্রামের সিতাকুন্ডে বদলী করা হয়। আর মাত্র এক বছর আগে সিতাকুন্ডের সাব রেজিষ্ট্রার হিসেবে বদলী হয়ে যাওয়া রায়হান হাবিবকে বদলী করা হয় জামালপুরে। পরবর্তীতে সিতাকুন্ডের বর্তমান সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিবের বদলীর আদেশ বাতিল করা হয়। একই সঙ্গে জলঢাকার সাব রেজিষ্ট্রারের বদলী আদেশও বাতিল করা হয়। একই ভাবে মাগুরার সালিখার সাব রেজিষ্ট্রার শহিদুল ইসলামকে গত ৯ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদরে বদলীর পরের দিনই বদলীর আদেশ স্থগিত করা হয়। ধানমন্ডির সাব রেজিস্ট্রার আবুল হোসেনকে যশোরের চৌগাছায় বদলীর মাত্র এক মাসের মধ্যেই আবার গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে বদলী করা হয়।
এই সিন্ডিকেট সুবিধার বিনিময়ে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে বদলী করেছে বলে সংস্লিষ্টরা জানান। বুড়িচং এর সোহেল রানাকে গত ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুরে বদলী করে আনা হয়েছে। তিনি দলিল পেলেই বনবিভাগের জমি দাবি করে মোটা অংকের ঘুষি দাবি করেন। গাজীপুরের শ্রীপুরের সাব রেজিষ্ট্রার ওসমান গনি মন্ডলকে পাবনা সদরে বদলী করার মাত্র ১৭ দিন পরে ২০ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাপাসিয়ায় বদলী করে আনা হয়েছে। রামজীবন কুন্ডুকে পঞ্চগড়ের বোদা থেকে রংপুরের পীরগাছা, আরিফুর রহমানকে চাদপুরের ফরিদগঞ্জ থেকে ধানমন্ডি, সাদ্দাম হোসেন খানকে পঞ্চগড় থেকে ঢাকার মিরপুর, আব্দুল কাদিরকে চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ থেকে ঢাকার মোহাম্মপুর, জুবায়ের হোসেনকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে ঢাকার কালামপুর, মো. তাহাজ্জোদ হোসেনকে পাবনার সুজানগর থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈর, মো. আব্দুল বাতেনকে নবাবগঞ্জ থেকে গাজীপুর সদর সাব রেজিষ্ট্রার হিসেবে বদলী করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে বদলী বানিজ্যের সিন্ডিকেটের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলোতে বদলীর ক্ষেত্রে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভুমিকা রেখেছে। এছাড়া বরিশাল সদরের সাব রেজিষ্ট্রার অসিম কল্লোলকে গত ৯ এপ্রিল ঝালকাঠির কাঠালিয়ায় বদলী করা হলেও একই অফিসে বরিশালের রহমতপুর সাব রেজিষ্ট্রার রেহানা পারভীনকেও বদলী করা হয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে আরেকটি আদেশে রেহানা পারভীনকে বরিশালের মুলাদীতে বদলী করা হয়। একই ভাবে ঠাকুরগাও এর হরিপুরের সাব রেজিষ্ট্রার মনিষা রায়কে কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর দিনাজপুরের হাকিমপুর অফিসে বদলী করা হলেও তিনি সেখানে যোগদানের আগেই গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আরেক আদেশে তাকে ঠাকুরগাও এর পীরগঞ্জে বদলী করা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম সদরের সাব রেজিষ্ট্রার সঞ্জয় আচার্যকে ৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে বদলী করা হলেও কুমারখালির সাব রেজিষ্ট্রারকে কোথায় বদলী হয়নি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে দু’দিন পর সঞ্জয় আচার্যকে কুমারখালির পরিবর্তে ভেড়ামারায় বদলী করা হয়।
একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আমলে আওয়ামী লীগের লোক পরিচয় দিয়ে দাপট দেখানো কর্মকর্তারা সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে এখনো ভাল পোষ্টিং বাগিয়ে নিচ্ছেন। একারনে দিনাজপুরের সাব রেজিস্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহ দুই দফায় জেলে যাওয়ার পরও শাস্তির পরিবর্তে প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। সুব্রত মোটা অংকের টাকা খরচ করে সংস্লিষ্টদের ম্যানেজ করায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জেলে যাওয়ার পরও বরখাস্ত হননি। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইং তিনি জেলে যাওয়ার পর দেশের জাতীয় দৈনিক গুলোতে বড় করে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তাকে বরখাস্ত না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে। কারণ কোন সরকারি কর্মকর্তা এক দিনের জন্য জেলে গেলেও তাকে বরখাস্ত হতে হয়। এ নিয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যেও তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।
এবিষয়ে রংপুর সদরের সাব-রেজিস্টার সুব্রত কুমার সিংহ অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, তিনি জেলে ছিলেন না। ‘তিনি জেলে যাওয়ার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে’ এই খবরগুলো কি মিথ্যা এমন প্রশ্ন করলে এবিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে চান না বলে জানান।
এবিষয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের আইআরও (রাজশাহী বিভাগ) মতিউর রহমান বলেন, সাব রেজিষ্ট্রার যে জেলে ছিলেন তা তাদেরকে জানানো হয়নি। অধিদপ্তর যেহেতু অফিসিয়ালি জানে না যে তিনি জেলে গেছেন তাই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি।
বদলী বানিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নিবন্ধন অধিদপ্তরের সহকারি মহাপরিদর্শক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, বদলীর বিষয়টি চূড়ান্ত করে মন্ত্রনালয়। মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী অধিদপ্তর বদলী বা পদায়নের আদেশ জারি করে। অধিদপ্তর থেকে প্রস্তাবনা পাঠানো হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়ম রয়েছে তাই প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। বদলী বানিজ্যের বিষয়ে কোন সিন্ডিকেট রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না ।